বিদেশে কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষিত শ্রমশক্তি
ফকির ইলিয়াস
=======================================
তীব্রতর মন্দাবস্থা কাঁপিয়ে তুলেছে বিশ্ব অর্থনীতির ভিত। এই ঢেউ লেগেছে প্রবাসে বাংলাদেশের জনশক্তির ওপরও। মালয়েশিয়া থেকে পঞ্চান্ন হাজার বাংলাদেশী শ্রমশক্তি ফেরৎ পাঠানোর ঘোষণা এসেছে। বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। সিঙ্গাপুর থেকেও শ্রমশক্তি ফেরৎ পাঠানোর কথা জানা গেছে।
এর আগে গত বছর কুয়েত, সৌদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী শ্রমিক ফেরৎ পাঠানো হয়েছিল।
মালয়েশিয়া ইতিমধ্যে তাদের বরাদ্দকৃত বেশ কিছু ভিসাও বাতিল করেছে। ফলে যারা লাখ লাখ টাকা খরচ করে সে দেশের কর্ম ভিসা জোগাড় করেছিলেন তারা মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন। এ বিষয়ে একটি কথা খোলাসা হওয়া দরকার মনে করি। যে নতুন ভিসাগুলো বরাদ্দ করা হয়েছিল তা কেন বাতিল করা হবে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের একটি ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন।
এই ভিসা গ্রহণ করে যারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো, তা কিভাবে পূরণ করা হবে তাও নিষ্পত্তি হওয়া দরকার মনে করি।
মালয়েশিয়া ভিসা বাতিল করবে, কিংবা এত বেশি পরিমাণ শ্রমিক যে ফেরৎ পাঠাবে, তা ঢাকাস্থ মালয়েশিয়ান রাষ্ট্রদূতের না জানার কথা নয়। তিনি তা অগ্রিম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিলেন কি? তা জেনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র কিংবা শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয় মালয়েশিয়ার শ্রম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন কি? এসব বিষয় খোলাসা হওয়া দরকার। ভুক্তভোগীদের জানানো দরকার।
মনে রাখতে হবে, ৫৫ হাজার শ্রমিক ফেরৎ আসা মানে ৫৫ হাজার পরিবারে অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়া।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির একটি প্রতিক্রিয়া টিভিতে দেখলাম। তিনি বলেছেন, এতে ‘প্যানিক’-এর কিছু নেই। কথাটি আমার মোটেও পছন্দ হয়নি। প্যানিকের কিছু নেই- সেটা বললেই যে কেউ প্যানিক আক্রান্ত হবে না, তেমনটি কিন্তু নয়। কারণ আক্রান্ত ৫৫ হাজার পরিবার এখন চোখে সর্ষে ফুল দেখছে।
যে সব তরুণ ফিরে এসেছে তাদের কয়েকজন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে যে বক্তব্য দিয়েছে, তা জাতীয় লজ্জার বিষয়। কেউ কেউ বলেছে ‘আত্মহত্যা ছাড়া আমাদের কোনো পথ নেই’ কিংবা ‘এখন সন্ত্রাসী হওয়া ছাড়া আর কিইবা করার আছে!’
যারা ভিটেমাটি বিক্রি করে, শেষ সম্বল হারিয়ে তিন-চার লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে শ্রম দিতে যায় তারা জানে খালি হাতে ফিরে আসার যাতনা কেমন! কি জবাব দেবে তারা স্ত্রী-সন্তানদের? কিভাবে বাঁচবে সামাজিক মান-সম্মান নিয়ে? এই দহন সহজে সহ্য করা যায় না- যাবে না।
বাংলাদেশে জনশক্তি উন্নয়ন ব্যুরো রয়েছে। রয়েছে একটি মন্ত্রণালয়ও। বিদেশে লোক পাঠাতে তারা যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে কি না সে প্রশ্নটি আসছে আবারো।
কারণ আমরা দীর্ঘদিন থেকেই দেখছি সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী একটি ভিসা আনতে খরচ লাখ-সোয়া লাখ টাকা কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো কম হওয়ার পরও বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সি, দালাল, মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়াদের হাত পেরিয়ে সেই ভিসার মূল্য দাঁড়াচ্ছে তিন-চার লাখ টাকা। এটা কেন হচ্ছে? সরকার এ বিষয়ে নির্বিকার ভূমিকা পালন করছে কেন? এই জটিলতা এবং মুনাফাখোরির অবসান হওয়া দরকার মনে করি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, লোক ফেরৎ আসছে, আমরা নতুন শ্রম বাজারে লোক পাঠাবার আপ্রাণ চেষ্টাও করছি। এই প্রসঙ্গেও যে কথাটি বলতে হয়, এই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বিষয়টি কিছুটা হয়ত পুষিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু যে পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তার পরিণতি কি? দু’বছরের এগ্রিমেন্টে বিদেশে চাকরিতে গিয়ে মাত্র ছয় মাস পর যারা ফেরৎ আসছে তাদের ক্ষতি পোষাবে কে? কিভাবে পোষাবে?
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই বিদেশে সাধারণ শ্রমিকের চাহিদা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে।
‘ট্রেড এন্ড টেকনেশিয়ান’ নির্ভর বর্তমান আধুনিক বিশ্বে নাপিত, ধোপা থেকে শুরু করে প্রকৌশলী-পরিকল্পক সবাইকেই একাডেমিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। ‘দ্য বারবার ইনস্টিটিউট অব নিউইয়র্ক, কিংবা ‘রোজমেরী মেনিকিউর একাডেমী ইন নিউইয়র্ক’-নামের দুটি প্রশিক্ষণ সংস্থার নাম এখানে উল্লেখ করতে চাই। এগুলোতে অত্যাধুনিক নাপিতের কাজ কিংবা হাতের নখ, পায়ের নখের যত্ন করার কাজগুলো খুবই যত্নের সঙ্গে শিখানো হয়। আর ফ্যাশন ডিজাইনারদের জন্য ‘দ্য ফ্যাশন ইনস্টিটিউট অব নিউইয়র্কের (এফআইটি) নাম তো বিশ্বনন্দিত। সুনাম রয়েছে-‘দ্য বিউটিশিয়ান পার্লার অব নিউইয়র্ক’-এরও।
বাংলাদেশের শ্রম শক্তিকে বিশ্বমানের সঙ্গে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি সম্ভব খুব দ্রুতই। এজন্য সরকারি কিংবা ব্যক্তিগত উদ্যোগে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। রাজমিন্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, ইলেকট্রিশিয়ান, প্লামবার, ফিটার, ওয়েল্ডার, হাউসকিপার, গার্ডেনার, সার্ভেয়ার, অটো রিপেয়ার মেকানিক ,সহ বিভিন্ন পেশার স্বল্পমেয়াদি কোর্সের মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিক গড়ে তোলা যেতে পারে।
এর সঙ্গে ভাষা শিক্ষার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেয়া দরকার। মনে রাখতে হবে মধ্যপ্রাচ্যে চাকরির জন্য আরবী ভাষা শেখা যতটা প্রয়োজন নয়, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন ইংরেজি ভাষার দক্ষতা। কারণ সে সব দেশের বিভিন্ন সেক্টরে যেসব সুপারভাইজার, প্রকৌশলী, ম্যনেজাররা কাজ করেন এরা সবাই ইংরেজিতে পারদর্শী। ফলে ইংরেজি ভাষায় সহজেই তাদের সঙ্গে কম্যুনিকেট করা সম্ভব।
পূর্ব ইউরোপ, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, রাশিয়া অঞ্চলের বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশে নতুন কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ সরকারকে ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখতে হবে। আর এসব দেশে প্রশিক্ষিত, দক্ষ শ্রমিকদের চাহিদাই থাকবে বেশি।
বর্তমান চলমান বিশ্বে ফার্মাসিস্ট, ফার্মেসি টেকনিশিয়ান, গার্মেন্টস অপারেটর, ফ্যাশন ডিজাইনার, বিউটিশিয়ান, নার্স, গ্রাফিক্স ডিজাইনার, আইটি টেকনিশিয়ান বাবুর্চি, এরকম আরো বহু পদের চাকরির প্রচুর চাহিদা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে একজন দক্ষ ফার্মাসিস্ট বছরে প্রায় লাখ ডলার, একজন দক্ষ নার্স বছরে প্রায় সত্তর-আশি হাজার ডলার আয় করতে পারেন। এসব বিষয় ভাবার অবকাশ রয়েছে বৈকি!
বিদেশে চাকরির প্রথম ও প্রধান শর্ত হচ্ছে- দক্ষ, স্মার্ট এবং অধ্যবসায়ী শ্রমশক্তি।
আর সেজন্য বিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের গুরুত্বও রয়েছে সমানভাবে। বিদেশে চাকরিপ্রার্থী হওয়ার আগে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে কর্মঠ, আধুনিক মানুষ হিসেবে। বাংলাদেশের জনশক্তির সততা, কর্মনিষ্ঠা এবং একাগ্রতা সবসময়ই প্রশংসিত হচ্ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে প্রশিক্ষিত শ্রমশক্তি দেশের উন্নয়নে, জাতির উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারবেন, সন্দেহ নেই।
-------------------------------------------------------------------
দৈনিক ডেসটিনি।
ঢাকা । ১৭ মার্চ ২০০৯ মংগলবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।