শিরদাঁড়া নেই, বহু শরীরেই নিজেদের মানাতে মানাতে.......
ঈদে বাড়ি এসে বিপাকে পড়লাম। অবশ্য এ এমন ধরনের বিপাক যে পাকে সবাই পড়তে চায়। হিন্দুদের সাত পাকেঁ বাধা পড়ার মতই ব্যাপার।
মা আমার জন্য মেয়ে দেখেছেন। মেয়ে সোমত্ত হলে মা-বাবাদের চুল যেমন দুশ্চিন্তায় সাদা হয়ে যেতে থাকে তেমনি ছেলে বিবাহ যুগ্যি হলে পুলকে বাবা-মায়ের চুল নতুন করে গজাতে থাকে।
আর সেই ছেলে যদি ঢাকা মেডিকেলে পড়ে তাহলে তো কথাই নেই!
গত ঈদে অর্থাৎ রোজার ঈদে মেয়ের দুজন নিকট সম্পর্কীয় আত্মীয় আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে দেখে গেছেন। এবং তাদের মেয়েকে আমার সাথে গাটছড়া বাঁধার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। ফলশ্র“তিতে আমার গার্জিয়ানদ্বয় অর্থাৎ আমার মা ও বড় ভাইকে নিয়ে তাদের অতীব সুন্দরী ,কাচা হলুদ রঙা ফর্সা মেয়েকে দেখিয়ে নিয়ে এসেছেন। সুন্দরী মেয়ে পছন্দ হওয়ারই কথা তারপর তাদের পণের পাল্লাও বেশ ভারী।
এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি, আমাদের অঞ্চলে চিংড়ি চাষের কারণে কতিপয় বুদ্ধিমান লোক সাধারণ গরীব ধান-চাষীদের জমি ইজারা নিয়ে চিংড়ি চাষ করে আঙুল ফুলে কলাগাছ নয় একেবারে তালগাছ বনে গেছে।
আমার হবু (!) শ্বশুর এই বিরল প্রজাতির দু®প্রাপ্য সদস্য।
এই বিরল প্রজাতির ধনাঢ্য সদস্যদের মধ্যে একটা অলিখিত গোপন প্রতিযোগীতা আছে। জামাই প্রতিযোগীতা। নিজের ছেলেরা ক অর গোমাংস থাকলেও তা নিয়ে তাদের কারো মাথা ব্যথা নেই। কার জামাই কত বড় চাকরি করে ,কার জামাই ডাক্তার ,কার জামাই ইঞ্জিনিয়ার ,কার জামাই জজ-ব্যরিষ্টার ,কার জামাই সচিবালয়ে চাকরি করে তাই নিয়ে এ বিরল প্রজাতির ভাবনার অন্ত নেই।
নিজের জামাইকে যে যত বড় দেখাতে পারে সে সমাজে তত সম্মান লাভ করে। নিজের ছেলেদের বেলায় লবডংকা।
ঈদের আগের দিন রাতে মা যখন বিয়ের প্রসংগ তুললেন তখন পাশে উপবিষ্ট পিতার অবর্তমানে আমার বর্তমান অভিভাবক বড় ভাই ও ভাবী। বড় ভাইও আমার মত ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসেছে। সে সরকারী চাকরি করে এবং আমার পড়াশুনার খরচ বহন করে।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো ,বিয়ের প্রস্তাব এসেছে বড় ভাইয়ের শ্বশুরকুলের আত্মীয়ের মধ্য থেকে। যে কারণে বড় ভাইয়ের আগ্রহটা বেশী। তবে তার স্বভাব অনুযায়ী সে এ প্রসংগে কথা বলছে খুবই কম।
বড় ভাইয়ের কারণে সরাসরি না বলতে পেরে আমি মায়ের উপর ঝাঝ দেখালাম ‘আমার এখনও পড়া শেষ হয়নি। এর মধ্যে বিয়ের কথা আসছে কেন?’
‘রেজাল্ট ভাল না হলে বিদেশের একটা স্কলারশীপ পাওয়া অসম্ভব।
’ আমি জানালাম।
‘সেই ব্যবস্থাই তো হচ্ছে’ আমার কম কথার বড় ভাই একটা ছোট বাক্য বলে থেমে গেল যেন বাকীটা আমি হাতগুনে বুঝে ফেলব।
বাক্যের বাকীটা মা শেষ করলেন ‘ তোর বিদেশ যাওয়ার সব খরচÑখরচা হীরার বাপই দেবে তাই সে যে কয় লাখ টাকা লাগুক। ওদের একমাত্র জামাইকে ওরা বিদেশ ফেরত ডাক্তার বানাবে এটাই ওদের ইচ্ছে। ’ মা দম নেয়ার জন্য থামলেন।
ভাবী ছিল রান্নাঘরে। শুধু ঈদের কদিন এসে মাকে সাহায্য করে বলে তার বাড়াবাড়িটা একটু বেশী। মাকে রান্নাঘরের কোন কাজে হাত দিতে দেয় না।
ভাবী আমাদের সবার জন্য দুমিনিটের ম্যাগী নুডুলস দশমিনিটে তৈরী করে নিয়ে এসে আমার হাতে দিতে দিতে বলল ‘তোমার মাথা খারাপ করে দেয়ার জন্য হীরার একবার দর্শনই যথেষ্ট। ’
‘ যে জিনিস দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যায় তা না দেখাই ভাল।
কি দরকার শুধু শুৃধু মাথাটা খারাপ করার। ’ আমি হাসতে হাসতে বললাম। ‘তাছাড়া তুমি তো জানোই ভাবী উল্লুকের গলায় হীরার মালা শোভা পায় না। ’ কেউ হাসছে না দেখে আমি হাসি থামালাম।
‘ তোমাকে যে উল্লুক ভাবে সে নিজেই উল্লুক।
’ ভাবী পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়।
‘ আমি নিজেকেই নিজে উল্লুক ভাবি। ’
বড় ভাই কি মনে করে , সম্ভবত সে থাকলে মা ভাবী ও আমি খোলাখুলি ভাবে ঐ মেয়ের ব্যাপারে আলাপ করতে পারব না বিবেচনা করে অন্ধকার রাতে তিন ব্যাটারীর টর্চ লাইট হাতে নিয়ে ‘মা আমি একটু বাজারের দিকে যাচ্ছি ’ বলে বেরিয়ে পড়ে।
মা ‘তাড়াতাড়ি ফিরিস ,বেশী রাত করিস না ,তুই আসলে সবাই খেতে বসব ’বলে বড়ভাইকে তাগিদ দেয়।
ভাবী আমার চেয়ে মাত্র কয়েক বছরের বড় ।
বিয়েও হয়েছে বছর দুয়েক। । তাছাড়া সে থাকে ভাইয়ের সাথে খুলনায়। আমি ঢাকায়। ঈদ এবং অন্যান্য পারিবারিক অনুষ্ঠানেই শুধু আমাদের দেখা হয়।
এজন্য আমাদের মধ্যের জড়তা কাটেনি।
ভাবী আমার থেকে একটু দুরত্ব রেখে মায়ের পাশ ঘেষে বসে।
আমি ভাবীর দিকে তাকিয়ে কৌতুহল বশে জিজ্ঞেস করি ‘তোমার হীরা না মতি লম্বা কেমন?’ আমি নিজে লম্বা বলে মেয়েদের এই ব্যাপারটাই প্রথমে দেখি।
‘সুন্দরী মেয়েরা সাধারণত খাটোই হয়। তবে দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই।
হীরা যথেষ্ট লম্বা। কি বলেন মা ? আপনি তো দেখেছেন?’ সে মায়ের দিকে তাকায়।
মা হয়তো আমার পড়াশুনার তি হবে কিনা এদিকটা খতিয়ে দেখছিলেন। এজন্য থতমত খেয়ে বললেন ‘হ্যা হ্যা বেশ লম্বা। আমার চেয়েও লম্বা।
দেখতেও খুব সুন্দর। গায়ের রঙ ফর্সা। তোর সাথে মানাবে বেশ। ’ মা যে হবু ছোট বৌমার ব্যাপারে খুব খুশী তা মায়ের চোখমুখের আলোর আভা দেখে বেশ বোঝা যায়।
ভাবী উঠতে ঊঠতে বলে ‘ তোমার তো গাড়ির খুব শখ।
সে ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। আমিই করে দেব। তবে শর্ত একটাই। মাঝে মধ্যে আমাকে গাড়িতে করে ঢাকা শহর ঘুরিয়ে দেখাতে হবে। ’
তাহলে ব্যাপার এটাই! ভাবীই ঘটকালির দায়িত্বটা পালন করছে।
ঈদের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমার একটা অলিখিত নিয়ম আছে। যুথিকে ঈদ মোবারক জানানো। অবশ্য মনে মনে। স্বল্পভাষী যুথির সাথে অল্প-বিস্তর কথা হলেও ওকে এ ব্যাপারটা জানানো হয়নি। দেখি এবার ঈদের পর ঢাকায় যেয়ে ওকে বলতে হবে।
তবে আমার মনে হয় কিছু কিছু জিনিস না বলাই ভাল। নিজের জন্য কিছু রাখতে হয়। তো সে প্রিয়তমা হলেও। আর এবার রূপবতী রাজকন্যে হীরার চিন্তা যেভাবে আছন্ন করে আছে তাতে শ্যামলা অন্যের আশ্রিতা যুথি পাত্তা পাবে কিনা সন্দেহ। মুখে যতই বড় বড় কথা যৌতুক বিরোধী বুলি আওড়াই না কেন মনের কোনে লটারীর মতই আসা সম্পদের লোভ কার না আছে! যৌতুক বিরোধী বাতচিত তো অন্যের জন্য।
নিজের উপর অহেতুক কেন ওসব প্রয়োগ করা। তাছাড়া তারা তো আর যৌতুক দিচ্ছে না। তাদের একমাত্র মেয়ে-জামাইকে তারা উপঢৌকন দিচ্ছে। জামাইকে দেয়া মানেই তো মেয়েকে দেয়া। জামাইকে বিদেশ থেকে ডাক্তারীর উচ্চ ডিগ্রী আনানো তো মেয়ের জন্যই ইনভেস্টমেন্ট।
এতণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন যুথি আমার প্রেমিকা। আমার নিধর্নী প্রেমিকা। অবশ্য সব প্রেমিকের কাছেই তাদের প্রেমিকারা ভালবাসার সম্পদে ধনী। কিন্তু হীরার প্রসঙ্গ আসার পর থেকে কেন জানি ভালবাসার সম্পদে মন ভরছে না। ভালবাসার সম্পদের সাথে সাথে অর্থসম্পদও যে জরুরী তা যেন একটু একটু করে বুঝতে পারছি।
ঢাকায় জীবনযাত্রা এত ব্যয়বহুল যে প্রতিমাসে বড়ভাইয়ের পাঠানো আড়াই হাজার টাকায় আমার কিছুই হয় না ;যদিও থাকি হলে এবং অন্যান্যদের মত সিগারেট খাই না।
সে কারণেই মাত্র একটা টিউশনি করাই যেখানে আমার বন্ধুবান্ধবেরা দুটোর নিচে করায়ই না। আর যুথির সাথে প্রেমটা আমার হয়েছে এই টিউশনি করাতে গিয়েই।
আপনারা হয়তো ভাবছেন যে যুথি আমার ছাত্রী। ব্যাপারটা একটু অন্যরকম।
যুথি আমার কাস টু শর্মির এর ছাত্রীর একমাত্র ছোটখালা। সংসারে একমাত্র উপার্জনম ব্যক্তি পিতা মারা যাওয়ায় এবং কোন বড় ভাই না থাকায় সে তার বোনের সংসারে থাকে এবং জগু বাবুর পাঠশালা অর্থাৎ জগন্নাথ কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স পড়ে। সে অবশ্য এর আগে তার মা এবং ছোট ভাইয়ের সাথে মামার বাড়িতেই থাকত কিন্তু সেখানে মামাত ভাইদের অসদাচরণ এবং পরবর্তীতে জগন্নাথে চান্স পাওয়ায় এবং স্বল্পবেতনে অগ্রণী ব্যাংকে চাকরিরত তার একমাত্র দুলাভাই মানুষটাও ভাল হওয়ায় সে বড়বোনের সাথে ঢাকায় থাকছে।
ছাত্রী পড়াতে যেয়ে ছাত্রীর খালার সাথে প্রেম হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। তবে যুথিকে ছাত্রীর বাড়িতে বার কয়েক দেখলেও ওকে দেখামাত্র প্রেম এমন কোন অনুভুতি আমার মধ্যে আসেনি।
ছিপছিপ গড়নের শ্যামলা মেয়েটিকে দেখে হৃদয়ে হুলস্থুল পড়ে যাওয়ার মত কোন অবস্থা আমার হয়নি। বিশেষত যেখানে আমাদের সংখ্যা গরিষ্ট মেয়ে মেডিকেলে ফর্সা মেয়ের সংখ্যা নেহাত কম নয়। আর আমাদের দেশে ফর্সা মেয়েকেই সুন্দরী বিবেচনা করা হয়।
একদিন নীলেেত মেডিকেলের বই কিনতে যেয়ে দেখি অন্য পাশের দোকানে দাড়িয়ে যুথি বেশ মোটা সাইজের একটা বই দরদাম করছে। ও আমাকে খেয়াল করেনি।
আর আগ বাড়িয়ে ওর সাথে কথা বলার মত কোন আগ্রহ আমার নেই। তবে দোকানদারের চড়া গলায় শ্লেষ্মাতক কথাবার্তা এবং যুথির মিনমিনে কন্ঠস্বর আমাকে আগ্রহী করে তোলে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।