আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে...



আবুল হাসানের প্রথম কবিতার বই 'রাজা যায় রাজা আসে'র প্রথম কবিতাটির নাম 'আবুল হাসান'! নিজের নামে লেখা কবিতা! এ কি নিজেকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার ইচ্ছে? নাকি আত্নপরিচয় খুঁজে ফেরা? নাকি নিজের সম্বন্ধে নিজের অনুভূতিমালা নিজেকেই জানতে দেয়া? কবিতা মানে কি নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলা, নাকি পাঠকের সঙ্গে কবির কথা বলা? যেটাই হোক না কেন, নিজের সম্বন্ধে যে কথাগুলো বললেন তিনি, সেগুলো নিঃসন্দেহে কৌতূহলোদ্দীপক... কবিতাটি শুরু হয় এভাবে : 'সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র, মায়াবী করুণ' নিজেকে 'পাথর' হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন বটে, কিন্তু একইসঙ্গে জানিয়ে দিচ্ছেন, এ পাথর যেমন-তেমন পাথর নয়; এ পাথর 'কেবলি লাবণ্য ধরে'! শুধু লাবণ্য ধরলেও না হয় কথা ছিলো, লাবণ্য-ধরা পাথর জগতে অনেক আছে; কিন্তু ওখানেই থামছেন না তিনি, টানা বলে যাচ্ছেন- 'উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র, মায়াবী করুণ'! উজ্জ্বলতার ব্যাপারটা বোঝা যায়, হিরকখণ্ডও উজ্জ্বলতা ধরা পাথরই, কিন্তু 'আর্দ্র মায়াবী করুণ' উজ্জ্বলতা! কেমন সেটি? শেষ নয় সেখানেই, পরের পঙক্তিতেই বলছেন তিনি- 'এটা সেই পাথর নাকি? এটা তাই?' সংশয় তৈরি হয়ে গেল! অমন একটা মনকাড়া পাথরের কথা বলে আবার আত্নমগ্ন কবি যেন নিজের কাছেই জানতে চাইছেন- 'এটা সেই পাথর নাকি?' কবি নিজেই যেখানে সংশয়ী হয়ে উঠেছেন, সেখানে পাঠকের আর কি উপায় থাকে, পরের পঙক্তির দিকে ধাবিত হওয়া ছাড়া? এবং আমরা দেখি, বলছেন তিনি- 'এটা কি পাথর নাকি কোনো নদী? উপগ্রহ? কোনো রাজা? পৃথিবীর তিনভাগ জলের সমান কারো কান্না ভেজা চোখ? মহাকাশে ছড়ানো ছয়টি তারা? তীব্র তীক্ষ্ণ তমোহর কী অর্থ বহন করে এইসব মিলিত অক্ষর?' এইবার বেছে নেবার অপশন বাড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি- পাথর, নদী, উপগ্রহ, রাজা, 'পৃথিবীর তিনভাগ জলের সমান কারো কান্না ভেজা চোখ' অথবা 'মহাকাশে ছড়ানো ছয়টি তারা'! কিন্তু এই অপশন তিনি কাকে দিচ্ছেন? নিজেকে, নাকি পাঠককে? নাকি নিজের পরিচয় খুঁজছেন এইসবকিছুর মধ্যে? কি-ইবা মানে এই প্যারার ওই শেষ দেড়-লাইনের?-- 'তীব্র তীক্ষ্ণ তমোহর/ কী অর্থ বহন করে এইসব মিলিত অক্ষর?' নাকি এগুলোও ওই অপশনই? তবে কি আত্নপরিচয় খুঁজে পাওয়া যাবে 'এইসব মিলিত অক্ষরের' মধ্যে? না, এখানেই শেষ হয়নি পরিচয় খোঁজা বা পরিচয় দেয়ার আয়োজন। কবি এগিয়ে যান, আমরাও এগোই পরের পঙক্তিগুলো নিয়ে- 'আমি বহুদিন একা একা প্রশ্ন করে দেখেছি নিজেকে, যারা খুব হৃদয়ের কাছাকাছি থাকে, যারা এ ঘরে ও ঘরে যায় সময়ের সাহসী সন্তান যারা সভ্যতার সুন্দর প্রহরী তারা কেউ কেউ আমাকে বলেছে- এটা তোর জন্মদাতা জনকের জীবনের রুগ্ন রূপান্তর, একটি নামের মধ্যে নিজেরি বিস্তার ধরে রাখা, তুই যার অনিচ্ছুক দাস!' নিজেকে প্রশ্ন করে, বা অন্যকে জিজ্ঞেস করে তিনি জেনেছেন (এই অন্যরা আবার যে-সে নয়, তাদের কেউ কেউ 'সময়ের সাহসী সন্তান যারা সভ্যতার সুন্দর প্রহরী', কেউ বা 'খুব হৃদয়ের কাছাকাছি থাকে'), এটা তার বাবার জীবনেরই 'রুগ্ন রূপান্তর!' এতক্ষণ ধরে আত্নপরিচয় খোঁজার যে মনোমুগ্ধকর-বিশাল আয়োজন ছিলো, এইখানে এসে যেন সেটি করুণ বেদনায় ভরে ওঠে! আর যা-ই হোক, কোনো জীবনের 'রুগ্ন রূপান্তর' হিসেবে নিজের জীবনকে কেউ দেখতে চায় বলে মনে হয় না! সেটা বোঝাও যায় শেষ লাইনটি পড়ে- 'তুই যার অনিচ্ছুক দাস!' কিন্তু পরিচয়পর্ব তবু শেষ হয় না। এর পরের পঙক্তিগুলোতে আবার নিজেকে খোঁজেন তিনি এইভাবে- 'হয়তো যুদ্ধের নাম, জোৎস্নায় দুরন্ত চাঁদে ছুঁয়ে যাওয়া, নীল দীর্ঘশ্বাস কোনো মানুষের! সত্যিই কি মানুষের?' এবার যুদ্ধ, জোৎস্নায়, নীল চাঁদে, কোনো মানুষের নীল দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে চলে নিজের পরিচয় খুঁজে ফেরা! কিন্তু এবারও শেষ লাইনে ছুঁড়ে দেন মর্মান্তিক প্রশ্ন- 'সত্যিই কি মানুষের?' এবং এগিয়ে যান কবিতার শেষ প্যারায়- 'তবে কি সে মানুষের সাথে সম্পর্কিত ছিল, কোনোদিন ভালোবেসেছিল সেও যুবতীর বামহাতে পাঁচটি আঙ্গুল? ভালোবেসেছিল ফুল, মোমবাতি, শিরস্ত্রাণ, আলোর ইশকুল?' শেষে এসে সংশয়টা চূড়ান্তে পৌঁছে। মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক কি ছিলো কখনো? সে কি ভালোবেসেছিলো 'যুবতীর বামহাতে পাঁচটি আঙ্গুল' বা 'ফুল, মোমবাতি, শিরস্ত্রাণ, আলোর ইশকুল?' প্রশ্নেই শেষ হয় পরিচয় খোঁজার পালা, উত্তর পাওয়া যায় না! হয়তো এইসবকিছুর মধ্যেই তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে, অথবা কোনোকিছুর মধ্যেই নয়- এমন এক বিমূঢ় সংশয় রেখে কবিতা শেষ করে দেন আবুল হাসান। আর আমরা বুঝে যাই- এ কেবল কবির নিজের পরিচয় খোঁজার আয়োজনই নয়, এ আসলে আমাদেরকেও মুখোমুখি করে দিয়েছে এইসব চিরন্তন প্রশ্নের, সেইসব প্রশ্ন নিয়ে আমরা অতপর ঘুরে বেড়াই, উত্তর মেলে না, উত্তর মেলে না... [এই লেখাটি লিখতে গিয়ে একজনের কথা খুব মনে পড়ছিলো, যাকে আমার মনে হয় সেই পাথরের মতো, যে কেবলি লাবণ্য ধরে! খুব ভালো লাগতো যদি তাকে উৎসর্গ করতে পারতাম এটি, কিন্তু গত রাতেই সে আমার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে-- আমি যেন যেখানে-সেখানে তার নাম না নিই! জানি, এই লেখা তার চোখে পড়বে, তাকে বলি-- উৎসর্গপত্র রচিত হয়নি বটে, তবু এটা 'আপনার' জন্যই!]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।