আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নকল বই থেকে সাবধান ।। রেজা ঘটক ।।

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

কয়েক বছর আগে আমি আমার সকল সনদপত্রগুলো ছিড়ে পুড়িয়ে ফেলি। আমার তখন ওই সনদগুলোর প্রতি একটা কঠিন বিদ্রোহ করার সুযোগ হয়েছিল। আফটার মিশন, আমার মধ্যে একটা ভালো লাগা তৈরি হল। ভালোই হল, অন্তত, বাংলাদেশে বাস করে আর ওই সনদগুলো আমাকে জ্বালাতন করতে পারবে না। সেই রাতে আমার খুব ভালো ঘুম হল।

প্রথমে পরিকল্পনা ছিল, প্রেসক্লাবে একটা সংবাদ সম্মেলন করে সনদগুলো পোড়াবো। বন্ধুরা বলল, খামাখা বাংলাদেশ পুলিশ নাস্তানুবুদ করতে পারে। আমি সংঘর্ষ এড়াতে নিজের ঘরে দরজা খুলে খুব খোশ মেজাজে সনদগুলো পুড়িয়ে বেশ শান্তি পেলাম। উল্লেখ্য, আমার ওই সনদগুলোর ২টিতে প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদের স্বাক্ষর ছিল। বাকি দুটির কথা এখন আর মনে পড়ছে না।

আজ বাংলা একাডেমীতে অমর একুশে বই মেলায় একটি প্রতিবাদী মানববন্ধনে অংশ নেবার সময়, বারবার মনে হয়েছে, আমার সনদ পোড়ানোর মিশনটা সঠিক ছিল। আজ একটি কলংক ধরা পরল। এশিয়া পাবলিকেশন্স প্রকাশিত `মুক্তিযুদ্ধে নারী' গ্রন্থটি একটি চুরি করা বই। যার সম্পাদনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসি প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসি প্রফেসর জসীম উদ্দিন আহমদ। আর লেখক হিসাবে নাম রয়েছে মেহেদী হাসান পলাশ-এর।

বইটি ২০০৮ সালে এশিয়া পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত। আসল সত্য হল, নারী নেত্রী রোকেয়া কবীর ও কবি মুজিব মেহদী `মুক্তিযুদ্ধে নারী' বইটির প্রকৃত লেখক। ২০০০ সালে বইটির পাণ্ডুলিপি বাংলা একাডেমীতে জমা দেয়া হয়। পরবর্তীতে বিশেষজ্ঞ কমিটির [আনিসুজ্জামান, সেলিনা হোসেন প্রমুখের সমন্বয়ে গঠিত] সুপারিশ অনুযায়ী, দ্রুত জমা দিতে হবে শর্তে পাণ্ডুলিপি ফেরত দিলে সে অনুযায়ী সংশোধন করে ২০০১ সালে আবার বাংলা একাডেমীর যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পুনরায় পাণ্ডুলিপি হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু ২০০১-এ বিএনপি নেতৃত্বধীন জোট সরকার ক্ষমতায় এসে বাংলা একাডেমীর 'বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : দলিল ও ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশ প্রকল্প' স্থগিত করে।

আর তখন প্রকল্পের সমস্ত ডকুমেন্টস নবগঠিত মুক্তিযুদ্ধ ও প্রবাসীকল্যান বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তর করে। দীর্ঘদিন পরও গ্রন্থটি প্রকাশের কোনো আয়োজন না থাকায় লেখকদ্বয় মন্ত্রণালয় থেকে পাণ্ডুলিপি প্রত্যাহার করে নেবার আগ্রহের কথা জানান। জবাবে মন্ত্রনালয় সম্মত হলে এ বাবদ বাংলা একাডেমী থেকে যে পরিমাণ অর্থ লেখকদ্বয় গ্রহণ করেছেন তা ফেরত দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। শেষ পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে তাঁরা পাণ্ডুলিপিটি 'মুক্তিযুদ্ধ ও নারী' নামে ২০০৬ সালে আইইডি থেকে প্রকাশ করে। প্রকাশিত `মুক্তিযুদ্ধ ও নারী' পরবর্তীতে বিনামূল্যে সারাদেশে বিতরণ করা হয়।

২০০৮ সালে ওই পাণ্ডুলিপিটিই উপরে উল্লেখিত লেখক ও সম্পাদকদ্বয়ের নামে এশিয়া পাবলিকেশন্স প্রকাশ করে। যেখানে সম্পাদক হিসাবে নাম রয়েছে দেশের দুজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসি প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসি জসিম উদ্দীন আহমদের। আর লেখক হিসাবে নাম রয়েছে মেহেদী হাসান পলাশের। তিনি দৈনিক ইনকিলাবের স্টাফ রিপোর্টার। তাহলে বিষয়টা কি দাঁড়াল? পাণ্ডুলিপি চুরি করে বই প্রকাশ করে লেখক হওয়া যায়! আবার সেই প্রক্রিয়ার সাথে দেশের দুজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব পর্যন্ত জড়িত।

আমি এখনো বিশ্বাস করি, হয়তো সম্পাদক হিসেবে যে দুজন ব্যক্তির নাম বইটিতে রয়েছে, তাঁরা অন্তত এই চৌর্যবৃত্তির সাথে জড়িত নন। অথবা তাঁদের না জানিয়ে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে খুব পরিকল্পিত একটি মিশন ছিল ওটা। আমি এখন ওই দুজন সম্পাদক ও লেখক হিসেবে যার নাম রয়েছে, ওনাদের প্রতিক্রিয়া শোনার অপেক্ষায়। আর যদি ঘটনা সত্যি সত্যি চুরির হয়, এবং উল্লেখিত নামের সবাই ঘটনার সাথে জড়িত থাকেন, তাহলে আমি ওই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। পাশাপাশি ওই ঘটনার সুষ্টু ও যথাযথ তদন্ত ও বিচার চাই।

এই ফাঁকে বিচার প্রক্রিয়ায় যাঁরা জড়িত হবেন, তাঁদের সঠিক কর্মপদ্ধতি নির্ধারণও একটা নতুন ইস্যু হয়ে না যায়, সেই আশংকা কিন্তু উড়িয়ে দিচ্ছি না। কারণ, বাংলাদেশের ইতোপূর্বে হওয়া বিচার প্রক্রিয়ার চিত্র আমাদের দুশ্চিন্তার যে একটা বড় ঘটনা, তা কি করে ভুলে যাবো? আমরা চাই, `মুক্তিযুদ্ধে নারী' বা `মুক্তিযুদ্ধ ও নারী' সংক্রান্ত বই চুরি ও প্রকাশ সংক্রান্ত ঘটনার আসল সত্য প্রকাশ পাক। আর দোষীরা আইনের নিজস্ব গতিতে বিচার প্রক্রিয়ায় আসুক। আমি একটু যা লেখালিখি করি, এই ঘটনা শুনে, সত্যিই খুব আতঙ্কের মধ্যে আছি। না জানি কখন, কোন বিখ্যাত লোক আমার কোন লেখা চুরি করে আমাকেই নিস্ব করে দেবার প্রচেস্টায় লিপ্ত হয়? যদিও, আমি বিশ্বাস করি, চুরি করে পৃথিবীর কোথাও কেউ লেখক হতে পারেন নি।

ভবিষ্যতেও পারবে না। লেখক তার নিজস্ব শক্তির জোড়েই লেখক হিসাবে টিকে থাকবে। বই চোর এক জিনিস, কিন্তু লেখা চুরি করা, আবার তা সাহসের সাথে বই আকারে প্রকাশ করার জন্য অবশ্যই হিম্মত লাগে। আর সেই হিম্মতের পিছনে থাকে অনেক অজানা জানা রহস্য। আমরা সেই রহস্য ও সকল ঘটনার সঠিক উন্মোচনের অপেক্ষায় থাকলাম।

সংবাদ মিডিয়া, মানবাধিকার সংগঠন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সরকার সদয় হলে, আসল ঘটনা উদ্ধার করা মোটেও কঠিন কাজ নয়। নইলে এই দেশে বসে লেখালেখি, ওরে বাবা, আমি ভীষণ ভীষণ ভয় অনুভব করছি। দেশের সকল লেখক, কবি, সাহিত্যিক, গবেষক, পণ্ডিত, শিক্ষক, মানবাধীকারকর্মী, এবং সচেতন নাগরিকদের এই বিষয়ে এখনই সোচচ্চার হবার সময়। নইলে ইতিহাস চুরির ধারাবাহিকতায় লেখা চুরিও একটা সিস্টেমে পরিনত হবে। তখন সেই ধ্বংসাসী ছোবল থেকে কেউ রেহাই পাবে না।

আমিও না। আপনিও না। আসুন, আমরা লেখা চুরির প্রতিবাদ জানাই এবং এর যথাযথ বিচারের দাবীতে সামিল হই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।