প্রাণবাজি রেখে সব করেছি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে
পিলখানায় বিদ্রোহ শুরু হলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিডিআর জওয়ানদের সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে সমঝোতা করতে পাঠানো হয় স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গির কবির নানক ও হুইপ মির্জা আজমকে। বেপরোয়া গোলাগুলির মধ্যে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে তারা বিদ্রোহী জওয়ানদের সঙ্গে আলোচনার পথ সুগম করেছিলেন।
গতকাল আমাদের সময়’র সঙ্গে আলাপকালে জাহাঙ্গির কবির নানক জানান, তৌহিদ নামে কাউকে চিনি না, কোনো দিন দেখিনি। এই নামে শুধু ছাত্র জীবন নয়, কোনো দিনই কোনো বন্ধু ছিলো না। বিদ্রোহীদের নেতা ডিএডি তৌহিদকে বন্ধু বলে দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় প্রকাশিত রিপোর্ট নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেন, শুরু থেকেই নানারকম গুজব ছড়ানো হচ্ছে।
আমরা কোনো কিছুই গোপন রেখে করিনি- যা করেছি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই করেছি। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজন আমাদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন।
গতকাল দুপুরে এই নিয়ে দীর্ঘ আলাপ হয় নানক ও আজমের সঙ্গে। তারা জানান, বিদ্রোহী ১৪ জওয়ান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে তাদের সঙ্গে যেতে রাজি হলে তাদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন যমুনায় যান। এসময় কোনো জওয়ানের নেইমপ্লেট ছিলো না।
তারা ছিলো চরম উত্তেজিত। কেউ তাদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হয়নি। এরমধ্যে একজন নিজেকে বিডিআরের অফিসার পরিচয় দেয় এবং তাকে কিছুটা শান্তশিষ্ট মনে হয়। তাদের সঙ্গে যাতে আমাদের যোগাযোগের সুযোগ থাকে সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে বের হওয়ার সময় তার মোবাইল নম্বর ও নাম জানাতে চাই। তখন সে তার নাম তৌহিদ ও মোবাইল ফোন নম্বর দেয়।
এর পর থেকে তার সঙ্গে বারবার আমরা ফোনে যোগাযোগ করেছি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে। তার বাড়ি যে ঝালকাঠি তা সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পারি।
নানক-আজম জানান, আমাদের সঙ্গে আম্বালা ইন রেস্টুরেন্টে যতবার বৈঠক হয়েছে ততবারই সামরিক গোয়েন্দা মহাপরিচালকসহ একাধিক শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা, র্যাবের ডিজি, পুলিশের আইজিসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। নানক জানান, প্রথম বৈঠকেই প্রধানমন্ত্রী বারবার সেনা কর্মকর্তাদের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন, তারা বলেছে, সবাই জিম্মি আছে, এর বেশি কিছু তারা বলতে চায়নি। তারা বলে, তাদের জওয়ানকে লাথি মেরে বেঁধে কোয়ার্টার গার্ডে রাখা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, হত্যার গুজব শুনছি। তোমাদের একটা লাথি মারার জন্য তোমরা হত্যা করবে? তারা কোনো রিপ্লাই দেয়নি। তারা নানান শর্ত দিতে থাকে, বলে সাধারণ ক্ষমার লিখিত দিতে হবে।
নানক বলেন, বিডিআর জওয়ানদের নৃশংসতায় সারাদেশের মানুষ শোকাহত। বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এমন কোনো তৎপরতা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়ে তিনি তদন্ত কাজে সহযোগিতা করতে সকল মহলকে আহ্বান জানান।
সমঝোতা প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হওয়ার বর্ণনা দিয়ে নানক জানান, প্রতিদিনের মতো সকাল সোয়া ৯টায় তিনি সচিবালয়ের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে রওয়ানা দেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অতিক্রম করার সময় ধানমন্ডি এলাকার এক দলীয় কর্মি ফোন করে জানায়, পিলখানায় প্রচ গোলাগুলি হচ্ছে। এখবর পেয়ে সচিবালয়ে প্রবেশ না করে তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যান। এরপর সেখানে একে একে যান মন্ত্রিসভার সদস্যসহ দলের একাধিক নেতা। সকাল আনুমানিক ১১টায় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেন তাদেরকে ঘটনাস্থলে যেতে।
তিনি বলেন, তখন সেনাবাহিনীও ঘটনাস্থলে পৌঁছতে শুরু করেছে। আমরা সায়েন্স ল্যাবরটরির সামনে নেমে হেঁটে এগোতে শুরু করলাম। দলের অফিসে ফোন করে বল্লাম একটা হ্যান্ডমাইক পাঠাতে। এরআগেই পুলিশ হ্যান্ডমাইক নিয়ে এগিয়ে এলো। আমরা যখন এগোচ্ছি তখন মুহুর্মুহু গুলিতে মাইক ধরা পুলিশ সদস্য ভয়ে দৌড়ে চলে গেলো।
আমাদেরকেও সবাই পিছু টানছে। ঝিগাতলা যাওয়ার আগে স্ট্যান্ডাড চাটার্ড ব্যাংকের সামনে পৌঁছার পর পুলিশ মাইক আনলো। আমরা মাইকে আমাদের পরিচয় দিয়ে বিডিআর জওয়ানদের বারবার বলছিলাম, আলোচনা করতে প্রধানমন্ত্রী আমাদের পাঠিয়েছেন। মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজে তখন প্রকম্পিত এলাকা। একপর্যায়ে আমার ও আজমের ফোন নম্বর মাইকে ঘোষণা দিয়ে জওয়ানদেরকে এই নম্বরে ফোন করার অনুরোধ করলাম।
তখন একটা বিরক্তির অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলো। টেলিভিশন স্ক্রলে নম্বর দেখে দেশ বিদেশ থেকে অনবরত ফোন আসতে থাকে। প্রায় ঘণ্টা খানেক পরে আনুমানিক আড়াইটার দিকে এক জওয়ান ফোন করে আমাদের অকথ্য গালিগালাজ করে বলে, তোমরা কী আলাপ করবে, প্রধানমন্ত্রীকে আসতে বল্। এরপর একে একে পিলখানা থেকে ফোন আসতে থাকে। সবাই ছিলো খুবই উত্তেজিত।
আমরা তাদের বুঝাতে শুরু করলাম। ভয় ছিলো জিম্মি করে ফেলতে পারে। এসময় আমাদের সঙ্গে ছিলেন সামরিক গোয়েন্দা শীর্ষ কর্মকর্তারা, র্যাবের ডিজি, আইজিপি, পুলিশ কমিশনার।
যারা ফোন করছিলো তারা কেউ পরিচয় দিচ্ছে না। একপর্যায়ে ফোনে বললো কী আলোচনা করবেন-আসেন।
আমরা বল্লাম ভেতরে আসবো না। রাস্তার মাঝখানে বের হয়ে আসেন, গুলি বন্ধ করেন। তারা বলে বেরিয়ে আসবে না। আমরা বল্লাম, আমরা সাদা পতাকা নিয়ে আসবো, তোমরাও সাদা পতাকা নিয়ে আসো।
নানক বলেন, সবসময় একটা কথা মনে হয়েছে, ৫ বছর গণতন্ত্রের জন্য লড়াই সংগ্রাম, দুই বছর অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছি।
আজ শেখ হাসিনার গণতন্ত্রের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সংগ্রামে পিছু হটার সুযোগ নেই।
লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নানক ও আজম জানান, তারা সাদা পতাকা নিয়ে ৪ নম্বর গেইটের বাইরে গিয়ে দাঁড়াই। গেইটের ভেতর থেকে তখন আমাদের দিকে গান তাক করে আছে। শুধু আল্লাহর নাম নিয়েছি। দেখলাম ২০ থেকে ৩০ বছরের জওয়ানরা লাল সাদা ও সবুজ কাপড় মুখে বেঁধে আমাদের মা বাবা তুলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে বলছে, এখন আলোচনা করতে আসছো কেন।
বয়স্ক এক জওয়ান সমঝোতার কথা বললে কম বয়সের জওয়ানরা তার ওপর ক্ষেপে আক্রমণের চেষ্টা চালায়। এসময় ধানমন্ডির দিক থেকে এমপি ওয়ারাসাত হোসেন বেলাল ও মাহবুব আরা গিনি এমপি সাদা পতাকা হাতে নিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। দাবি কী, জানাতে চাইলে তারা আরো ক্ষেপে যায়। একপর্যায়ে আমরা তাদেরকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় যেতে প্রস্তাব দেই। গালিগালাজ করে তারা বলে আমরা যাবো কেন, প্রধানমন্ত্রী আসবে।
এসময় আমরা অনুরোধ করি বন্দুকের নল আমাদের দিক থেকে নামানোর জন্য। ভয় করছিলো কখন ট্রিগারে চাপ দেয়। তাদের আচরণ ছিলো চরম খারাপ, অসভ্য বর্বরের মতো অবিরাম গালিগালাজ করছিলো তারা।
নানক বলেন, প্রথম দিন আমরা একবারও ভেতরে যাওয়ার সুযোগ পাইনি। আর যে সশস্ত্র উত্তেজনা দেখেছি, তাতে ভেতরে যাওয়ার সাহস খুবই কঠিন।
পরদিন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে আম্বালা রেস্টুরেন্টে একের পর এক বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে জওয়ানরা হুমকি দিয়েছে, তারা মরার জন্যই যুদ্ধে নেমেছে। বিএসএফ’র সঙ্গে তারাই যুদ্ধ করে। তাদের ওপর শক্তি প্রয়োগ করা হলে তারা বিশ্ববিদ্যালয়, আজিমপুর, হাজারীবাগ ও ধানমন্ডি এলাকা উড়িয়ে দেবে। সারাদেশের ৬৫ হাজার বিডিআর জওয়ানের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়েছে।
সারাদেশে যুদ্ধ হবে।
২৬ ফেব্র“য়ারি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর পুরো পরিস্থিতি পাল্টে যায়। আওয়ামী লীগের শীর্ষ প্রতিনিধি দল আসেন।
তিনি বলেন, অস্ত্র সমর্পণ শেষ হলে আমরা ভেতরে প্রবেশ করি। পুরো পিলখানা জুড়ে মাইক দিয়ে ডেকে ডেকে জিম্মি ও লুকিয়ে থাকাদের উদ্ধার করি।
এসময়ই খুব কম সংখ্যক বিডিআর জওয়ান দেখে আমরা হতবাক হয়ে যাই। ডিজির বাসায় একটি মৃতদেহ ছাড়া আর কোথাও সেসময় কোনো মৃতদেহ দেখিনি। নানক জানান, পুরো রাত প্রধানমন্ত্রী এক মুহূর্তের জন্যও ঘুমাননি। কিছুক্ষণ পরপর ফোন দিয়ে পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজ নেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন।
মেজর মনিরকে উদ্ধারের বর্ণনা দিয়ে নানক-আজম বলেন, ঘটনার পর থেকেই ৫ নম্বর গেইট নাকি সবসময় খোলা ছিলো।
এই গেইট ও নিচু দেয়াল দিয়ে জওয়ানরা পালিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নানক জানান, শেষ মুহূর্তে বৃহস্পতিবার ১২টায় রেষ্টেুরেন্টে বৈঠকে জওয়ানদের ৫টি শর্ত দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, আপনারা ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করেছেন। আর মেনে নেয়া যায় না, আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে শক্তি প্রয়োগের কথা জানিয়ে জওয়ানদের বলেছিলেন, ৩০ মিনিটের মধ্যে সকল জিম্মিকে ছেড়ে দিতে হবে। ২টার মধ্যে অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে।
দুই শতাধিক সশস্ত্র পুলিশ ভেতরে গিয়ে অস্ত্র সংগ্রহ করবে। শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য বিডিআরকে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। যারা হত্যায় জড়িত, বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে তাদের শাস্তি হবে। কিন্তু তখনও আমরা বুঝতে পারিনি সুপরিকল্পিতভাবে এতো সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি প্রশ্ন রাখেন, কারা বিডিআরকে উস্কানি দিয়ে মিছিল করেছে, জওয়ানদের সঙ্গে করমর্দন ও হাততালি দিয়েছে এসব দেখা দরকার।
নানকের মেয়ের ফোন
জাহাঙ্গির কবির নানক যখন সাদা পতাকা নিয়ে মুহুর্মুহু গুলির মধ্যে পিলখানার গেইটে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে ফোন করেন তার প্রবাস ফেরত মেয়ে রাখি। মেয়েটি চিৎকার দিয়ে বলে বাবা তুমি ফিরে আসো। মরা দাদা দাদির (আমার বাবা মা) কসম দিয়ে বলছি, দোহাই বাবা ফিরে না আসলে আমার মরা মুখ দেখবে। মা (আমার স্ত্রী) অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমি তাদেরকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ করে বলি, দেশের জন্য যদি মরে যাই তবে তোমরা গর্ববোধ করবে।
এরপর অভিমান করে সারাদিন আমার পরিবারের কেউ আর ফোন করেনি।
আইজিপিকে প্রধানমন্ত্রীর সহানুভূতি
মেয়ের জামাইয়ের মৃত্যুতে আইজিপিকে সহানুভূতি জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ২৬ তারিখ রাতে উদ্ধার কার্য চালানোর সময় জিম্মি অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসেন আইজিপির মেয়ে। তখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে তার স্বামী নেই। রাত গভীর হলে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি জামাইকে খুঁজছিলেন আইজিপি।
একপর্যায়ে তিনি হতাশ হয়ে পড়লে তাকে বাসায় ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করেন নানক। তিনি তাতে রাজি হননি। বলেন, আপনাদের সঙ্গে থাকতেই আমার ভালো লাগছে। বাসায় গেলে মন খারাপ হবে। তখন নানক মোবাইল ফোনে প্রধানমন্ত্রীকে একথা জানালে প্রধানমন্ত্রী তখনই ফোনে আইজিপিকে সহানুভূতি জানান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।