জীবনানন্দ দাশের 'উনিশশো চৌত্রিশের' শিরোনামে খুব অদ্ভুত একটা কবিতা আছে। দীর্ঘ কবিতা, অতোখানি টাইপ করার ধৈর্য্য নেই, কিন্তু শেষ কটি লাইন এই লেখাটির জন্য খুব দরকারি। অদ্ভুত বলেছি, কারণ- এটি ঠিক জীবনানন্দীয় বলে মনে হয় না। কবিতাটি শুরু হয় এইভাবে-
'একটা মোটরকার
খটকা নিয়ে আসে। '
এরপর মোটরকার নিয়ে তার নিজস্ব বোঝাপড়া-
'মোটরকার সব-সময়েই একটা অন্ধকার জিনিস
যদিও দিনের রৌদ্র-আলোর পথে
রাতের সুদীপ্ত গ্যাসের ভিতর
আলোর সন্তানদের মধ্যে
তার নাম সবচেয়ে প্রথম।
'
তারপর মোটরকারের গতিময়তায়তার বর্ণনা দেবার আগে বেশকিছু লাইনে এ নিয়ে তাঁর বিস্ময়-বিরক্তি-হতাশা এবং যথারীতি জীবনের বিবিধ প্রসঙ্গ নিয়ে নানা প্রশ্ন, এবং অতপর এর গতিময়তা সম্বন্ধে তাঁর অভিব্যক্তি-
'রাতের অন্ধকারে হাজার-হাজার কার হু-হু করে ছুটছে
প্যারিসে-নিউইয়র্কে-লন্ডনে-বার্লিনে-ভিয়েনায়-কলকাতায়
সমুদ্রের এপার ওপার ছুঁয়ে
অসংখ্য তারের মতো,
রাতের উল্কার মতো,
মানুষ-মানুষীর অবিরাম সংকল্প আয়োজনের অজস্র আলেয়ার মতো
তারাও চলেছে-
কোথায় চলেছে, তা আমি জানি না। '
তারপরই সেই মোক্ষম-অনবদ্য লাইনগুলো:
একটা মোটরকারের পথ- মোটরকার
সবসময়ই আমার কাছে খটকার মতো মনে হয়েছে,
অন্ধকারের মতো।
আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
২.
এই লেখার জন্য কেন এই কবিতা? সামহোয়ারে আমি লিখছি একবছর হয়ে গেলো! বর্ষপূতিতে পোস্ট দেয়াটা ব্লগীয় রীতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্লগারদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা আর অনুভূতির চমৎকার প্রকাশ ঘটতে দেখেছি সেসব পোস্টে। কিন্তু আমি অনেক ভেবেও ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না- কী লেখা যায়! পরিসংখ্যানটা দেখুন :
ব্লগার পরিসংখ্যান
পোস্ট করেছেন: ৬০টি
মন্তব্য করেছেন: ২৩৭৬টি
মন্তব্য পেয়েছেন: ৩৩৫০টি
ব্লগ লিখেছেন: ১ বছর ১ দিন
ব্লগটি মোট ৪৮১৯৪ বার দেখা হয়েছে
এরকম পরিসংখ্যান কোনো নিয়মিত-অ্যাক্টিভ ব্লগারের জন্য বেমানান। অনেকেই মাত্র তিন মাসেই এই পরিসংখ্যান অর্জন করে ফেলেন! তুলনামূলক বিচারের দিকে যদি যাই তাহলে ওই কবিতার এই দুটো লাইন খুব মোক্ষম হবে :
'আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে'
কিন্তু আমাকে স্বান্ত্বনা জোগায় শেষ প্যারার ওই সমস্ত উজ্জ্বল লাইনগুলো। মনে হয়-
'আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না'
মোটকথা : আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না!
সত্যি বলতে কি, আমি আসলে কোথাও যেতেই চাই না, কোথাও পৌঁছতেও চাই না, আমার আসলে কোনো গন্তব্য নেই; আমি কেবল প্রবাহমান থাকতে চাই, কেবল বয়ে চলতে চাই; কারণ, জীবনের অন্য নাম জার্নি- এ কথা অনেক আগেই জেনে ফেলেছি।
বুঝি, এ সবই আসলে 'গভীরভাবে অচল মানুষ'দের নিজেকে স্বান্ত্বনা দেবার নিজস্ব পদ্ধতি। আসলে যে পারে, সে মোটরকারে করেই যায়, যে পারে না, সে ওইসব কবিতার পঙক্তি নিয়ে পড়ে থাকে। হায়, জীবনানন্দ, আমিও আপনার মতো না-পারা না-হওয়া অচল মানুষ!
৩.
সামহোয়ারে আমার এই একবছরের অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতি লিখতে গেলে এক লেখায় কুলোবে না! সেই চেষ্টা তাই না করাই ভালো। তবে দু-একটি কথা বলা যায়।
পত্রপত্রিকায় লিখছি দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে, বইও বেরিয়েছে একাধিক, বেশকিছু পাঠকও আমার আছে- জানি সেটা।
কিন্তু গত একবছরে সামহোয়ারে সহব্লগারদের কাছ থেকে আমি যে পরিমান পাঠ-প্রতিক্রিয়া পেয়েছি তা গত দেড়যুগেও মূলধারার মিডিয়ায় পাইনি! এখানকার এই মিথস্ক্রিয়াটা অসাধারণ! শুধু তাই নয়- আমার ধীরগতির ব্লগিং, দীর্ঘদিন পরপর লেখা পোস্ট করা নিয়ে সহব্লগারদের আপত্তি এবং নতুন লেখার জন্য আমাকে ক্রমাগত চাপের ওপর রাখাটাও আমার জন্য খুব উপভোগ্য ব্যাপার ছিলো। সহব্লগারদের কাছ থেকে যে অযাচিত ভালোবাসা ও সম্মান পেয়েছি তা আমাকে অসম্ভব স্পর্শ করেছে, হয়েছি গভীরভাবে আপ্লুত।
আমি ব্লগিং শুরু করার প্রায় প্রথম থেকেই সামহোয়ারের বিভিন্ন অসঙ্গতিপূর্ণ বিষয় নিয়ে কঠোর সমালোচনা করে এসেছি। ব্লগারদের লেখার কপিরাইট কি কতৃপক্ষের নাকি লেখকের- এই বিষয়ে বিতর্ক শুরু করেছিলাম ব্লগিঙের শুরু থেকেই, এরপর ব্লগ বাতিল/স্থগিত করার নীতিগত অধিকার কতৃপক্ষের আছে কী না- এ নিয়েও আরেকদফা সমালোচনা করেছি, কতৃপক্ষের অস্বচ্ছ মডারেশন নীতিমালা নিয়েও বিভিন্ন পোস্টে প্রচুর কথা বলেছি। এ ছাড়াও নানা ইস্যুতে প্রতিবাদ ও সমালোচনায় আমার কখনো ক্লান্তি ছিলো না।
কিন্তু সেই অর্থে প্রশংসা পাবার মতো যেসব বৈশিষ্ট্য এই ব্লগের আছে, সেগুলো নিয়ে কখনো কথা বলা হয়নি। এসব দেখে যে-কারো মনে হতে পারে- আমি বোধহয় এই মাধ্যমটির মধ্যে ভালোকিছু দেখতে পাই না!
কেউ যদি সেটা মনে করে থাকেন, তিনি ভুল করবেন। আজকে আমি খুব পরিষ্কার করেই বলতে চাই- সামহোয়ার নিশ্চিতভাবেই আগামী দিনে এ দেশের একটি বিকল্প গণমাধ্যম হয়ে উঠবে! কেন বলছি একথা, সেটি একটি ভিন্ন লেখায় বলার চেষ্টা করবো। আজ শুধু এটুকুই বলি- এই বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
৪.
ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি কিংবা সম্পর্ক রক্ষা করায় আমি প্রায় ব্যর্থ একজন মানুষ।
বাস্তব জীবনে এবং এই ভার্চুয়াল জগতে আমার সাড়াহীনতা প্রায় জড়পদার্থের মতোই! আমার মেইলবক্সে আসা চিঠিগুলো, আমার ফেইসবুকের ওয়াল বা ইনবক্সে আসা চিঠি বা লেখাগুলো, ব্লগে আসা মন্তব্যগুলো বেশিরভাগ সময়ই নিরুত্তর পড়ে থাকে! আমি শুধু দেখি, পড়ি, ভাবি- কিন্তু নিজে আর লেখা হয় না! এমনকি ব্লগে বহু লেখা পড়ার পরও স্রেফ আলস্যের কারণে মন্তব্য করা হয় না! আমার এই পর্বতসমান আলস্য নিয়ে, আর যাই হোক, একটা ইন্টারঅ্যাক্টিভ মিডিয়ায় বিচরণ করা কঠিন কাজ! কিন্তু কী-ই বা করতে পারি আমি!
'আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ/ হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে!'
৫.
মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগিংটা ছেড়ে দিলে কেমন হয়! হুটহাট করে কোনোকিছু ছেড়ে দেবার অভ্যাস আমার আছে! মনে হয়, কি লাভ এতসব মায়া-মমতা-স্নেহ-ভালোবাস-শ্রদ্ধা-সম্মানের সম্পর্কে জড়িয়ে! ভার্চুয়াল এই সম্পর্ক, তবু এ যে বড়ো প্রাণবন্ত, বড়ো মায়াভরা! কতো ধরনের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলো এখানে! দেখলাম কেউ কেউ এমনকি কাঁধে পাহাড় তুলে নেবার মতো মনের জোরও রাখেন! যতোই থাকবো এখানে ততোই জড়িয়ে পড়বো! তারচেয়ে চলে গেলে ভালো হয় না! কিন্তু ঘোষণা-টোষণা দিয়ে, নাটক-ফাটক করে কোনোকিছু করার লোকই নই আমি। চলে গেলেও নিঃশব্দে যাবো, কেউ টেরই পাবে না! এত বড়ো একটা প্ল্যাটফর্ম থেকে একজন সামান্য ব্লগারের প্রস্থানে কোথাও এতটুকু সাড়াও পড়বে না!
না, এই ভাবনা কারো প্রতি কোনো অভিমান থেকে নয়, কোনো অভিযোগ থেকেও নয়! একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের নানাবিধ দুর্যোগ-দুর্বিপাকে ক্লান্ত হয়ে এসব ভাবি!
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।