আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দ্য ওয়ার্ল্ড উইদাউট ইসলাম



মূল : গ্রাহাম ই ফুলার ভূমিকা ও অনুবাদ : কাউসার খালিদ ‘দ্য ওয়ার্ল্ড উইদাউট ইসলাম’ পশ্চিমের খুবই সামপ্রতিক একটি ভাবনার প্রকাশ, যা সন্ত্রাসবিরোধী মুভমেন্ট নামের অনর্থক সহিংস প্রপাগান্ডার আড়ালে লুকিয়ে থাকা তাদের হাতাশারই উন্মোচন। পশ্চিম কখনো ইসলামকে বুঝতে চায়নি, বুঝার মত তার মানসিক প্রস্তুতি কখনো ছিল না। ইসলামের স্পিরিচ্যুয়াল সত্যকে আড়াল করে সে কেবলি তাকে একটি প্রথাসর্বস্ব রাজনৈতিক ঐক্য হিসেবে গণ্য করেছে, এবং ভেবেছে, আধুনিক সময়ে ভূ-রাজনৈতিক আর্থ সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের প্রথম ও শেষ প্রতিপক্ষ ইসলাম, একে অতিক্রম না করে ক্ষমতা, প্রভাব ও সম্পদের কেন্দ্রিকরণ কখনো সম্ভব হবে না। ন্যুইয়র্ক হতে প্রকাশিত ‘ফরেন পলিসি’ পত্রিকার ফেব্রুয়ারীর সংখ্যায় নিবন্ধটি ছাপা হয়, এবং লেখার প্রতিপাদ্য মুসলিম বিশ্বে নানাভাবে আলোচিত-সমালোচিত হয়। মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ সচেতন শ্রেণির প্রতিক্রিয়া ছিল, ইসলামকে এভাবে দেখার, বিবেচনা করার বিপদ অনেক, পশ্চিম ইসলামকে বিবেচনা করতে গিয়ে যে বিপদে বার বার নিজের পা কেটেছে।

গ্রাহাম ই ফুলার এক সময়কার গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকান পলিসি মেকার, সি আই এ’র প্রাক্তন চীফ এসিস্ট্যান্ট। বর্তমানে সীমন ফ্রেজার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অতিথি অধ্যাপক। বেশ কয়েকটি বিষয়ে লিখে তিনি ইতিমধ্যে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক তার অন্যতম গ্রন্ত ‘পলিটিক্যাল ইসলামের ভবিষ্যত’। পশ্চিমা বিশ্বের হালের ইসলাম বিদ্বেষ এবং ইসলামের বিলুপ্তি একমাত্র সমাধান ইত্যাদি ধারনাকে তিনি নিবন্ধটিতে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছেন।

তিনি কল্পনা করেছেন এমন এক মধ্যপ্রাচ্যের, যেখানে ইসলাম নেই, কিংবা থাকলেও তা হয়েছে এক বিলুপ্ত ইতিহাস বৈ নয়। ইসলাম হীন পৃথিবীর কল্পনা করতে গিয়ে তিনি নিকট অতীতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর প্রতি ইংগিত করেছেন। লেখাটিকে ‘www.somewhereinblog.net’-এর পাঠকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে বিধায় আমরা একে বাংলায় ভাষান্তর করে উপস্থাপন করবার প্রয়াস পেয়েছি। ইসলাম যদি চূড়ান্তভাবেই বিলুপ্ত হয়ে যেত, তবে কি এমন ঘটত ? কারো কারো হিসেবে বলা যায়, পরিস্থিতি হয়ে উঠত খুবই আনন্দদায়ক ; ইসলামের বিলুপ্তির সাথে সাথে বিলুপ্তি ঘটত সভ্যতার দ্বন্দ্বের, বন্ধ হত পবিত্র যুদ্ধ, সন্ত্রাসমুক্ত এক নতুন পৃথিবীতে আমরা নির্মল বিশুদ্ধ বাতাস গ্রহণে তৃপ্ত হতাম। পৃথিবীর উপর খ্রিস্টবাদের শাসন কি অচিরে প্রতিষ্ঠা পেত ? মধ্যপ্রাচ্য কি ডেমোক্রেটিক পৃথিবীর জন্য নিরাপদ মরূদ্যানে পরিণত হত ? ইসলাম মুক্ত পৃথিবীতে নাইন ইলিভেনের ঘটনার কি আদৌ কোন সম্ভাবনা ছিল ? বাস্তবতা হল, ইতিহাস এবং পৃথিবীর পথ হতে ইসলামকে অন্ধকারে ঠেলে দিলে নতুন কোন পৃথিবীর জন্ম নিত না।

ইসলামহীন পৃথিবী তেমনি থাকত, যেমন আজ আছে। যাবতীয় সংঘাত, সংকট এবং তিক্ত পরিস্থিতির মুখোমুখি আমাদেরকে দাঁড়াতেই হত। যেহেতু ইসলামকে বিলুপ্ত করে দেয়া যাচ্ছে না, সুতরাং এমন এক পৃথিবীর কল্পনা করা যাক, যেখানে ইসলাম নেই। যদিও ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে ঘটা নিত্য ঘটনাগুলোকে আমরা এড়াতে পারছি না, যা ইতিমধ্যে পৃথিবীতে ঘটে গেছে। পৃথিবী ব্যাপী ঘটা অনেক সংঘাতের মূল চালকশক্তি হিসেবে ধরা হয় ইসলামকে, যেমন : সুইসাইড হামলা, গাড়ি বোমা, সেনা দখলদারিত্ব, সংঘাত, সংকট, ফতোয়া, জিহাদ, গেরিলা ওয়ার, ভিডিও টেপ_এমনকি নাইন ইলিভেনের ভয়াবহ হামলা।

এগুলো কেন ঘটছে ? ইসলাম আমাদেরকে এ ব্যাপারে বোঝাবুঝির চৌকাঠে পৌঁছে দেয়, যা খুবই বিশ্লেষণী, তাৎক্ষণিক এবং বিস্তৃত, এবং যা আমাদের সমকালীন পৃথিবীর সহচর এই সব নিত্য ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করতে সহায়তা করে প্রবলভাবে। অপরদিকে নব্য রক্ষণশীল কারো কারো হিসেবে, ‘ইসলামী ফ্যাসিবাদ’-ই আমাদের একমাত্র প্রবল শত্রু, যা ক্রমে আমাদেরকে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমি আমার মূল আলোচনা উত্থাপন করে কিছু প্রশ্ন তুলতে পারি ; যেমন : সংঘাত এবং সংকটের এই নিত্য নতুন বিষয়গুলো, যাকে আমরা ইসলাম হিসেবে চিহ্নিত করছি, তা যদি না থাকত তবে কি এমন পরিবর্তন ঘটত ? যদি নবী মুহাম্মদ না থাকতেন, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, আফ্রীকার দীর্ঘ এলাকা জুড়ে ইসলামের ক্রমান্বয় বিস্তৃতির দীর্ঘ ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলো যদি না থাকত, তবে নতুন কি এমন জন্ম নিত ? সন্ত্রাস, যুদ্ধ এবং আমেরিকার বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান বিদ্বেষ,_যাএখন বিশ্ব রাজনীতির উত্তেজনারই অংশ_এর প্রতি লক্ষ্য রেখে আমাদেরকে এ ধরনের সংকটের উৎস খুঁজে বের করতে হবে। ইসলাম কি প্রকৃতপক্ষেই এ ধরনের সংকটের উৎস ? নাকি আমাদের অগোচরে রয়ে গেছে এমন কিছু, তুলনামূলকভাবে কম স্পষ্ট এবং গভীর প্রভাব বিস্তারকারী হওয়ার ফলে যা আমরা শনাক্ত করতে পারছি না ? এই বোঝাবুঝির পরদা উন্মোচন করতে, নতুন, ভিন্নতর, এবং অভূতপূর্ব এক ইতিহাস কল্পনা করতে গিয়ে আমরা ইসলাম মুক্ত মধ্যপ্রাচ্যের ধারণা করতে পারি। এ ধরনের কল্পিত এক মধ্যপ্রাচ্যের রূপ দাঁড় করিয়ে আমরা কি ঐ সমস্ত চ্যালেঞ্জগুলো মিটমাট করে ফেলতে পারব, যা ক্রমশ অনতিক্রম্য হয়ে উঠছে ? এর ফলে অধিক শান্তিপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্য জন্ম নিবে ? পরিবর্তনের পরিধি কী হবে, যা প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মাঝে নতুন সংযোগ তৈরি করবে ? এটা কি জোর দিয়ে বলা সম্ভব যে, ইসলাম ছাড়া পৃথিবী এমন এক বৈশ্বিক নীতিমালার জন্ম দেবে, যা বর্তমানের তুলনায় ভিন্নতর ? মধ্যপ্রাচ্যে যদি ইসলাম না থাকত, তবে সেখানে কি থাকত ? বৃহৎ মধ্যপ্রাচ্যের সেই উন্মেষের সময়েই ইসলাম তার সাংস্কৃতিক মানদণ্ডের রূপ নির্ধারণ করে দেয়, এমনকি, তার অনুসারীদের রাজনৈতিক ইচ্ছাধিকারও।

এ কারণেই মধ্যপ্রাচ্য হতে ইসলামের উৎখাত আমাদের জন্য এক কঠিন কর্ম। এতদসত্ত্বেও ইসলাম বিহীন মধ্যপ্রাচ্যের কল্পনা কঠিন হবে না। আমরা এ কল্পনার সূচনা করতে পারি মধ্যপ্রাচ্যের জাতিগত সমস্যা দিয়ে। ইসলাম শূন্য এ অঞ্চলের মানচিত্র হয়ে উঠবে এক জটিল আবর্ত, সংঘাতময়। মধ্যপ্রাচ্যের কর্তা গোত্রগুলো, যেমন : অ্যারাবিয়ান, পারসিয়ান, তুর্কি, কুর্দী, ইহুদি এমনকি বরবর ও পশতুনরাও ক্রমে রাজনৈতিক বিষয়-আশয়ের কর্তা হয়ে উঠত এর ফলে।

প্রাক ইসলামের বহু পূর্বে, যুদ্ধবাজ পারসিয়ান সাম্রাজ্য বিস্তারকারীরা হটে গিয়েছিল এথেন্সের সীমানায়, এশিয়া মাইনর অঞ্চলে যে গোত্রই বসতি গেড়েছে, পারসিয়ানরা ছিল তাদের শক্ত প্রতিপক্ষ। ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠা সেমেটিক উপজাতিগুলো শক্তির বিস্তার করেছিল ফার্টাইল ক্রিসেন্ট এবং ইরাকে। এর বাইরেও, এখানে সক্রিয় ছিল আরবের গোত্র ও বণিকেরা, ইসলামের পূর্বেই মধ্যপ্রাচ্যের সেমেটিক এলাকাগুলোয় হিজরত করে যারা তৎপর ছিল সেখানে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায়। খ্রিস্টীয় তেরো শ শতক জুড়ে মুঘলরা, অন্যদিকে, মধ্য এশিয়ার সভ্যতাগুলোকে নাস্তানাবুদ করার মহা লীলায় মেতে ছিল। তুর্কিরা দাবড়ে বেড়াচ্ছিল এশিয়া মাইনর, বলকান এবং এমনকি ভিয়েনার এলাকাগুলোয়, তাদের প্রিয় এলাকা ছিল মধ্যপ্রাচ্য।

মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে শক্তি, সীমানা এবং কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, এবং ব্যবসার এই চতুর্মুখী দ্বন্দ্বের এই ইতিহাস বহু পুরোন, ইসলামের অভ্যুদয়ের বহু পূর্বেই এর সূচনা। ইতিহাসের এই পাঠকে মনে রেখেও বলা যায়, ধর্মকে শক্তির এ বলয় প্রতিষ্ঠার সম্পূর্ণ বাইরে ভাবাটা হবে অনৈতিহাসিক সিদ্ধান্ত। বাস্তবতা হচ্ছে, যদি ইসলামের অভ্যুদয় না হত, তবে মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ এলাকা থাকত খ্রিস্ট শক্তির অধীনে, ইসলামের সূচনাকালে আমরা যেমন দেখেছি। কিছু ইহুদি এবং যরথ্রুস্তের অনুসারী ছাড়া মৌলিক ধর্মের অস্তিত্ব এখানে ছিল বিরল। মধ্যপ্রাচ্য খ্রিস্ট ধর্মের অধীনে থাকলেও কি পশ্চিমের সাথে তার উষ্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হত ? এ কঠিন কল্পনা, মধ্যযুগের বিশৃঙ্খল, দাঙ্গাপ্রবণ এবং শক্তি বিস্তার প্রয়াসী ইউরোপ, কারণ, তার অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক নতুন এলাকা খোঁজার নিমিত্তে, পড়শি মধ্যপ্রাচ্যের উপর শক্তি ও কর্তৃত্বের পাখা মেলবে না, এ কোনভাবে মেনে নেয়া যায় না।

এসব কিছুর পর, আমরা প্রশ্ন তুলতে পারি, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রয়োজনের তাগিদে, ক্রুসেডের আক্রমণ যদি পশ্চিমের পক্ষ হতে কোন পলিটিক্যাল কারণে না ঘটে থাকে, তবে কি ছিল তার চরিত্র ? খ্রিস্টের পতাকা উত্তোলন যতটা না ছিল ধর্মের কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল ইউরোপের শক্তি নিয়ন্ত্রক ঘরানার রাজনৈতিক প্রবণতা ও ইচ্ছা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে। লোকাল ধর্মের অনুসারীদের খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী করে তোলে পশ্চিমের ধর্মকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়া তাদের লক্ষ্য ছিল না। ইউরোপিয়ানরা একে কখনো কখনো ‘স্থানীয় অধিবাসীদের মাঝে খ্রিস্টীয় মূল্যবোধ’ প্রচার হিসেবে বর্ণনা করেছে যদিও, কিন্তু এর লক্ষ্য ও কারণ ছিল ঔপনিবেশিক_যেমন পশ্চিমা নগরগুলোর জন্য সম্পদের উৎস_শর্ত প্রতিষ্ঠা করা, কিংবা পশ্চিমা শক্তির বিস্তারের লক্ষ্যে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ। পেট্রল যুগের কথাই ধরা যাক ; মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, যদি খ্রিস্টানও হত, তাদের ভূমিতে ইউরোপের সর্বাত্মক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকে বিনা বাক্যব্যয়ে অভিবাদন জানাত ? এ ধরনের কল্পনা, খুবই অবাস্তব, অবিবেচনা প্রসূত মনে হবে, সন্দেহ নেই। পশ্চিমারা যে কোন মূল্যে তেলের বৃহৎ টানেল নির্মাণ ও তার উপর সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় খুবই আগ্রহী_যেমন সুয়েজ খাল।

G কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং, ইসলাম ও ইসলামের প্রতি নিবেদনই মধ্যপ্রাচ্যকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে, এবং তার সার্বিক প্রভাবের প্রতিরোধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, এবং বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পশ্চিমাদের স্বার্থানুসারে মানচিত্রের নতুন রূপ নির্ধারণে_G কোন ভাবেই ঠিক নয়। এমনিভাবে, মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান খ্রিস্টানরা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী তেল কোম্পানিগুলো তাদের অভিভাবক হয়ে হাজির হোক, কিংবা তাদের সূত্র ধরে হাজির হোক কূটনীতিক, গোয়েন্দা কর্মকর্তা, এবং সশস্ত্র সেনাবাহিনী_এটা কখনো চায় না। এ ক্ষেত্রে তাদের মনোভাব মুসলমানদের মতই। এ প্রসঙ্গে আমরা ল্যাটিন আমেরিকার দীর্ঘ ইতিহাসের দিকে নজর দিতে পারি, তেল, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমেরিকার কর্তৃত্বের প্রবল বিরোধিতার ইতিহাস যাদের ঐতিহ্যগত।

আধুনিক এ উপনিবেশ খর্ব করার লক্ষ্যে অচিরে মধ্যপ্রাচ্যে দানা বাধতে থাকবে জাতীয় প্রতিরোধ বিপ্লব, স্বভূমি হতে শত্রুর উৎখাত, বাজার ব্যবস্থা বিমুক্ত করণ এবং স্বকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, বিদেশি শক্তির কবজা শিথিল করা_ইতিহাসের অন্যান্য ঔপনিবেশিক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে দুর্বল জনগোষ্ঠীর রুখে দাঁড়ানোর মত, এরাও এক সময় এই বিষয় সামনে এনে নিজেদেরকে জড়িয়ে নিবে সশস্ত্র লড়াইয়ে। ইন্ডিয়াতে হিন্দুদের, চীনে কনফুশিয়ানদের, ভিয়েতনামে বৌদ্ধদের, আফ্রিকায় খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের উপনিবেশ বিরোধী লড়াইয়ের জলজ্যান্ত ইতিহাস এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ। আলজিরিয়ায় ফ্রান্সের এবং ইথিওপিয়ায় ইটালীর উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা এবং তার পরের ইতিহাস এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য। ফরাসিরা খ্রিস্টান অধ্যুষিত আলজিরিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল তাদের সম্পদ লুণ্ঠন এবং উর্বর ভূমিগুলো নিজেদের কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে। খ্রিস্টান ইথিওপিয়াও ইটালীকে বাধা দেয়নি সেখানে লুঠতরাজের রাজ্য কায়েম করতে, বলপ্রয়োগে ইথিওপিয়াকে কবজা করার ইতিহাস খুবই সুবিদিত।

মোটকথা, আমরা কখনোই এমন মধ্যপ্রাচ্যের কল্পনা করতে পারি না, ইউরোপের উপনিবেশের প্রতিষ্ঠার ফলে পালটে যাবে যার তাবৎ খোলনলচে, ইসলামের পতাকা তলে থাকার ফলে তার মাঝে তৈরি হচ্ছে প্রতিরোধ সংগ্রামের যে বীজ, সমূলে তা উৎপাটিত হবে, এবং ইউরোপের সাথে স্থাপিত হবে তার এক অভূতপূর্ব, মধুর সম্পর্ক। তবে, আমরা কি এমন সিদ্ধান্ত দিতে পারি না যে, ইসলামহীন মধ্যপ্রাচ্য এখনের তুলনায় হত অধিক গণতন্ত্রপ্রবণ ? ইউরোপের স্বৈরতন্ত্রের ইতিহাস খুব শান্তিপ্রদ তথ্য আমাদের দেবে বলে মনে হয় না। স্পেন এবং পুর্তগালে স্বৈরতন্ত্রের কাল শেষ হয়েছে মধ্য সত্তুর দশকে। গ্রিসে গির্জা কেন্দ্রিক স্বৈরকাল সমাপ্তি কেবল কয়েক দশক পূর্বে, খ্রিস্টান রাশিয়া এখনও শান্তির ভূমিতে অবতরণ করেনি বললেই চলে। এমনকি, নিকট অতীতেও, ল্যাটিন আমেরিকার অন্যান্য দেশগুলো নিয়ন্ত্রিত ছিল স্বৈরশাসক দ্বারা, যারা ছিল আমেরিকার কৃপা-ধন্য এবং ক্যাথলিক গির্জার সহায়তায় যারা স্বৈর কর্ম সম্পাদন করত।

খ্রিস্টান আফ্রীকার প্রতি চোখ বুলালে এর চেয়ে ভিন্ন এবং উন্নত কোন অবস্থা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। সুতরাং, কেন আমরা এমন দূর কল্পনার আশ্রয় নেই যে, খ্রিস্টান মধ্যপ্রাচ্য অচিরে ভিন্ন এবং সম্পূর্ণ নতুন এক রূপে হাজির হবে, সমাধান হবে যাবতীয় সমস্যার ? এগুলোর পর, আমাদের সামনে আছে জ্বলন্ত ফিলিস্তিন। সন্দেহ নেই, ফিলিস্তিন ভূমির খ্রিস্টান অধিবাসীরা ইহুদিদের সর্বাত্মক প্রতিরোধে অংশ নিয়েছে, এ ছিল তাদের পক্ষ থেকে এক প্রকার নির্মূল অভিযান। সেমেটিকদের বিরুদ্ধে এ ভয়ানক উদাহরণগুলো পশ্চিমা জাতি গোষ্ঠী ও কালচারে ছড়িয়ে ছিল বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায়, শক্তিশালী আকারে। ইহুদিরা, তাই, ইউরোপের বাইরে হন্যে হয়ে খুঁজছিল তাদের জন্য এক নিরাপদ আবাসভূমি, জায়োনিষ্ট আন্দোলন ফিলিস্তিনের ব্যাপারে এক মৌলিক নীতিমালা প্রণয়নে তৎপর হয়ে পড়ে ; এবং এরই ফলে ফিলিস্তিন ভূমি হতে ৭৫০০০০ ভূমি পুত্রকে উৎখাত করে দেয়া হয়, এমনকি তারা খ্রিস্টান হলেও।

বাস্তব ইতিহাস ঘেঁটে আমরা দেখতে পাই, তাদের মাঝে অনেক বিখ্যাত খ্রিস্টান ব্যক্তিত্বও ছিল। আরব ফিলিস্তিনরা, তাদের ভূমি প্রতিরোধের লক্ষ্যে কি অচিরে এক ভয়ানক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে না ? ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যা_সন্দেহ নেই, অচিরে রূপ নিবে এক গোত্রীয়, গোষ্ঠীগত সীমানার সংকটে, যদিও হালে তা ধর্মীয় সংকটের লেবাস ধরে আছে। আমাদের ভুললে চলবে না যে, আরব খ্রিস্টানরা দীর্ঘ একটি কাল আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। তবে, এটা অবশ্যই বাস্তব যে, মধ্যপ্রাচ্যের খ্রিস্টানরা ধর্মীয় দিক থেকে কিছুটা হলেও পশ্চিমের প্রতি লালায়িত ছিল। আমরা এ ধর্মীয় বিরোধ কি মিটিয়ে ফেলতে সক্ষম ? স্বয়ং খ্রিস্ট বিশ্ব এই প্রথাবদ্ধ ধর্মের বিরোধিতার ফলে, খ্রিস্ট শক্তির সেই উদ্বোধনের কাল থেকেই ভাঙনের মুখোমুখি হয়েছে বারবার ; ধর্মের এই প্রথাবিরুদ্ধতার ফলেই রোমান ও বাইজাইনটাইন শক্তির সাথে রাজনৈতিক লড়াই-সংঘাতের সূত্রপাত।

ধর্মের পতাকাতলে ঐক্যের বিষয়টি আমরা দূরেই রাখলাম, পশ্চিমা বিশ্বের ধর্মযুদ্ধগুলো সর্বদা হারিয়ে গেছে গোত্রীয় সংঘাত, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং স্ট্রাটেজিক্যাল যুদ্ধ-সংঘাতের নানা আবরণে। ‘খ্রিস্টান মধ্যপ্রাচ্য’র প্রতি এই ইঙ্গিতের আড়ালেও লুকিয়ে আছে এক ভয়ানক নোংরা শত্রুতা। কারণ, ইসলাম ব্যতীত মধ্যপ্রাচ্যের জাতি গোষ্ঠীগুলো ইসলামের অভ্যুদয়ের কালে ফিরে যাবে, সম্ভবত তারা প্রাচ্যীয় অর্থডক্স খ্রিস্টানদের সহযোগী হয়ে উঠবে। তবে, ভুলে যাচ্ছি যে, ইতিহাসের অনেক অনেক বিরোধ-যুদ্ধ, রক্তাক্ত শত্রুতা সংঘটিত হয়েছিল কনষ্টান্টিনোপলের প্রাচ্যীয় অর্থডক্স খ্রিস্টানদের এবং রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের মাঝে। সেই শত্রুতার জের এখনও শেষ হয়নি।

১২০৪ সালে ক্রুসেডারদের সাহায্যে প্রাচ্যীয় অর্থডক্স খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে কনষ্টান্টিনোপলের খ্রিস্টানদের অসম্ভব লুঠতরাজের কথা সহজে ভুলবার মত নয়। অর্থডক্স খ্রিস্টানরা আতঙ্ককর এই স্মৃতি কখনো বিস্মৃত হবে না। দীর্ঘ ৮০০ বছর অতিক্রান্তের পর, ১৯৯৯ সালে উভয় পক্ষের শুকিয়ে যাওয়া যোগসূত্রের মাঝে কিছুটা তারতম্য সৃষ্টির লক্ষ্যে পোপ দ্বিতীয় জন পোল কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন ; তিনি অর্থডক্স বিশ্বে জিয়ারত করেন ; এটি ছিল এক হাজার বছরের ইতিহাসে কোন ক্যাথলিক পোপের প্রথম অর্থডক্স এলাকায় সফর। এটি ছিল একটি সূচনা, কিন্তু মধ্য প্রাচ্যের খ্রিস্ট সমাজের প্রাচ্য-প্রতীচ্যের সেই পুরোনো শত্রুতা তেমনি রয়ে গেছে, যে অবস্থা আজ আমাদের সামনে হাজির আছে। উদাহরণ হিসেবে আমরা গ্রিকদের উপস্থিত করতে পারি।

জাতীয়তাবাদী বিরোধী মুভমেন্ট এবং পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে শত্রুতার নমুনা হিসেবে ধরা হয় একমাত্র অর্থডক্সদের প্রতিরোধ সংগ্রামকে। তাই, আমরা অনায়াসে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, গ্রিসে শতাব্দী ব্যাপী চলে এই মানসিক উত্তেজনা ও হিংস্র মনোভাব সেই একই সন্দেহ ও দৃষ্টিভঙ্গির পুনরাবৃত্তি, আজকের ইসলামী বিশ্ব যাকে নানাভাবে লালন করে যাচ্ছে। ইউরোপ জুড়ে শিল্পবিপ্লবের পর ছড়িয়ে পড়ে যে আলোক_ধর্মনিরোপেক্ষতা, পুঁজি এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের স্লোগানের আলো মেখে, সেই চিন্তা, নতুন জীবন পদ্ধতি এবং বিশ্বাসের সাথে রয়েছে অর্থডক্স সমাজের চূড়ান্ত ভিন্নতা। তেমনিভাবে তার মাঝে লুকিয়ে রয়েছে পশ্চিম সম্পর্কে এক স্থায়ী ভীতির মনোভাব, নানা ক্ষেত্রে ইসলামী বিশ্বের অস্থিরতার সাথে যার রয়েছে সাদৃশ্য-সাজুয্য, পশ্চিমাদের নতুন যুগের ডাক, সমাজ সংরক্ষণে ধর্মের সক্রিয় অংশের দৃষ্টিভঙ্গি, ইসলামী কালচার এবং তার প্রতিবিধান, পশ্চিমাদের সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক বৈশিষ্ট্য_ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইসলামী বিশ্বের সাথে রয়েছে পশ্চিমের এক দূরতিক্রম্য ব্যবধান। বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা কখনো এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারি না যে, মধ্যপ্রাচ্যের খ্রিস্টীয় অর্থডক্সদের নিয়ে মস্কো এক নতুন খেলার জন্ম দেবে, কারণ সেটিই হচ্ছে প্রাচ্যীয় অর্থডক্সদের মূল কেন্দ্র।

অর্থডক্স বিশ্বই, কারণ, শীতল যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে ভূ-রাজনৈতিক কারণে হয়ে উঠবে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের শ্বাস ফেলবার জহুরি এলাকা। আমরা ইরাক বিষয়েই বলতে পারি, ইরাক যদি হত পরিপূর্ণ খ্রিস্ট বিশ্বাসের অনুসারী, তবে ইরাকিদের পক্ষ হতে এর চেয়ে ভাল (!) অভ্যর্থনা আমরা পেতাম ? ইরাকের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী জাতীয় নেতাকে আমেরিকা এ কারণে চূড়ান্ত বিপর্যস্ত করেনি যে, তিনি একজন মুসলমান। তেমনিভাবে এ দু:খজনক অধিকারের ক্ষেত্রে আরবের অন্যান্য জাতিগুলো ইরাকিদের সহায়তা করেছে। পৃথিবীতে এমন কোন ভূমি পাওয়া যাবে না, যার অধিবাসীরা বাহিরের ঔপনিবেশিক শক্তিকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাবে এবং তার হাতে অধিবাসীদের মৃত্যুকে সহজে মেনে নিবে। বাস্তবতা হচ্ছে, আক্রমণকারী শক্তির বিরুদ্ধে পৃথিবীর তাবৎ জাতি গোষ্ঠীই, সর্বদা, এমন কোন ইডিওলজির সন্ধান করে থাকে, বহিরাগতদের বিরুদ্ধে তাদের মুক্তি সংগ্রামকে যা মহৎ করে তুলে।

এই হচ্ছে ইসলামহীন পৃথিবীর কল্পিত রূপ রেখা। এ কল্পনার রেখাগুলো জুড়ে প্রাচ্যীয় খ্রিস্টান অর্থডক্স গির্জা মধ্যপ্রাচ্যের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে বসে আছে, সেই গির্জা যার প্রতি পশ্চিমারা ঐতিহাসিক ও সাইকোলজিক্যাল নানা কারণে সন্দেহগ্রস্ত, বরং, শত্রুতা প্রবণ। এবং কল্পনার এ মধ্যপ্রাচ্য ব্যাপক বিচূর্ণ হয়ে আছে বিধ্বংসী গোত্রীয়, এমনকি দলীয়, বিরোধে। উপরন্তু, তার মানচিত্র শতচ্ছিন্ন হয়ে গেছে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মুহুর্মুহু আক্রমণ পদ-ভারে ; লুণ্ঠিত হয়েছে তার যাবতীয় সম্পদ, পশ্চিমের ইচ্ছা ও তার স্বার্থানুসারে রচিত হয়েছে এই কল্পিত মধ্যপ্রাচ্যের সীমানা, সেই সীমানাগুলো শাসন করছে তাদের পোষ্য, একান্ত বাধ্য শাসক শ্রেণি। এ মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনের অবস্থা তথৈবচ, নিত্য তা জ্বলছে যুদ্ধের আগুনে, ইরান আরো বড় আকারে তার জাতীয়তাবাদ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

এ মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে, আমরা দেখতে পাব, প্রতিরোধ সংগ্রামের নিদারুণ কলহ ; ফিলিস্তিনীরা ইহুদিদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, রুশের বিরুদ্ধে রুখে আছে চেচেন যোদ্ধারা, ব্রিটেন ও আমেরিকার বিরুদ্ধে ইরান পুরো দমে তার কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে, কাশ্মীরিরা লড়ছে হিন্দুদের বিরুদ্ধে, শ্রীলঙ্কার সিংহলিজরা নিয়ত বাধার সম্মুখীন হচ্ছে তামিলদের দ্বারা, চীন ব্যতিব্যস্ত হয়ে আছে তিব্বতিদের আক্রমণে। এর ফলে, মধ্যপ্রাচ্য হয়ে উঠবে এক উত্তম ঐতিহাসিক উদাহরণ, ২০০০ বছরের অধিক স্থায়িত্ব লাভ করা বৃহৎ বাইজাইনটাইন সভ্যতার সাথে যার অনেক সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যাবে। মধ্যপ্রাচ্যের এ রূপ রেখা কোনভাবেই শান্তিময়, নিরাপদ হবে বলে ধরা যায় না। নবীর পতাকা তলে ইসলামের অভ্যুদয় মধ্যপ্রাচ্যে কোন মৌলিক প্রভাব তৈরি করেনি, কিংবা অবদান রাখেনি প্রাচ্য-প্রতীচ্যের সম্পর্কে_সন্দেহ নেই, এ খুবই অসার কল্পনা। ইসলাম এ অঞ্চলের একক শক্তি, গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক নীতিমালা বিনির্মাণের ক্ষেত্রে যার ভূমিকা অনস্বীকার্য| ইসলাম এক বৈশ্বিক ও ইহলৌকিক ধর্ম, যার আশ্রয়ে জন্ম হয়েছে এক বিস্তৃত সভ্যতার, নানাভাবে তা দর্শন, শিল্প ও সমাজকে নতুনভাবে রূপান্তরিত করেছে, জন্ম দিয়েছে নৈতিক জীবনের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, ন্যয়পরতার অভূতপূর্ব মর্ম এবং বিচার ব্যবস্থা, হাজির সমাজ ব্যবস্থায় ক্রমশ প্রশাখা-পল্লবে বিস্তৃত হওয়ার ফলে যা সম্ভব হয়েছিল।

ইসলাম তার নৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি বলে অন্যান্য মুসলিম জাতি গোষ্ঠীগুলোকে এই ভাবনায় প্রণোদিত করেছে যে, তারা সবাই এক ব্যাপক ইসলামী সভ্যতার অংশ এবং উত্তরাধিকারী। এমনিভাবে ইসলামের রয়েছে পলিটিক্যাল বিশ্বের জিওগ্রাফি বদলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ইসলাম যদি না হত, তবে সন্দেহ নেই, দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বর্তমান অঞ্চলগুলো, বিশেষত পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া হিন্দু রাষ্ট্রের বলয়াধীন হয়ে পড়ত। ইসলামী সভ্যতা গড়ে তুলেছে এমন অনেক যৌথ শরিকি ধারণা, যাকে কেন্দ্র করে প্রতিটি মুসলমানই পশ্চিমের বিরুদ্ধে লড়তে উজ্জীবিত হতে পারে। পশ্চিমাদের এ সাম্রাজ্যবাদী পাখা কাটবার প্রয়াসে যদিও তারা ব্যর্থ হয়, কিন্তু এ লড়াই-সংঘাত তাদের মাঝে রেখে যাবে এক ভয়ানক স্মৃতি, যা নির্ণয় করে দেবে তাদের কালচারাল ও চিন্তা নৈতিক গতি-প্রকৃতি, এবং যা তাদের মাঝে এক অনি:শেষ প্রেরণা হয়ে থাকবে।

ইউরোপ, সন্দেহ নেই, সক্ষম হয়েছে আফ্রীকা, এশিয়া ও ল্যাটিন অনেক এলাকাকে উন্মুক্ত করতে এবং বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীকে বিভক্ত করতে ; এই সব জাতি গোষ্ঠীর মাঝে যদি কোন একক প্রতিরোধ গড়ে উঠত, এবং রূপ পেত আন্তর্জাতিক সংগ্রামে, তাহলে তা কোনভাবে সম্ভব হত না। বিচ্ছিন্নতার এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইউরোপ কুক্ষিগত করেছে এ এলাকাগুলোর ক্ষমতা ও সম্পদ। ইসলামহীন পৃথিবীতে, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে বিচ্ছিন্নকরণ, যুদ্ধ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা অনেক সহজ হয়ে যেত, কারণ, তখন কালচারাল ও চিন্তানৈতিকভাবে এ জাতি গোষ্ঠীগুলো পূর্ব হতেই বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকত, তাদের মাঝে থাকত না কোন শরিকি সাংস্কৃতিক ঐক্য, এক স্মৃতি ও ঐতিহ্য তাদেরকে যৌথ কাতারে সমবেত করত না কোনভাবে। এটিই হচ্ছে একমাত্র বিশদ কারণ, যার সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্র ইসলামী বিশ্বে প্রবল বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। মুসলমানদের মাঝে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তাদের মাঝে এক স্বতন্ত্র সচেতন অনুভূতির জন্ম দিয়েছে, তারা বুঝে গেছে এই ব্যাপক বিস্তৃত পশ্চিমা সাম্রাজ্যের অবরোধ, মূলত:, ইসলামের বিরুদ্ধে।

এই অবরোধ আধুনিকতার সাথে সম্পৃক্ত নয় ; এ হচ্ছে ইসলামী বিশ্বের উপর পশ্চিমা বিশ্বের অধিকার প্রতিষ্ঠা, তার সম্পত্তি কুক্ষিগত করা এবং এমনকি তার কালচার পালটে দেয়ার হিংস্র লালসার সাথে সম্পৃক্ত। এ প্রণোদনায় সে এক নতুন মধ্যপ্রাচ্য জন্ম দেয়ার স্বপ্ন দেখছে, যে হবে আমেরিকার জন্য সহায়ক শক্তি। দু:খজনক হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র খুবই সরল বিশ্বাস নিয়ে বসে আছে যে, এ অঞ্চলকে ঘিরে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ইসলাম একটি বিচূর্ণ পাথর হয়ে দেখা দেবে, প্রতিরোধ-সংগ্রামে যা কোন কাজেই আসে না। কিন্তু, সন্ত্রাস সম্পর্কে আমরা কী ব্যাখ্যা হাজির করতে পারি ? বিষয়টি খুবই বেদনাদায়ক, স্পর্শকাতর, পশ্চিম অনবরত যাকে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত করে যাচ্ছে। বিশদভাবে বললে, ইসলামের অস্তিত্ব না থাকলে আসলেই কি নাইন ইলিভেনের ঘটনা ঘটা সম্ভব ছিল ? মধ্যপ্রাচ্য নিত্য মুখোমুখি হচ্ছে যে জুলুম নিপীড়নের, এবং যার উদ্ভব ঘটেছে এ অঞ্চল ও তার কর্মকাণ্ডকে ঘিরে আমেরিকার রাজনীতির বিরোধিতায় গড়ে উঠা পলিটিক্যাল ও কালচারাল ঘৃণার কাল থেকে, এবং ইসলাম নয়, যা মূলত: গড়ে উঠেছে ভিন্ন কোন বিশ্বাসের পতাকা তলে_ইসলামের জন্ম না হলে, এই সব ঘটনা পরম্পরা কি এখানেই শেষ হয়ে যেত ? এ কি ভিন্ন কোন রূপ পরিগ্রহ করত না ? নাইন ইলিভেন ইতিহাসের কোন সূচনা ছিল না, আল-কায়েদার বিমান হামলাকারীদের কথা মাথায় রেখেই বলা যায়, ইসলাম হচ্ছে সূর্যের মুখোমুখি ম্যাগনিফাইং গ্লাস, পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে থাকা জুলুম অত্যাচার যে ক্রমশ নিজের করে নিচ্ছে, এবং সম্পন্ন করছে তাকে এক বলয়ে কেন্দ্রিকরণ_এভাবে, ইসলামই হয়ে উঠবে বহিরাগত শত্রুর বিরুদ্ধে লড়বার একমাত্র ইডিয়োলজি।

একমাত্র ইসলামের সাথেই সন্ত্রাসকে সম্পৃক্ত করা পশ্চিমাদের এক অনপোনীয় অপরাধ। ইহুদি মিলিশিয়ারা ফিলিস্তিনে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস করেছে। কয়েক দশক পূর্বেই তামিল টাইগাররা সুইসাইড ইউনিফর্ম তৈরি করেছে, একেই বিশ্বব্যাপী সুইসাইড হামলা ও সন্ত্রাসের সূচনা হিসেবে গণ্য করা হয় ; তামিল টাইগাররা সুইসাইডের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধীকে হত্যা করে। অন্যদিকে, গ্রিসের সন্ত্রাসীরা এথেন্সে আমেরিকান কুটনীতিকদের বিরুদ্ধে গুপ্ত হামলা চালায়। সংঘবদ্ধ শিখ সন্ত্রাসীরা ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করে, তখন ইন্ডিয়ার এক চতুর্থাংশ এলাকা জুড়ে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার তৈরি হয়, কানাডার সমুদ্রে মিলিত হয়ে তারা একক নীতিমালার শপথ নেয়, যা তাদেরকে সংঘবদ্ধ রাখবে।

ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান আটলান্টিক মহাসাগরে ভূপাতিত করে। পুরো বলকান এলাকা জুড়ে ম্যাসিডোনিয়ার গুপ্ত সন্ত্রাসীদের ভীষণ ভয় পায়। উনিশ শতকের শুরুতে এবং বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন এলাকাজুড়ে ঘটা সন্ত্রাসী ঘটনাও এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, যা পরবর্তীতে ব্যাপকভাবে সন্ত্রাসী কর্ম বিস্তারে ভূমিকা রাখে। আয়ারল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় বাহিনী দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ব্রিটেনের সাথে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে, এর সাথে পুরোপুরি সাদৃশ্য আছে ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক জুড়ে মালয় কমিউনিস্টদের সন্ত্রাসী কর্ম এখনও বিস্মৃত হয়নি কেউ, ইংরেজদের বিরুদ্ধে কেনিয়ার মাও মাও গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী কর্মকে আমরা কি অভিধায় বিচার করব ? বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘটা সন্ত্রাসী ঘটনার উল্লেখ কেবল আমাদের কলেবরই বৃদ্ধি করবে।

এই উদাহরণগুলো আমাদেরকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সাহায্য করে যে, সন্ত্রাসের উৎপত্তির জন্য একমাত্র মুসলমানগণই দায়ী নন। সন্ত্রাসের একেবারে নিকট অতীতের ঘটনাগুলো কোনভাবে এর চেয়ে ভিন্ন চিত্রের নয় ; ইউরোপিয়ান অপরাধ পলিসি রিপোর্ট অনুসারে, ২০০৬ সালের ৪৯৮ টি অপরাধ কর্ম কেবল যুক্তরাজ্যেই ঘটেছে। এর মাঝে ৪২৪ টি অপরাধ ঘটেছে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি গ্রুপের হাতে, ৫৫ টি বামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে, ১৮ টি অন্যান্য সন্ত্রাসী দ্বারা ঘটেছে, মাত্র একটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, যার সাথে সরাসরি মুসলিমদের সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যায়। বরং, এমন কয়েকটি উদাহরণও পাওয়া যায় যে, ইসলামী সংস্থাগুলোর নিবিড় পর্যবেক্ষণের ফলে অনেক সন্ত্রাসী ঘটনা ব্যর্থ হয়। এ ক্ষুদ্র কয়েকটি ঘটনাই সন্ত্রাসের বিশ্ব ধারণাকে অসার প্রমাণ করে।

এ কল্পনা কি আমাদের জন্য খুবই কঠিন যে, আরবরা_মুসলমান হোক কিংবা খ্রিস্টান, ইহুদিদের প্রতি বিদ্বেষ প্রবণ হোক কিংবা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো তাদের ভূমিতে যে যুদ্ধ বিগ্রহের জন্ম দিচ্ছে, হস্তক্ষেপ করছে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে, তার প্রতি চরম ক্ষিপ্ত হোক_তারা কি একই সন্ত্রাসী উপকরণ ব্যবহার করবে ? অন্যদের মত গোষ্ঠীবদ্ধ সংগ্রামে জড়িয়ে পড়বে ? আমরা অন্যভাবেও এ প্রশ্নটি তুলতে পারি_কেন অতি দ্রুত এগুলোর উদ্ভব ঘটছে না ? র‌যাডিক্যাল সংঘটনগুলোর সাথে যেহেতু জুলুম-নিপীড়নের বিষয়টি জড়িত, আমরা কেন তাদের ক্ষেত্রে এ ভয়ে শিহরিত হচ্ছি না যে, অচিরে তারা পশ্চিমের কেন্দ্র গুলোতে হামলা চালাবে ? ইসলাম যদি আধুনিক সময়ের এতটা বিরোধীই হয়, তবে মুসলমানগণ কেন নাইন ইলিভেন পর্যন্ত তাদের হামলার জন্য অপেক্ষা করল ? বিশ শতকের সূচনাকালে ইসলামী চিন্তাবিদগণ কেনই বা ইসলামী কালচার রক্ষার পরিবর্তে আধুনিক সময়ের সাথে আদান প্রদানের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় উত্থাপন করেছেন ?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।