দুঃখটাকে দিলাম ছুটি, আসবে না ফিরে
রাসুলুল্লাহ (সা.) এর একটি ছবি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এঁকেছেন। তিনি বলেছেন, একদিন যখন আমি নবী করীম (সা.) এর নিকট উপস্থিত ছিলাম তিনি মিম্বরের উপর আসীন ছিলেন। আমাকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন, আমাকে কুরআন পড়ে শোনাও। আমি বিস্মিত হয়ে আদবের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কুরআন পাঠ করে আপনাকে শোনাব, অথচ এই কুরআন আপনার উপরই নাযিল হয়েছে। তিনি বললেন হ্যাঁ তাতো ঠিক।
কিন্তু আমি তা অন্য কারও কাছ থেকে শুনতে চাইছি। হযরত মাসউদ (রা.) বলেছেন, অতপর আমি সুরা আননিসা পড়তে শুরু করে দিলাম। আমি এ আয়াত পর্যন্ত পৌঁছলাম: সেই সময়ে কি হবে যখন আমরা প্রতিটি জনগোষ্ঠী থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করবো এবং তোমাকে হে রাসুল (স.) সেই সবের উপর একজন সাক্ষী বানিয়ে দাঁড় করাব? (সুরা আননিসাঃ আয়াত ৪১) এ আয়াত শোনা মাত্র ধ্বনি উঠল, আব্দুল্লাহ, পাঠ বন্ধ কর। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তাঁর দুটো চোখ দিয়েই অশ্রুর বন্যা প্রবাহিত হচ্ছে। (বুখারী, মুসলিম)
এ এক মর্মস্পর্শী দৃশ্য।
একটি হৃদয়বিদারক ছবি। একটু চিন্তা করুন, দায়িত্বজ্ঞান ও জবাবদিহির তীব্র গভীর অনুভূতির এ কোন বহিপ্রকাশ। এমন প্রচন্ড অনুভূতি, যা দিলকে বিগলিত করে, চক্ষুকে অশ্রু নির্ঝর বানায়। সে কিসের দায়িত্ব? তা হচ্ছে আল্লাহর বান্দাহর সম্মুখে সত্য ও ন্যায়ের সাক্ষ্যদানের অত্যন্ত কঠিন দায়িত্ব। এই অনুভূতি এতই তীব্র ও প্রচন্ড যে, একদিন নিশ্চিতভাবেই আল্লাহর সামনে আমাকে দাঁড়াতে হবে।
আল্লাহ আমাকে জিজ্ঞেস করবেন, তোমাকে তো সত্য ও ন্যায়ের সাক্ষী বানিয়ে পাঠিয়েছিলাম, তুমি সে দায়িত্ব কতটা পালন করেছো? তখন আমি এ জিজ্ঞাসার কি জবাব দেব? আল্লাহর প্রতি কতটা ভালোবাসা থাকলে এরুপ অনুভূতি জাগতে পারে। যেমন রাসুলে করীম (সা.) এর জেগেছিলো? তাঁর সম্মুখে দাঁড়াবার ভয় কতখানি প্রচন্ড হলে আজই সেই ভয়ে কেঁদে উঠতে হয়? দিলকে আকর্ষণ করার, ভালোবাসার সঙ্গে দিলকে কাঁপিয়ে দেয়ার আতঙ্ক এখানে একাকার, পরস্পর সংমিশ্রিত। আল্লাহর সৃষ্টিকুলের প্রতি ভালোবাসা ও দরদে উদ্বেলিত হৃদয়। আল্লাহর কালামের প্রতি কতটা দৃঢ় প্রত্যয় থাকলে অনির্দিষ্ট পরকালের কথা আজ এই মুহুর্তে বাস্তব মনে হতে পারে। খোদায়ী কালামের এক ফোঁটা বৃষ্টিপাতেই দিল এতটা তরঙ্গায়িত হয়ে উঠল যে, ভয়-ভালোবাসা ও দয়া-অনুভূতি চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
এখন দ্বিতীয় একটি ছবির প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। এ ছবি কোন মানুষ কর্তৃক অঙ্কিত হয়নি। যিনি নিজে নিজেকে অল মুসাব্বিরুপে পেশ করেছেন এবং চিত্রকর হিসাবে যার পূর্ণত্বের সাক্ষ্য দেয় সমগ্র জগত, এ ছবি তাঁরই অঙ্কিত। ইরশাদ হয়েছে,
"লোকেরা ঈমানদার হচ্ছে না-এই চিন্তায় হয়ত বা আপনি নিজে নিজেকে ধ্বংস করে ফেলবেন। "
কথাটি বেশ সংক্ষিপ্ত।
কিন্তু এর মাধ্যমে যে ছবিটি গড়ে উঠেছে তা পূর্ণাঙ্গ ও ব্যাপক। এ ছবিটিতে বহু প্রকারের রঙ জ্বলজ্বল করছে। এর উজ্জল রেখাগুলো দিলের মধ্যে প্রচন্ড চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এর একটা রঙ হলো, নিজের সত্যতা ও যথার্থতার উপর দৃঢ় প্রত্যয়। দিনের বেলা সুর্যোদয়ের ব্যাপারে যেমন দৃঢ় প্রত্যয় থাকে, এও ঠিক তেমনি প্রত্যয়।
আমাদের জন্য যা গায়েব, নবীর জন্য তা নিজ চোখে দেখা সত্য। এই প্রত্যয়ের বিপরীতে রয়েছে অস্বীকৃতি- বারেবারের অস্বীকৃতি। সত্যকে মিথ্যা মনে করার, অগ্রাহ্য করার প্রবৃত্তি। দিনের বেলা একটি লোক বলছে হে লোকেরা এটা দিন। কিন্তু লোকেরা তা মেনে নিচ্ছে না।
বরং সেই লোককে মিথ্যুক প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বলে, লোকটি মিথ্যা বলছে, কল্পনা করে বলছে যে, এটা দিন আকাশে সূর্য দেদিপ্যমান, তখন এই লোকটির মানসিক অবস্থা কি দাঁড়ায়, তা একবার ভেবে দেখুন। তখন তার দিল বসে যাবে, ভেঙ্গে পড়বে। শুধু মিথ্যুক প্রতিপন্ন করা বা মানতে অস্বীকার করাই তো নয়। সেই সঙ্গে রয়েছে নির্লজ্জ ঠাট্টা-বিদ্রুপ।
দিনকে দিন বলার অপরাধে প্রচন্ড বিদ্রুপবানে তাকে জর্জরিত ও ক্ষত-বিক্ষত করা হচ্ছে। তারপরও প্রবল বিরুদ্ধতা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। তাঁকে হিংসা ও বিদ্বেষে ভাসিয়ে দিতে চাইছে। তার উপর নানাবিধ উৎপীড়ন চালানো হচ্ছে। তখন সে লোকটির মানসিক অবস্থা যে কি হয়ে পড়ে একবার ভেবে দেখেছেন? চিন্তায় চিন্তায় নিজেকে তিল তিল করে ধ্বংস করার চিত্রটিই এখানে ফুটে উঠেছে।
এর চাইতে অধিক মন জয়কারী আর একটি চিত্র রয়েছে। মিথ্যুক প্রতিপন্ন করা , অস্বীকার ও শত্রুতা করার পরিণতিতে দিল ভেঙ্গে যাওয়া, তিল তিল করে ধ্বংস হয়ে যাওয়া তো একটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রায় মানুষেরই এরুপ অবস্থা হতে পারে, হয়ে থাকে। যদিও তার প্রকৃত রুপটা ধারণায় নিয়ে আসা অত্যন্ত কঠিন। মহান চিত্রকর তাঁর ব্যবহৃত শব্দের মাধ্যমে যে ছবিটি আমাদের চোখের সামনে প্রকট করে তুলে ধরেছেন তা অনেক উচ্চ মানের।
আর তা হচ্ছে শত মিথ্যা প্রতিপন্নকরণ ও শত্রুতাকরণ সত্ত্বেও দিলে এক বিন্দু ক্রোধের উদ্রেক না হওয়া, নৈরাশ্যের ঘনঘটায় মনের আকাশ আচ্ছন্ন না হওয়া, প্রতিশোধ স্পৃহায় ক্ষিপ্ত হয়ে না ওঠা, ক্ষুব্ধ হয়ে তাড়িয়ে দেয়ার আচরণ গ্রহণ না করা, ধ্বংস-বরবাদ হয়ে যাওয়ার ইচ্ছে বা কামনা না জাগা বরং তার বিপরীতে কল্যাণ কামনা, মঙ্গলাকাঙ্খা, ভালোবাসা শুধু ভালোবাসা। কেবলমাত্র একটি ভাবনা একটিই আগ্রহ, একটিই চিন্তা কাতরতা, একটিই দরদ ও জ্বালা, কেমন করে এই লোকগুলো ঈমানের পথে আসবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি, ক্রোধ ও তাঁর আযাব থেকে কেমন করে বাঁচানো যাবে। কিভাবে তারা আল্লাহর জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে এবং এই দুনিয়ায় ন্যয় পরায়নতা ও সুবিচারের নিয়ামত পেয়ে ধন্য হবে। এখানে আগ্রহ, চিন্তা ও ভাবনার কয়েকটি রঙের সমাবেশ ঘটেছে।
এর শব্দসম্ভার দ্বারাই এই চিত্রটির রুপরেখা তৈরি করা হয়েছে। এই ভাবনায় তাঁর কলিজা কুরে কুরে খাচ্ছে, তিন তিল তিল করে ধ্বংস হচ্ছেন, তাঁর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে চিন্তা ও দুঃখের চাপে।
লোকেরা কথা শুনছে না, ভাবনা শুধু এটারই নয়, শুধু এর জন্যই হৃদয়টা টুকরো টুকরো হচ্ছে না। পরম সত্য হেদায়াতকে ওরা মেনে নিচ্ছে না কেবল এটাই দুঃখের কারণ নয়। লোকেরা আমার প্রতি আস্থাবান হোক, আমার প্রতি ঈমান গ্রহণ করুক, চেষ্টা সাধনা শুধু এটুতুর জন্যই নয়।
হৃদয় মন জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে এবং তাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আর তা করছে সম্পূর্ণ নির্ভাবনায়, নিশ্চিন্ত ও খুশীর সঙ্গে।
" ওরা আগুনে জ্বলবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে কত বড় দুঃসাহসিকতার ব্যাপার, তা বড়ই আশ্চর্যের বিষয়। " (সুরা আল বাকারাঃ ১৭৫)
একদিকে আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতি ভালোবাসা। নিজের গোটা সত্ত্বা প্রেম ভালোবাসায় কানায় কানায় ভর্তি।
তাঁকে তো বলায় হয়েছে 'রাহমাতুল্লিল আলামিন'....... সমগ্র বিশ্বলোকের জন্য রহমত। অপরদিকে যাদেরকে তিনি ভালোবাসেন, সেই মানুষগুলো প্রকৃত প্রিয় মহান আল্লাহর নিকট থেকে দুরে সরে পালিয়ে যাচ্ছে। পরিণামে ধ্বংস হতে চলেছে। এই অবস্থায় সেই লোকের মনের অবস্থা কি হতে পারে একবর ভেবে দেখুন। রাসুল (সা.) নিজেই সেই অবস্থার প্রতিচ্ছবি করেছেন নিম্নের কথাগুলোর মাধ্যমে।
"আমার দৃষ্টান্ত এরুপ, যেমন এক ব্যক্তি আগুনের কুন্ডলী জ্বালালো। সেই আগুনের ঔজ্জ্বল্যে প্রকা-মাকড়গুলো আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। কিন্তু সেই ব্যক্তিটি সেগুলিকে বাধা দিচ্ছে, আগুনে ঝাঁপ দেয়া থেকে ফেরাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু পোকামাকড়গুলো তাঁর এ চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে তার উপর জয়ী হয়ে যাবার উপক্রম করছে। আর দলে দলে আগুনে লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ছে।
ঠিক সেরকমই আমি তোমাদের কোমর ধরে বসেছি। আগুনে পড়ে থেকে ফেরাবার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করছি। অথচ তোমরা কেবল সেই অগ্নিকুন্ডলীতেই ঝাঁপিয়ে পড়ছ অবিরতভাবে। (বুখারী, মুসলীম)
(সংক্ষেপিত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।