কুড়িগ্রামে দায়রা জজ আদালত
জেলা ও দায়রা জজ ছুটিতে গেলেই ঐ আদালতে অস্বাভাবিকহারে আসামীদের জামিন দেয়ার ঘটনা ঘটছে
কুড়িগ্রামে দায়রা জজ আদালতে গণহারে জামিন দেয়ার ঘটনায় আইনজীবিসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্থর এবং বিচার প্রার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। জেলা ও দায়রা জজ ছুটিতে গেলেই ঐ আদালতে অস্বাভাবিকহারে আসামীদের জামিন দেয়ার ঘটনা ঘটছে। এ ধরনের জামিনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এডভোকেট আব্রাহাম লিংকন এ ধরণের জামিনের ঘটনাকে আস্বাভাবিক, ন্যায় বিচারের পরিপন্থী ও আবঞ্ছনীয বলে জানিয়েছেন।
খোজ নিয়ে দেখা গেছে মাত্র ১৩ কার্য দিবসে ডাকাতি, চুরি, মাদক চোরাচালান, হত্যা, গণধর্ষন, ধর্ষন, অস্ত্র এবং অপহরণসহ গুরুতর আপরাধের জামিন অযোগ্য ২০৭টি মামলায় পাঁচ শতাধিক আসামীকে জামিন দেয়া হয়।
এরমধ্যে গত ২৭ জানুয়ারী থেকে জেলা দায়রা জজ ছুটিতে যাওয়ায় ৪ ফেব্র“য়ারী পর্যন্ত ৭ দিনে গুরুতর অপরাধের জামিন অযোগ্য ৭৭টি মামলার দেড় শতাধিক আসামীকে জামিন দেয়া হয়। এতে জেলে এবং জেল হাজতে থাকা সশ্রম কারদন্ড প্রাপ্ত আসামীসহ ৩৪ জন জামিনে মুক্ত হয়ে বেড়িয়ে এসেছে। ইতিপূর্বে দায়রা জজ জামিন দেননি এমন আসামীও এ সময়ে জামিন দেয়া হয়েছে। এমনকি প্রথা বহির্ভূতভাবে দায়রা জজের নিজ ফাইলে বিচারাধীন মামলার নথি তলব করে আসামীদের জামিন দেয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ফারজানা বেগম দীর্ঘ প্রায় ৪ বছর থেকে কুড়িগ্রামে কর্মরর্ত আছেন।
এই দীর্ঘ সময়ে জেলা দায়রা জজ ছুটিতে থাকাকালীন সময় তিনি দায়িত্বে থাকলেই গণহারে জামিন দেয়ার ঘটনা ঘটছে। এ প্রসঙ্গে কুড়িগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট এ,টি,এম এনামুল হক চৌধুরী চাঁদ, জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট ইদ্রিস আলী এবং এডভোকেট ফখরুল ইসলামসহ একাধিক আইনজীবি জানায়, এধরনের ঘটনায় বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
গত ৩ ফেব্রুয়ারী স্থানীয় সার্কিট হাউজে এক মতবিনিময় সভায় উপস্থিত দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান লে জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরীকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশানাল (টিআইবি)-এর জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির সদস্যগণ বিষয়টি অবহিত করেন। নাম প্রাকাশ না করার শর্তে স্থানীয় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ এই ঘটনাগুলো নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।
সূত্র আরও জানায়, কুড়িগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ নুরন্নাহার বেগম গত ২৭ জানুয়ারী থেকে ছুটিতে গেলে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ফারজানা বেগম ভারপ্রাপ্ত দায়রা জজের দায়িত্ব নেন। প্রথা অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত দায়রা জজ (খন্ডকালীণ সময়ের জন্য) শুধুমাত্র জরুরী বিষয়গুলোর শুণানী করে থাকেন। কিন্তু তিনি এর ব্যতিক্রম করে দায়িত্ব নিয়ে ২৭ জানুয়ারী ১২টি, ২৮ জানুয়ারী ১৩টি, ২৯ জানুয়ারী ১৬টি, ১ ফেব্র“য়ারী ৬টি, ২ ফেব্র“য়ারী ৬টি এবং ৩ ফেব্রুয়ারী ১১টি জামিন অযোগ্য গুরুতর অপরাধের মামলার আসামীদের জামিন দেন।
এছাড়া গত ২০০৮ সালের ১৬ মার্চ থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত তৎকালীণ জেলা ও দায়রা জজ ভবানী প্রসাদ সিংহ ছুটিতে থাকায় ফারজানা বেগম দায়রা জজের দায়িত্ব পালন করেন। এসময়ে তিনি জামিন অযোগ্য গুরুতর অপরাধের ৮২টি মামলার আসামীদের জামিন দেন।
একই ভাবে তিনি ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর এবং ২৭ নভেম্বর এই দুইদিন দায়রা জজের দায়িত্বে থাকার সময় জামিন অযোগ্য গুরুতর অপরাধের ৪৮টি মামলার আসামীদের জামিন দেন।
সূত্র আরো জানায়, জামিন দেয়া মামলাগুলোর মধ্যে হত্যার উদেশ্যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত সংক্রান্ত রাজারহাটের একটি গুরুতর মামলার ৩ জন আসামী হাইকোর্টে আগাম জামিন আবেদন করলে তাদের নিম্ন আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এরই প্রেক্ষিতে এই আসামীগণ নিম্ন আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করলে তা না মঞ্জুর করে তাদের জেল হাজতে পাঠানো হয়। পরে জেলহাজতে থাকা ঐ আসামীদের জামিনের জন্য দায়রা জজ আদালতে ফৌজদারী মিছ মামলা নং-৫৭/০৯, ধারা-৩২৬/৩০৭ দ.বি. দায়ের করলে ২ জনকে জামিন দিয়ে মূল আসামীকে আটক রাখার আদেশ হয়। এর পর গত ২৯ জানুয়ারী ফারজানা বেগম দায়রা জজের দায়িত্ব থাকাকালীণ সময়ে জেলহাজতে আটক ঐ আসামীর জামিন আবেদন করলে তা না মঞ্জুর করেন।
তার পরেও বিধি মোতাবেক নতুন কোন হেতু ছাড়াই ঐ আসামীকে ২ ফেব্রুয়ারী তিনি জামিন দেন। পাশাপাশি স্পেশাল ৭৮/০৮ (অস্ত্র সংক্রান্ত) নম্বর মামলার আসামী চিহৃত অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায়ী পেটকাটা নুরুর জামিন আবেদন তিনি ২৭ জানুয়ারী না মঞ্জুর করলেও একইভাবে নতুন হেতু ছাড়াই এর ৬ দিন পর ৩ ফেব্রুয়ারী তাকে জামিন দেন।
এদিকে তার আদালতে বিচারাধীন জেএমিব প্রধান মতিন মেহেদীসহ ৪৫ জন আসামীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার চার্জশীট দাখিল হওয়ার পরেও গ্রেফতারকৃত ২১ জনকে জামিন দিয়েছেন। শুধু তাই নয় চার্জশুনানীর আগে জামিনে থাকা ৫ জনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। পাবলিক প্রসিকিউটর এই অব্যাহতি আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশনের জন্য এটর্নি জেনারেল অফিসে নথিপত্র পাঠিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
অন্যদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে বিভাগীয় তদন্তে ঘুষের অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় অভিযোগ নামা ও অভিযোগ বিবরণীসহ আইন মন্ত্রনালয় থেকে তাকে কৈফিয়ত তলব করা হয়েছে। প্রায় দুই সপ্তাহ আগে পাঠানো এই কৈফিয়তের চিঠি প্রাপ্তির পরর্বতি দশকার্য দিবসের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং ভারপ্রাপ্ত দায়রা জজ ফারজানা বেগমের জানান, আইন মন্ত্রণালয় থেকে তিনি কোনো কৈফিয়তের চিঠি পাননি। আমি বুঝতে পারছিনা করা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। আমার প্রমোশন হওয়ার সময় হলেই এসব ছড়ানো হয়।
বুঝিনা এতে তাদের লাভ কি! হতে পারে সুবিধা পায়নি বলে এমন করছে। তবে আমার এখতিয়ার আছে বলেই জামিন দিয়েছি।
এ প্রসঙ্গে ছুটিতে থাকা জেলা ও দায়রা জজ নুরুন্নাহার বেগমের সাথে মোবাইলে যোগযোগ করা হলে তিন জানান, ভারপ্রাপ্ত থাকাকালীন সময়ে সাধারণত: কেউ জামিনের বিষয় দেখে না। তবে অফিসিয়াল সাক্ষী থাকলে নেয়া হয় যাতে তাদের ভোগান্তি না হয়। ছুটি শেষে কাজে যোগদানের পর বিষয়গুলো সর্ম্পকে জানার চেষ্টা করবো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।