আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিপ ব্রেকিং শিল্পের জাহাজ কাটা বর্জ্য পানিতে বিপর্যয়ের মুখে উপকূলীয় এলাকার মৎস সম্পদ



সলিমপুরস্থ জেলে পাড়ার বৃদ্ধ হীরালাল জলদাস অভিযোগ করেন, আগে এ অঞ্চলে মাছ পেতাম প্রচুর পরিমানে। মাছ , জাল, নৌকার উপর নির্ভর করে জীবন চলতো। সমুদ্রের পানির রং ছিল আয়নার মত পরিষ্কার। বর্তমানে পানির রং ঘোলাটে কালো হয়ে গেছে। মাছও আগের মত পাচ্ছি না।

মাছের অভাব দেখা দেয়ায় জেলেরা এখন কষ্টের মধ্যে দিন যাপন করতে হচ্ছে। কয়েকযুগ ধরে তিনি এ পেশায় নিয়োজিত। কিন্তু বর্তমানে সামুদ্রিক মাছের তীব্র সংকট দেখা দেওয়ায় এখন তিনি পৈত্রিক পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। এ ধরনের অভিযোগ শুধু হীরালালের নয়, এই অঞ্চলের আরো অনেকের। সীতাকুন্ডের সলিমপুর ও শীতলপুর বঙ্গোপসাগরের উপকূল জুড়ে বিস্তির্ণ জেলে পাড়া।

এই জেলে পাড়ার জেলে স¤প্রদায় যুগ যুগ ধরে নিয়োজিত ছিল সামুদ্রিক মাছ ধরার পেশায়। কিন্তু গত এক বছর ধরে সীতাকুন্ডে সলিমপুর থেকে কুমিরা পর্যন্ত সমুদ্রের উপকূলে জাহাজ ভাড়া শিল্পের ব্যাপক প্রসারে ফলে এই অঞ্চলে পরিবেশ প্রচুর পরিমান ক্ষতি হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় বিস্তির্ণ জেলে স¤প্রদায়ের বিঘিœত হচ্ছে স্বাভাবিক পরিবেশ। বিশেষ করে জাহাজ ভাঙ্গা বিভিন্ন বর্জ্য ও তৈলজাত দ্রব্য এসব এলাকার সমুদ্রের পানি ও মাটিকে দুষিত করে চলেছে প্রতি নিয়ত। জানা যায়, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছর গুলোতে শিপ ব্রেকিং ব্যবসা একটি পৃথক শিল্পের রুপ নিয়েছে।

বিদেশ থেকে সমুদ্রগামী জাহাজ ও তেল ট্যাংকগুলো সংগ্রহ করে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট, ভাটিয়ারী, সোনাইছড়ি ও কুমিরায় সেগুলোকে কাটা হয়। জাহাজ গুলো কাটার সময় তেল ট্যাংকারের তলানিতে জমে থাকা বিপুল পরিমাপ অপরিশোধিত তেল,অন্যান্য লুব্রিকেল্ট এবং ইঞ্চিনের তেন বিভিন্ন জাহাজ থেকে পানিতে পড়ে থাকে। এই বর্জ্য মিশ্রিত তেল সমুদ্রের পানিতে মিশে পানিকে দুষিত করে দারুনভাবে। এই দূষনের ফলে তৎসংলগ্ন সমুদ্র সৈকতের স্বাভাবিক অবস্থায় সৃষ্টি হচ্ছে নানা বিপর্যয়। জানা যায়, আনুমানিক ৪০-৪২ হাজার টন ওজনের বিশাল জাহাজ কেটে জাহাজের যাবতীয় মালামাল সরবরাহ করা হয়ে থাকে বিভিন্ন স্থানে।

এর মধ্যে বেশির ভাগ পন্য সরবরাহ করা হয়ে থাকে রোলিং মিল সমূহে। মূলত জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প প্রতিষ্ঠানে সাথে জড়িত মালিকদের বিনিয়োগ ও শ্রমিকদের সহযোগীতায় এই অঞ্চলে এখন জমজমাট হয়ে উঠছে এই ব্যবসা। অর্থনৈতিক ভাবে এই ব্যবসায় সফলতা অর্জন করলেও এই শিল্প প্রতিষ্ঠানে পুঞ্জিভুত হচ্ছে বিভিন্ন সমস্যা। যার প্রধান সমস্যা পরিবশ দূষণ। এই সমস্যা এখন জাতীয় জীবনে বিরাট হুমকি হিসাবে দেখা দিয়েছে।

এই অঞ্চলের সমুদ্রের পানি ও মাটি দুষণ নিয়ে গবেষণা করার কাজে নিয়োজিত চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বিজ্ঞান ইনষ্ট্রিটিউটের সহকারী অধ্যাপক নুরুল আমিন জানান, জাহাজ ভাঙ্গা বা মেরামতের সময় ভাঙ্গা জাহাজের অপরিশোধিত তেল,ভারী ধাতু এবং রাসায়নিক বিভিন্ন বর্জ্য উপকূলের বিস্তির্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। শুধু উপকূলে নয়, এসব ছড়িয়ে পড়ে সমুদ্রের পানিতেও। এতেকরে উপকূলীয় পরিবেশ ক্ষতিকর হচ্ছে মারাতœক ভাবে। সেই সাথে হ্রাস পাচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের মাছের সংখ্যা। শুধু মাচ নয়, সামুদ্রিক জাতীয় প্রাণীও এসব এলাকা থেকে ক্রমান্বয়ে বিলুপ্তি হতে চলেছে।

তাদের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকার মাটিতে পারদ রয়েছে ০.৫-০.২৭ পিপিএম, সীসা রয়েছে- ০.৫- ২১.৮ পিএম, ক্রোমিয়াম রয়েছে- ২২০ পিপিএম, ক্যাডামিয়াম রয়েছে- ০.৩-২.১ পিপিএম, ক্যালসিয়াম রয়েছে- ৫.২-২.১০ পিপিএম এবং ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে- ৬.৫-১.৫৭ পিপিএম। জানা যায়, পতেঙ্গা থেকে কুমিরা পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলে শিপ ব্রেকিং শিল্প গড়ে উঠার আগে উপকূলীয় ভাঙ্গন রোধ কল্পে ব্যাপক হারে বনায়ন করা হয়েছিল। কিন্তু উক্ত এলাকায় এই শিল্পের প্রসারের ফলে এলাকার বনাঞ্চল সম্পূর্ণ ভাবে নিশ্চিহৃ হয়ে যায়। ফলে ভাঙ্গন বিস্তৃতি লাভ করে। তেল জাত বিভিন্ন দ্রব্য পানিতে পড়ে সৈকতে এবং পানির উপরিভাগে এক আঠালো আস্তরনের সৃষ্টি করে।

এই আস্তরন নানা জিনিসের মধ্যে দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ করে চলেছে উপকূলীয় জীবজন্তুকে। অন্যদিকে সমুদ্রের পানিতে জমাকৃত এই আস্তরন মৎসকুলকেও ক্ষতিগ্রস্থ করে তুলেছে। শিপ ব্রেকিং সামাজিক পর্যবেক্ষন ফোরামের সদস্য সচিব সিরাজ উদ্দীন বেলাল এ প্রতিনিধিকে জানান, শিপ ইয়ার্ড জাহাজ কাটতে গিয়ে সৃষ্টিহয় খন্ড বিখন্ড লোহার টুকরো গুড়া। এসব পদার্থের শেষ গন্তব্য উপকূলীয় মাটি এবং শেষ পর্যন্ত ঐ সমুদ্র। এর ফরে মারাতœক দুষিত হচ্ছে সমুদ্রের পানি।

এসব এলাকার সমুদ্র উপকূলে মাছ সহ অন্যান্য জলজজীবের পরিমান দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। সমুদ্র বিজ্ঞানিগন তাদের বিভিন্ন গবেষনায় অভিমত ব্যক্ত করছেন যে, এই অঞ্চলগুলো ছিল এক সময় বিভিন্ন মাছের প্রজনন ক্ষেত্র। গভীরতার কারণে এখানে এক সময় মাছেরা ডিম পাড়তে আসত। এখন তা আর নেই। সমুদ্র বিজ্ঞানি ডা. ইউসুফ শরীফ বলেন, জাহাজ ভাঙ্গা ঘাটার পাশে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে পানিতে তেল ভাসতে দেখা যায়।

ফলে ঐ এলাকার পানিতে সূর্য রশ্মি প্রবেশ করতে পারে না। এ কারনে সামুদ্রিক মাছ ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়। অর্থাৎ জাহাজ কাটা প্রক্রিয়া চর্তুদিকের স্থল ও জলের প্রাণীকূল এবং উদ্ভিদকূলের উপর ভয়াবহ বিরূপ্রতার সৃষ্টি করে এদের স্বাভাবিক জীবন যাত্রাকে ব্যাহত করছে। তিনি আরও জানান, সমুদ্রের পানির উপর যে তেল ও বর্জ্য জমা হয় তা সূর্যের আলোকে পানির নীচে পৌছতে বাধা দেয়। এতে পানির নীচের উদ্ভিদ জগতের সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বাধা গ্রস্থ হয়।

এসকল উদ্ভিদ ছোট ছোট মাছ ও ক্ষুদে সামুদ্রিক প্রাণীদের খাদ্য সরবরাহ করে। সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বাধা পেলে উদ্ভিদের জন্মনো এবং বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে ছোট মাছ ও প্রাণীদের খাদ্য সরবরাহ কমে যায়। একই সাথে এদের সংখ্যাও কমতে থাকে।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।