আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রোম সম্রাটকে লিখিত মহানবী (সাঃ) এর পত্র ! -১

"A little knowledge of science makes man an atheist, but an in-depth study of science makes him a believer in God." Francis Bacon.

খ্রিষ্ট্রীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে আরব উপদ্বীপের দুই দিকে ছিল দু'টি বিরাট রাষ্ট্রশক্তি । একটি পারস্য সাম্রাজ্য এবং অপরটি রোমান সাম্রাজ্য । আর এ দু'টি সাম্রাজ্য-ই ছিল তখনকার দুনিয়ার সেরা দুটি শক্তি । আরব উপদ্বীপের পূর্ব দিকে পারস্য উপসাগরের দুই তীরে বিস্তৃত ছিল পারস্য সাম্রাজ্য । বর্তমান আফগানিস্তান থেকে শুরু করে ইয়ামান পর্যন্ত এই সাম্রাজ্যের সীমা বিস্তৃত ছিল ।

তখনকার এশিয়ার সর্ববৃহৎ ও সর্বাধিক শক্তিমান এবং প্রাচীন সভ্যতা-সংস্কৃতির ধারকরূপে পারস্য সাম্রাজ্যের অনন্য বৈশিষ্ট্যের কথা এখনও পর্যন্ত ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হয়ে আছে । অপরদিকে আরব উপদ্বীপের পশ্চিম দিকে অবস্হিত লোহিত সাগরের তীরবর্তী এলাকা থেকে শুরু করে কৃষ্ঞ সাগরের উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল প্রাচীন বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য । আরবরা এটাকে রোম সাম্রাজ্যরূপে অভিহিত করত । এই দু'টি বিশাল সাম্রাজ্যের সীমান্ত বর্তমান ইরাকের দজলা-ফোরাত তীরে একত্রিত হয়েছিল । রোম ইউরোপের প্রাচীনতম শহরগুলোর একটি ।

বর্তমানে ইটালীর রাজধানী । খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতব্দীর গোড়ার দিকে বিশাল রোম সাম্রাজ্য পূর্ব ও পশ্চিম দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায় । পূর্ব-রোমান সাম্রাজ্যের আওতাধীন ছিল এশিয়া-মাইনর, মিসর, শাম, ফিলিস্তিন প্রভৃতি অন্চল । সম্রাট কনষ্টাইন ৩২৬ খ্রিষ্টাব্দে এশিয়া ও ইউরোপের সংযোস্হলে অবস্হিত বসফোরাস প্রণালীর তীরে একটি শহরের পত্তন করেন । এটির নামকরণ করা হয়েছিল সম্রাটের নিজের নামের সাথে যুক্ত করে কনষ্টান্টিপোল ।

মুসলমানগণ এ শহরটি অধিকার করে এর নামকরণ করেছিলেন ইস্তাম্বুল । কয়েক শতাব্দীব্যাপী এই । ঐতিহ্যবান শহরটি ইসলামী খিলাফতের রাজধানী ছিল এবং এখনও পর্যন্ত এটি মুসলিম-জাহানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহররূপে বিবেচিত । কনষ্টান্টিপোল কর্তৃক বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশকেই পবিত্র কুরআনে এবং ইসলামী ইতিহাসে রোম সাম্রাজ্য নামে উল্লেখ করা হয়েছে । এই সাম্রাজ্যের সম্রাটের উপাধি ছিল কায়সার ।

ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড গীবনের বর্ণনা অনুযায়ী এই সাম্রাজ্যটি ছিল তদানীন্তন পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা সুসভ্য এবং সম্রাট কায়সার সাম্রাজ্যের সর্বেসর্বা হওয়ার পাশাপাশি খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় প্রধানরূপেও বিবেচিত হতেন । প্রিয়তম নবী হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নবুয়ত প্রাপ্তির তিন বছরের মাথায় (৬১৩ খ্রীঃ) ইরানের শাহন শাহ খসরু পারভেজ হঠাৎ করেই রোম সাম্রাজ্য আক্রমণ করে বসেন । অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আগ্রাসী ইরানীরা ইরাক, শাম, মিসর অধিকার করে এশিয়া-মাইনরে ঢুকে পড়ে । [Battle between Heraclius' army and Persians under Khosrau II. Fresco by Piero della Francesca, c. 1452] রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস ইরনীদের এই হামলা প্রতিহত করতে পারলেন না । অগ্নি উপাসক ইরানীরা রোম সাম্রাজ্যের সমগ্র পূর্ব অন্চল দখল করে রাজধানী কনষ্টান্টিপোলের দ্বারদেশ পর্যন্ত পৌছে গেল ।

অভাবিত পূর্ব জয়লাভ করার পর ইরানীরা খ্রিষ্টান জনগণের উপর ভীষণ অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করে । খ্রিষ্টধর্মের সব কটি আলামত ভুলুন্ঠিত করা হয় । এমনকি তাদের সর্বপ্রধান ধর্মীয় আলামত পবিত্র ক্রসের সেই দুর্লভ কাষ্ঠখন্ডটি বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে ছিনিয়ে এনে তদানিন্তন পারস্যের রাজধানী মাদায়েনে পৌছে দেওয়া হয় - যেটি সম্পর্কে তাদের বিশ্বাস ছিল যে, এ কাষ্ঠখন্ডটিতে-ই হযরত ঈসা (আঃ) কে ফাসিতে ঝুলানো হয়েছিল ! প্রতিবেশী দু'টি বৃহৎ শক্তির মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ এবং রোমানদের সেই শোচনীয় পরাজয়ের সময়টিতে মক্কায় হযরত নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এবং তার অনুসারীগণের উপর চলছিল কাফের-মুশরেকদের পক্ষ থেকে অমানুষিক অত্যাচার-নির্যাতন । অগ্নি উপাসক পারস্যবাসীদের অবিশ্বাস্য বিজয় সংবাদে মক্বার অংশীবাদী পৈাত্তলিকরা দারূণ উল্লসিত হয় । তারা তখন মুসলমানদের লক্ষ্য করে বলতে লাগল, ওহী-নবী-রাসূল এবং আসমানী দ্বীনের দাবীদার খ্রিষ্টানরা যেভাবে পৌত্তলিক পারসিকদের হাতে পর্য্যুদস্ত হয়েছে, ঠিক সেভাবেই আসামনী প্রত্যাদেশ প্রাপ্তির দাবীদার মুসলমানরাও আমাদের হাতে উৎখাত হবে ।

মক্বার সে কাফেরদের উল্লাস ও আস্ফালনের জবাবেই নাযিল হয় পবিত্র কুরআনের সূরা রোমের প্রাথমিক কয়েকটি আয়াত । যে আয়াতগুলিতে বলা হয়েছে যে, রোম তার প্রতিবেশীর হাতে পরাজিত হয়েছে । কিন্তু এই পরাজয়-ই শেষ কথা নয় । খুব শিগগিরই আগামী কয়েক বছরের মাথায় ওরা পুনরায় জয়ী হবে । অগ্র-পশ্চাত সব বিষয়-ই মহান আল্লাহর নিয়ন্ত্রাধীন ।

সেদিন মুসলমানগণও উৎফুল্ল হবে আল্লাহর সাহায্যে । আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সাহায্য করেন । তিনি প্রবল পরাক্রান্ত ও দয়ালূ । এটা আল্লাহর ওয়াদা , তিনি কখনও ওয়াদা খেলাপ করেন না । পবিত্র কুরআনের এই ভবিষ্যদ্বাণীটিতে দু'টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছিল ।

এক. - তখনকার সেই দুরাবস্হার কবল থেকে রোম সাম্রাজ্যের আশু উত্তরণ ঘটবে এবং পৌত্তলিকদের বর্তমান উল্লাস বিষাদে রূপান্তরিত হবে । দুই.- সেদিন আল্লাহর সাহায্যের বরকতেই মুসলমানদেরও উল্লসিত হওয়ার কারণ ঘটবে । প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড গীবন লিখেছেন, পবিত্র কুরআনে উপরোক্ত ভবিষ্যদ্বাণী যখন উচ্চারিত হয়েছিল তখন রোমানদের পক্ষে বিজয়ী পারস্য শক্তির উপর পুনঃবিজয় লাভ করাতো দূরের কথা, তাদের পক্ষে মাথা তুলে দাড়াবার কোন দূরতম সম্ভাবনাও ছিল না । অপরদিকে মুসলমানগণও তখন যেরূপ অবর্ণনীয় দুরবস্হায় পতিত ছিল সেই পরিস্হিতিতে তাদের পক্ষেও অদূর ভবিষ্যতে জাতীয় পর্যায়ে কোন সুসংবাদের আশা করাটা ছিল সম্পূর্ণ দুরাশা মাত্র । কিন্তু হযরত নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার অনুসারীগণ কুরআনের এই ভবিষ্যদ্বাণীর উপর এতটাই দৃঢ় আস্হাশীল ছিলেন যে, হযরত আবু-বকর (রাঃ) উবাই ইবনে খালাফ নামক জনৈক কুরাইশ সর্দারের সাথে এই ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হওয়া না হওয়ার প্রশ্নে একশ উট বাজি ধরে বসলেন ।

অর্থাৎ যুক্তিসঙ্গত সময়ের মধ্যে কুরআনে উক্ত ভবিষ্যদ্বাণী যদি বাস্তবায়িত না হয় তবে হযরত আবু-বকর (রাঃ) উবাইকে একশ উট দিবেন । আর যদি বাস্তবায়িত হয়ে যায় তবে উবাই হযরত আবু-বকর (রাঃ) কে একশ উট প্রদান করবে । এই ঘটনার কয়েক বছর পর-ই (৬২২ খ্রীঃ) একদিকে হযরত নবী করিস সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম মক্বা থেকে হিজরত করে মদীনায় চলে এলেন, অপরদিকে রোম সম্রাট কায়সার তার রাজধানী কনস্টান্টিপোলের সন্নিকটে ইরানের অবরোধ ভেঙ্গে প্রতিপক্ষের উপর প্রতি আক্রমণ করতে সমর্থ হলেন । সম্রাট হিরাক্লিয়াস যখন ৬২২ খ্রীঃ ইরানীদের উপর প্রতি আক্রমণ করার উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছিলেন- তখন রাজধানী কনস্টান্টিপোলের বহু জ্ঞানী-গুণীর মনেও এরূপ একটা ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল যে, এটাই সম্ভবত রোম সম্রাটের শেষ যুদ্ধযাত্রা । কিন্তু সকল জল্পনা-কল্পণার জাল ছিন্ন করে রোম সম্রাট বিজয় লাভ করলেন ।

শুধু জয়লাভ-ই করলেন না, আজারবাইজান পর্যন্ত পৌছে পারসিকদের সর্বাপেক্ষা বড় অগ্নিকুন্ডটি সম্পূর্ণ ধূলিস্যাত করে দিলেন । অপরদিকে হিজরী ২ সনে বদরের ময়দানে অকল্পনীয় বিজয় লাভ করে মজলূম মুসলমানগণও উল্লসিত হওয়ার সুযোগ লাভ করলেন । আর এভাবে-ই পবিত্র কুরআনের তাৎপর্যপূর্ণ দু'টি ভবিষ্যদ্বাণী-ই অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হলো । হৃতরাজ্য পুনরূদ্ধার এবং শত্রুর উপর অকল্পনীয় বিজয় লাভ করার আনন্দে উদ্বেলিত হিরাক্লিয়াস বায়তুল মোকাদ্দাস জিয়ারত করতে এসেছিলেন । ঠিক এ সময়টাতেই হযরত নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের দূত দেহইয়া বিন খলীফা কালবী (রাঃ) হযরত নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পত্র সহ বাইতুল মোকাদ্দাসে পৌছেন ।

ভরা দরবারে হযরত দেহইয়া বিল খলীফা (রাঃ) প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পত্রটি সম্রাটের হাতে অর্পণ করেন । [পরের পোষ্টে সমাপ্য] সূত্রঃ মাসিক মদীনা, মার্চ-২০০৯ , সীরাতু্ন্নবী (সাঃ) সংখ্যা - ১৪৩০ হিজরী ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।