আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আজ কলিগের শেষ অফিস

সবকিছুই চুকিয়ে গেছে গালিব! বাকি আছে শুধু মৃত্যু!!

আজ আমার কলিগের শেষ অফিস। বছর পাঁচেক আগে এই অফিসে চাকরী করতে এসে সর্বপ্রথম তার সাথেই আমার পরিচয় হয়। তারপর একই শাখায় পোস্টিং। সেই সূত্রে একই সঙ্গে কাজ করা। বলা চলে আমার দাপ্তরিক কাজ-কর্ম বা আচার অনুষ্ঠানের হাতেখড়ি তার হাত ধরেই।

বয়সের ব্যবধান আমাদের অনেক। পিতৃতুল্য লোক তিনি। ছেলেমেয়েদের বিয়ে-সাদি দিয়েছেন, নাতি নাতনীর মুখ দেখেছেন। আর আমার ভাগ্যে এখনও বউই জোটেনি। তবে বয়সের এই তারতম্যটা আমাদের সম্পর্কের মাঝে কোন প্রভাব ফেলেনি।

রীতিমত আমরা ছিলাম অসম বয়সী বন্ধুর মতো। এরই ফাকে কখন যে পাঁচটা বছর কেটে গেল তা বুঝে উঠতে পারিনি। আমি বুঝতে না পারলেও সময় ঠিকই তার পাওনা বুঝে নিবে। সেই পাওনা শোধ দিতেই আজ তিনি চলে যাবেন। প্রথামাফিক আমরা তাকে বিদায় জানাব।

চিরাচরিত নিয়মে চলে আসা একটি বিদায় অনুষ্ঠান হবে। সহকর্মীরা স্মৃতিচারণ করব, নিয়মমাফিক চোখের জল ফেলব। সকলে মিলে কিছু উপহার দিব। তারপর তিনিও স্মৃতিচারণ করবেন, চোখের জল ফেলবেন। তারপর চলে যাবেন।

তবে তার এ বিদায় কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে আমরা কখনও বিদায় নিচ্ছি বা বিদায় দিচ্ছি। শৈশবের স্মৃতিগুলোকে বিদায় দিয়ে এসেছি সময়ের সাথে সন্ধি করে। নতুন জীবনের হাতছানিতে বিদায় দিয়েছি বা বিদায় নিয়েছি সেই বন্ধুদের কাছ থেকে, যারা একদিন আমার অস্তিত্বের অংশ ছিল। বিদায় দিয়েছি স্কুলের স্মৃতি, কৈশোরের দুরন্তপনা কিংবা জীবনের প্রথম প্রেমকে।

বিদায় নৈমত্তিক, চিরন্তন এবং জীবনেরই অংশ। তবে চোখে দেখা সবচেয়ে চরম ও পরম বিদায় হচ্ছে মৃত্যু। ছেলেবেলায় মক্তবের মৌলানাকে বলতে শুনতাম মৃত ব্যক্তিকে কবরে শোয়ানোর পর জানাযায় অংশগ্রহণকারীরা চল্লিশ হাত দূরে সরে গেলেই মৃতের বিচার শুরু হয়ে যায়। ঠিক সেই কারণেই কোন নিকট আত্মীয়কে কবরে শোয়ানোর পর সেই স্থান ত্যাগ করতে চাইতাম না। আশংকা থাকত চল্লিশ হাত দূরে সরে গেলেই প্রিয় আত্মীয়টি অনিবার্য শাস্তির সম্মুখীন হবেন।

কারণ এটা বুঝতাম জগতের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের মতো আমার এই আত্মীয়টিও অল্পবিস্তর পাপ কোন না কোন সময় অবশ্যই করেছে। সে কারণেই প্রতিজ্ঞা করতাম এ স্থান ত্যাগ করে কখনই যাবনা। অবশ্য কিছু পরেই এই প্রতিজ্ঞার চিড় ধরত। বয়স্কদের কেউ জোর করে সে স্থান হতে নিয়ে আসত। সময়ের পরিক্রমায় সেই বিশ্বাসে চিড় ধরল।

ক্রমে ক্রমে নিজে নিজেই একজন সংশয়বাদী হয়ে উঠলাম। ভাবতে শুরু করলাম সত্যিই কি মৃত্যুর পরে কিছু হয়? এ বিষয়ে ধর্ম ও বিজ্ঞানের চিন্তাগুলোকে একত্রিত করার চেষ্টা করলাম। এক্ষেত্রে একেশ্বরবাদী ধর্ম বলতে আমরা যা বুঝি অর্থাৎ ইসলাম, খ্রীস্ট ও ইহুদী ধর্মের ব্যাখ্যাটা অনেকটা ভোগবাদী অর্থাৎ give & take এর মত। অর্থাৎ দুনিয়াতে আপনি ঈশ্বরকে আপনার উপাসনার মাধ্যমে তুষ্ট করতে পারলে মৃত্যূর পরে আপনি বেহেস্ত বা প্যারাডাইস লাভ করবেন। আর ঈশ্বর অসন্তুষ্ট হলে নিশ্চিত দোজখ।

এ জীবন চিরস্থায়ী। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয বেহেস্তে আপনি তাই করতে পারবেন যা পৃথিবীতে অনৈতিক বলে বিবেচিত। বহুগামিতা, মদ্যপান ইত্যাদি পৃথিবীতে অনৈতিক বলে বিবেচিত হলেও বেহেস্তে তা স্বীকৃত। এ বিষয়ে সনাতন হিন্দু ধর্মের ব্যাখ্যা ভিন্নধর্মী এবং জটিল। স্বর্গ বা নরক মৃত্যু পরবর্তী জীবনের মূখ্য বিষয় বা অধ্যায় নয়।

ভগবৎ গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ (বিষ্ণুর অবতার) বলেছেন, দেবতাদের সন্তুষ্ট করে তোমরা হয়ত স্বর্গ পেতে পার তবে আমাকে সন্তুষ্ট না করা পর্যন্ত মুক্তি পাবেনা। এ মুক্তি হচ্ছে আত্মার মুক্তি। গীতার মতে প্রতিটি জীবাত্মাই পরমাত্মার অংশ এবং পরমাত্মার সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত তার মুক্তি নেই। কর্মফল ভোগ করতে তাকে অর্থাৎ জীবকে বারবার জন্ম নিতে হয়। মৃত্যুর পর সে যতটুকু ভাল কাজ করবে তার প্রাপ্যতা অনুযায়ী স্বর্গ পাবে এবং পাপের প্রাপ্যতা অনুযায়ী নরকের শাস্তি ভোগ করার পর জীবাত্মার অংশ হয়ে নতুন জীবন চালনার জন্য পৃথিবীতে ফিরে আসবে।

এভাবে জন্মান্তর চলতেই থাকবে এবং এই জীবন মানে দুঃখ, বন্দীত্ব সর্বোপরি অনাকাংখিত কিছু। তবে এই চক্রের কোন পর্যায়ে যদি সে ইশ্বরকে সন্তুষ্ট করতে পারে তবে তার আত্মা এই জন্মের শৃংখল হতে মুক্তি পাবে এবং পরমাত্মার অংশ হবে। মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে ভগবান বুদ্ধের প্রবর্তিত ধর্মের মত দার্শনিক ও ত্যাগের চেতনায় সমৃদ্ধ। হিন্দু ধর্মের মতো বৌদ্ধ ধর্মও জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করে। তবে এ বিশ্বাসে ফারাক এতটুকুন যে মুত্য পরবর্তী স্বর্গ বা নরকের স্পষ্টত উপস্থিতি এ মতবাদে নেই।

আত্মার মুক্তির উপায় সম্পর্কেও দুই মতের মধ্যে ভিন্নতা দেখা যায়। সনাতন হিন্দু ধর্মের মতো বুদ্ধও বিশ্বাস করতেন জীবন মানেই যন্ত্রণা। এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে জন্মান্তরের অভিশাপ থেকে মুক্তি। তবে এ মুক্তির উপায় হিসেবে দেবতাদের পুজার পরিবর্তে তিনি ব্যক্তির আত্মশুদ্ধিতাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। মানুষ নিজের চেষ্টা ও সাধনার ধারাই এ চক্র থেকে মুক্তি পেতে পারে।

এ চেষ্টার চরম ও পরম পর্যায় হচ্ছে মানুষের ইচ্ছার দমন। যে মানুষ তার ইচ্ছাকে পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বা দমন করতে কেবলমাত্র সেই এই জাগতিক কষ্টের উর্ধ্বে আরোহন করতে পারবে এবং জন্মের এ যাতনা থেকে মুক্তি পাবে। তবে প্রচলিত ধর্মমতগুলোর পরস্পর বিরোধী বক্তব্য এবং পরস্পরের বিরোধীতা মনের সংশয়কে দুর্বল করার ক্ষেত্রে সবসময়ই প্রতিবন্ধকের ভূমিকা পালন করে। বরং ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বা নেতাদের আচরণে এ সংশয় থেকে যায় এবং ক্রমান্বয়ে আরো বৃদ্ধি পায়। সত্যিই কি মৃত্যুর পর কোন জীবন আছে? প্রশ্নটা অবিরত মস্তিস্কে ঘোরপাক খায়।

ধর্মীয় মতগুলোর প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে উত্তর খুঁজতে ঝুকি বিজ্ঞানের দিকে। কিন্তু বিজ্ঞানেও এ সম্পর্কে স্বতঃসিদ্ধ কোন সিদ্ধান্ত বা মতামত নেই। তবে একজন আশবাদী মানুষ হিসেবে সবসময়ই বিশ্বাস করি বিজ্ঞান কোন না কোনদিন এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর ঠিকই নিশ্চিত করবে। কিন্তু, ধর্মগুরুরা কি সেই সত্যকে মেনে নিবেন? ভবিষ্যতের কাছে প্রশ্ন থাকল।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।