আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যদি গঠিত হও, তবে কেন শূন্যে মিলাও!

আত্মমাঝে বিশ্বকায়া, জাগাও তাকে ভালোবেসে

আজ ১৪ জানুয়ারি, রবীন্দ্রোত্তর বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান নাট্যকার সেলিম আল দীনের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর পুণ্য স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা নিবেদন করছি। ১. কিছুকাল ধরেই মৃত্যু বিষয়টি নানা ভাবে তাড়িয়ে ফিরছে আমাকে। আমি ভাবার চেষ্টা করছি, বোঝার চেষ্টা করছি পৃথিবীর সবচেয়ে অমোঘ আর নিশ্চিত সত্যকে। যদিও অনন্তলোকে আমার পিতার ধাবিত হওয়ার স্মৃতি আমার করোটি হতে এখনো মিলায় নাই, যদিও এই মতে বিশ্বাস রাখে মন, মৃত্যু একদিন আপাত সত্যে পরিণত হবে, অমোঘ বলে তাকে আর মান্য করবে না কেউ।

কিন্তু সে কাল কোন সুদূরে ঠাঁয় প্রতীক্ষমাণ, আমি এবং আমরা তা জানি না। ভাবছি মৃত্যু কবে কোথায় গিয়ে হোঁচট খেয়েছে, হরণ করতে গিয়ে মুগ্ধ হয়েছে, বিলাপ করেছে, নিজেকে জাহিরের সুযোগ পায়নি মোটেও! অলৌকিক বোরাকে চড়িয়ে আত্মাকে নিয়ে যেতে কল্পিত চিরকালের জগতে কোন ঘরের দাওয়ায় বসে অপেক্ষায় থেকেছে! কোন সৌম্যকান্তি মানুষের সামনে মৃত্যু বড় এক উপহাস হয়ে গেছে মুহূর্তে! আমার এ ভাবনায় শুধু একটি নাম আবর্তিত হতো বার বার। মনে হতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই অমৃতের সন্তান, মৃত্যুর অমোঘতাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে যিনি পাতাল-আকাশ অব্দি দাঁড়িয়ে যান অটল, অবিচল। মনে হতো মৃত্যুর যথাযথ কোনো উদাহরণ শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথই হতে পারেন। একমাত্র মৃত্যুই তাঁর কর্ম নিবৃত্তি ঘটিয়েছিল।

আর সবার ক্ষেত্রে মৃত্যু ভীষণ প্রাত্যহিক, রুটিনমাত্র। বিশেষ কোনো অভিধা অপ্রয়োজনীয় ঠেকে। মনে হতো মৃত্যু আছে বলেই রবীন্দ্রনাথ এতো বিশাল হয়ে ওঠেন! কিন্তু আমার এমনতরো ভাবনায় হঠাৎ অন্য আর একটি নাম ঢুকে গেল সম্ভ্রমে, বিপুল সক্ষমতা নিয়ে। তিনি সেলিম আল দীন। গুরু আমার, চিরকালের জন্য উপার্জিত কষ্ট হয়েই রইলেন।

উদাহরণ হিসেবে তাঁকে এখনই দাঁড় করানোর জন্য কোনো প্রস্তুতি ছিল না আমার। প্রকৃতি আর আমার বিশ্বস্ত করোটি তার সাক্ষী রইল। ২. বাংলা নাটকের মূল সুর এবং তার গন্তব্য কি হওয়া উচিত এ বিষয়টি প্রথম অনুধাবন করেন মহান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি সে সম্ভাবনার কথা বলে গেছেন। তাঁর বিখ্যাত ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধে এ সম্পর্কে পর্যাপ্ত ইঙ্গিত রয়েছে।

বর্ণনাধর্মিতা, নৃত্য, গীত এবং নিরাভরণ মঞ্চ এসব বিষয়কে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। বাংলার নাটক প্রকৃতার্থে এসব উপদানের যথাযথ সংমিশ্রণে নির্মিত হওয়া উচিত বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আর এ লক্ষ্যে তিনি নাটক রচনা করেছেন। পাশাপাশি অভিনয় এবং নির্দেশনা এ দুটো কাজও করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আধুনিক বাংলা নাটকের প্রস্তাবক, যা দেশজ আঙ্গিককে আত্মস্থ করে দাঁড়াবে নিজস্ব পরিচয়ে।

কিন্তু সেই প্রস্তাবকে অকুণ্ঠ সমর্থনে, প্রজ্ঞা আর কর্মের মাধ্যমে বাস্তবে পরিণত করেছেন সেলিম আল দীন। মহান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পথ দেখিয়েছিলেন। মহান সেলিম আল দীন সেই বন্ধুর পথ হেঁটেছিলেন। তিনি শুধুমাত্র নাট্য রচনায় সীমাবদ্ধ থাকেননি, তাত্ত্বিক ভিত্তি নির্মাণের মতো কঠিন কাজটুকুও করেছেন। এ লক্ষেই লিখেছেন গবেষণা গ্রন্থ ‘মধ্যযুগের বাংলা নাট্য’।

যার মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন, বাংলা নাটকের ঐতিহ্য হাজার বছরের। মহান সেলিম আল দীনের সেই কর্মযজ্ঞে পাশে থেকেছে ঢাকা থিয়েটার, গ্রাম থিয়েটার এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অগণিত কর্মী-শিক্ষার্থী। বিশেষ করে তাঁর যথাযোগ্য বন্ধু নাট্য নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফ। মূলত নাসির উদ্দিন ইউসুফের হাত ধরেই সেলিম আল দীনের নাট্য ভাবনা মূর্তরূপে আবির্ভূত হয়েছে বারংবার। এ দুজনের আদর্শিক বন্ধুত্বের তুলনায় আমার শুধুমাত্র মহান কার্ল মার্কস-ফ্রেডরিক এঙ্গেলস জুটির কথাই এ মুহূর্তে মনে পড়ছে বার বার।

সেলিম আল দীন বলতেন, সব ধরনের কলোনিয়ালিজমের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। বেড়িয়ে আসতে হবে পাশ্চাত্য থেকে ধার করা নাট্য আঙ্গিকের কবল থেকে, বিশ্বে মেলে দিতে হবে আমাদের আত্মপরিচয়। তবে তা হতে হবে বিশ্বের অভিজ্ঞতাকে ধারণ করেই। নাট্য রচনার শুরু পাশ্চাত্য প্রভাবজাত হলেও সেলিম আল দীন খুব দ্রুতই নিজস্ব ঘরাণা নির্মাণের পথে অগ্রসর হয়েছিলেন, নিজের লেখার বাঁক বদল ঘটান। ফলে পাশ্চাত্য আঙ্গিক ও কৌশলে লেখা জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, মুনতাসীর, বাসন প্রভৃতির পরপরই শকুন্তলায় এসে বাঁক বদলের আভাস দিলেন।

অতঃপর সেলিম আল দীন শুরু করলেন নিজ ঘরাণার দিকে যাত্রা। লিখলেন কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল আর হাতহদাই। মহাকাব্যিক বিস্তারে লেখা এই নাট্য ট্রিলোজি এতকাল ধরে প্রচলিত এবং রচিত সব বাংলা নাটককে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। আর কে না স্বীকার করবে এ চ্যালেঞ্জে সেলিম আল দীন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছেন। এরপর ধীরে ধীরে তিনি অগ্রসর হন নিজস্ব শিল্পরীতি নির্মাণে।

লিখেন চাকা, যৈবতী কন্যার মন আর হরগজ। বল্লেন এগুলো কথানাট্য। কথার শাসনে রচিত তাই কথানাট্য। সেখানে বর্ণনা আর সংলাপ অদ্বৈতরূপে গ্রহণ করা হয়েছে। শিল্পী হিসেবে তিনি ছিলেন দ্বৈতাদ্বৈতবাদী।

কবিতা ও গান, গল্প অথবা উপন্যাস কিংবা নাটক এ জাতীয় মাধ্যমগত বিভাজন তিনি স্বীকার করতেন না। অর্থাৎ শিল্পের যাবতীয় মাধ্যমকে তিনি অভেদরূপে দেখার পক্ষপাতী ছিলেন। আমাদের অভিজ্ঞতায় এমত ভাবনার অধিকারী আর কোনো শিল্পীর নাম মনে আসে কি? তিনি লিখলেন উপাখ্যান, যাতে একাঙ্গীকরণ করেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস কিংবা নাটক। পৃথিবীর তাবৎ মহান রচনায় একাঙ্গীকরণ কিংবা ফিউশন ঘটেছে এ বিষয়ে সন্দেহ নাই। কিন্তু সচেতন করোটিতে এমত ভাবনায় কে আর এঁকেছে তাঁর শিল্প পথরেখা! বনপাংশুল, প্রাচ্য আর নিমজ্জন এসব রচনাই তার সাক্ষ্য বহন করছে।

এগুলোতেও ঘটিয়েছেন মহাকাব্যিক বিস্তার। সেলিম আল দীন কোনো বিষয় প্রমাণে এতোটাই মরিয়া এবং আপসহীন ছিলেন যে, প্রায় প্রতিটি কাজেই একাধিক উদাহরণ তৈরি করতেন। বাংলা নাটকের আধুনিক রূপ প্রতিষ্ঠায় লিখলেন কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল আর হাতহদাই। কথানাট্য আঙ্গিকে নির্মাণ করলেন চাকা, যৈবতী কন্যার মন এবং হরগজ। পাঁচালির আধুনিক রূপ প্রতিষ্ঠায় লেখেন বনপাংশুল ও প্রাচ্য।

তিনি বলতেন, অভিজ্ঞতা ছাড়া বড় নির্মাণ সম্ভব নয়। প্রকৃতি হচ্ছে সবচেয়ে বড় শিক্ষক। বিশ্ব শিল্প ধারায় ফোররিয়ালিজমের প্রথম উদাহরণ হিসাবে নিমজ্জন হাজির করার পর তিনি লিখেন স্বর্ণবোয়াল আর পুত্র। সম্প্রতি নৃত্যনাট্যগীতি উষা-উৎসব লিখে শেষ করেছিলেন। শুরু করেছিলেন মৃত্যুবিষয়ক ভাবনা-চিন্তা নিয়ে হাড়হাড্ডি রচনার কাজ।

মাথায় নিয়ে ঘুরছিলেন ময়ূরযান নামে অন্য এক রচনার পরিকল্পনা। ভীষণ অবিশ্বাস্য ঠেকে, একজন লেখকের পে কীভাবে এতোগুলো ‘মাস্টারপিস’ নির্মাণ করা সম্ভব হয়। এতো এতো নির্মাণের কোথাও কোনো বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটাননি তিনি। কী করে সম্ভব এতোটা সচেতন, নির্মোহ আর আধুনিক হয়ে ওঠা! কিন্তু তিনি সেলিম আল দীন বলেই পারেন। আমাদের বিস্মিত চোখে জীবিত যাপনেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন যেন বা পৌরাণিক কোনো চরিত্র।

তাঁকে বলতাম পুরাণ পুরুষ! শিল্পী সেলিম আল দীন লেখার বাঁক বদলের পর যা কিছু নির্মাণ করেছেন, কোনটিকেই পাশ কাটানোর সুযোগ রাখেন নি। প্রায় সবগুলো রচনাই একযোগে সুকীর্তির সার বহন করছে। বিস্ময়কর! ৩. লেখার পাশাপাশি নাট্য নির্দেশনাতেও সেলিম আল দীন তাঁর ভিন্ন ভাবনার স্বাক্ষর রেখেছেন। এক নতুন ধারা প্রবর্তনের চেষ্টাও করেছেন তিনি। ‘উপন্যাসের মঞ্চভ্রমণ’ অভিধায় সেই ধারায় দেখাতে চেয়েছেন, মাধ্যম ভিন্নতার কারণে মূল শিল্পটি যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

তার স্বাদ, রূপ, রস, গন্ধ আর মাধুর্য যেন অটুট থাকে। উপন্যাসের মঞ্চভ্রমণের মাধ্যমে তিনি হাজির করেন প্রখ্যাত কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্'র বিখ্যাত উপন্যাস ‘কাঁদো নদী কাঁদো’। কোনোরকম বিকৃতি কিংবা নাট্যরূপ ছাড়াই উপন্যাসটি মঞ্চে উপস্থাপন করেন অনিঃশেষ সক্ষমতায়। এ কাজে তিনি কিছুটা সম্পাদনা করেছেন মাত্র, কিন্তু এতে করে মাধ্যমের রূপান্তর ঘটলেও মূলের বিকৃতি ঘটেনি মোটেও। শিক্ষক সেলিম আল দীনের সান্নিধ্য উপভোগ্য ছিল সবসময়।

তাঁর বিরুদ্ধে ক্লাস না নেয়ার খুব পুরনো একটি অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে কতদিন অজস্র ক্লাস করেছি তার কোনো হিসাব জানা নাই। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন তিনি পছন্দ করতেন। একটি ক্লাস কখন কীভাবে নির্দিষ্ট বিষয়কে ছাড়িয়ে অসংখ্য বিষয়ের সমাহার হয়ে যেত ঠিক ঠাহর করা যেতো না। একঘেয়ে মনে হতো না ভীষণ জটিল আর তত্ত্বনির্ভর ক্লাসগুলোও।

এর নেপথ্যে ছিল তাঁর অসম্ভব রসবোধের বিষয়টি। ব্যাসদেব, হোমার, কালিদাস, ফেরদৌসি, আলাওল, গ্যাটে, মার্লো, তলস্তয়, চেখভ এঁদের মহান শিল্পভাবনা কিংবা মানবতা প্রতিষ্ঠায় বুদ্ধ অথবা যিশু তাঁদের যে দুর্ভোগ এসবই ছিল তাঁর চর্চিত ভুবন। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে একা রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর সমগ্র ধ্যান-জ্ঞানজুড়ে। বলতেন, ‘পরজন্মে রবীন্দ্রনাথের ভৃত্য হতে চাই। ’ গান শুনতেন শুধু রবীন্দ্রনাথের।

তোমায় নতুন করে পাবো বলে, হারাই ক্ষণে ক্ষণ..... কিংবা শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে পথের.. । সেলিম স্যার, যেকোনো বিষয়ের পক্ষে এবং বিপক্ষে সমানসংখ্যক এবং সমান প্রভাবসম্পন্ন যুক্তি উপস্থাপন করতে পারতেন। ফলে আমরা কখনো কখনো বিভ্রান্তির শিকার হতাম। কিন্তু এগিয়ে এসে তিনিই উদ্ধার করতেন আমাদের। বেঁচে থাকার শেষ সময়টুকু গান নিয়ে মেতে ছিলেন।

নিজের লেখা আর সুরে একটি অ্যালবাম বের করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন খুব। আমাকে আর মেহেদীকে সহকারী করে নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন ‘ভাঙ্গা যিশু’ নামে একটি চলচ্চিত্র। হলো না। ৪. সেলিম আল দীন দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত আন্তর্জাতিক মানুষ। শিল্পী হিসেবেও তিনি তাই।

আমাদের এইকালের একমাত্র বিশ্বমানের লেখককে আমরা হারালাম। কিন্তু কেন তিনি বিশ্বমানের? খুব সহজেই সে হিসাব মেলানো যেতে পারে। আমরা যদি তর্কের খাতিরে তর্ক না করে একান্তে প্রশ্ন করি, বর্তমানে আমাদের কোন শিল্পমাধ্যমটি বিশ্বমানের? কিংবা বর্তমান সময়ের কোন লেখক বিশ্বমানের রচনা নির্মাণ করছেন? এই দুটি প্রশ্ন প্রচল সব শিল্পমাধ্যমের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিলেই উত্তর মিলে যাবে। আমাদের বিশ্বমানের নাটক রয়েছে। প্রাচ্য-প্রতীচ্যের সমালোচক এবং বোদ্ধা শ্রেণী এই একটি বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন না।

আমাদের নাটক বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য, আন্তর্জাতিক মঞ্চে সমাদৃত। কিন্তু প্রায় সব ছাপিয়ে শুধু নাটক কেন এমনতরো আকাশমুখী হলো! উত্তর: আমাদের একজন সেলিম আল দীন আছেন। কিন্তু বাংলার লেখকদের দুর্ভাগ্য, ভাষাগত ব্যবধানের কারণে তাঁদের নির্মাণ বিশ্বের সর্বত্র পৌঁছায় না। কলোনিয়ালিজমের বিষবাষ্প আজও ভিন্ন আঙ্গিকে আমাদের পোড়ায়। নোবেল হয়তো কিছু একটা কিংবা হয়তো কিছুই না।

কিন্তু তারপরও নোবেল একটি বড় সম্মান এবং স্বীকৃতির চিহ্ন বহন করে। অনূদিত হলে সেলিম আল দীন নিশ্চিতভাবেই পুরস্কারটি পেতেন। বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতি, বাংলাদেশ সম্মানিত হতো। আমাদের ব্যর্থতা, তাঁকে বিশ্বে উপস্থাপণ করার দায়িত্বটুকু পালন করিনি। ৫. প্রকৃতি এবং রাষ্ট্র বিষয়ক সেলিম আল দীনের ভাবনা কিংবা দর্শন আপাত নিরীহ কিন্তু অন্তর্গত রূপে ভয়ঙ্কর।

প্রকৃতির নানা বিপর্যয়কে তিনি খুব স্বাভাবিক ভাবে ব্যাখ্যা করতেন। বলতেন, ‘কোথাও খড়া না দিলে প্রকৃতি অন্য কোথায় বৃষ্টি ঝরাতে পারে না। কোথাও বৃষ্টি কোথাও খড়া এটা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। বরং আমরা মানুষেরাই পৃথিবীকে খণ্ড খণ্ড করে ভিন্ন ভিন্ন মানচিত্র সৃজন করেছি। আর তাতে করেই কোনো মানচিত্রে ধূ ধূ মরুভূমি, কোথাওবা মায়াবী শ্যামলতা।

’ রাষ্ট্র সম্পর্কে বলেছেন তীর্যক কিছু কথা। নিমজ্জনে আমরা তাই দেখতে পাই, জাতিসংঘকে তিনি রাষ্ট্রসংঘ আখ্যা দেয়ার পক্ষপাতী। কেননা, আধুনিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ বসবাস করতে পারে। জাতিসংঘে কোনো জাতি নয় রাষ্ট্র প্রতিনিধিত্ব করে। ফলে জাতির সমন্বয়ে সংঘের যে কনসেপ্ট তা আর রইলো না।

আবার নিমজ্জনেই তিনি পঙ্গু অধ্যাপকের মাধ্যমে বলছেন, আধুনিক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে, সম্মান করে। ফলে শেষ উপনিবেশ থাকার সময় পর্যন্ত ব্রিটেন রাষ্ট্র ছিল না। কী অদ্ভুত! ৬. সেলিম আল দীন বলতেন, কখনো শিল্পদেবী ত্যাগ করলে, মরণ যেন নিকটবর্তী হয়। আমার গুরু তিনি। কোনো এক ভুল বোঝাবুঝির অবকাশে বলেছিলেন ‘ক্ষমা, সেতো আকাশ সমান।

’ গুরু, বুঝে কিংবা না বুঝে করেছি এতোসব অপরাধ, আপনি ক্ষমা করেছিলেন তো? গত বছরের প্রথমদিন, অর্থাৎ ১ জানুয়ারি স্যারের সঙ্গে শেষ দেখা। সেদিন ছিল আমার জন্মদিন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের ৩য় তলায় বিভাগের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। নিচ তলায় স্যার দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাকে দেখতে পেয়ে ডাকলেন।

আমি নেমে গিয়ে তাঁকে সালাম করলাম। নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অন্য এক শিক্ষকও স্যারকে সালাম করলেন। তাঁরা দুজনেই বিভাগের মাস্টার্স পরীক্ষা এবং এ সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। আমি বিভাগের জুনিয়র বন্ধু ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম। কিছুক্ষণপর শুনতে পেলাম গুরুগম্ভীর কণ্ঠে আমাকে কে যেন ডাকছেন।

পেছনে তাকাতে তাকাতে বুঝলাম স্যার ডাকছেন। তিনি দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছেন আর আমাকে বলছেন, ‘নদীর বোয়াল। দুপুরে বাসায় আমার সঙ্গে খাবি। ’ পরক্ষণেই মাইমের ভঙ্গিতে ডান হাতের আঙ্গুলগুলো একজায়গায় করে মুখের কাছটায় নিয়ে খেতে যাওয়ার ভঙ্গি করলেন। হয়তো তাঁর মনে হচ্ছিল আমি কথাগুলো শুনতে পাইনি।

তাই নাট্যগুরু আমার জীবনের শেষ সাক্ষাতেও নাটকের ভাষাতেই যোগাযোগ করে গেলেন। সেদিন স্যারের সঙ্গে আর খাওয়া হয়নি। ১০ জানুয়ারি রাতে তিনি প্রথম অসুস্থ হন। ১২ তারিখ রাতে তাঁকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। হাসপাতালে থাকতে থাকতে একান ওকান তথ্য মেলাতে মেলাতে একসময় বুঝে যাই, স্যার আর এই জনমে ফিরবেন না।

১৪ তারিখ ভোরে ক্যাম্পাস থেকে ঢাকায় আসে চিন্ময়ী (নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ছাত্রী)। ৪ তলায় স্যারকে দেখে এসে আমাকে বলে, 'সকালে কালীপূজো করে এসেছি। পূজোর একটি জবাফুল স্যারের পায়ে ছুঁইয়ে দিয়েছি। দাদা, তুমি দেখো স্যার ভালো হয়ে যাবেন। ' স্যারের ভাগ্নে সজীব, একান্ত সচিব স্বকৃত নোমান সবাই বলেছিল, স্যার ভালো হয়ে যাবেন।

আমিও বিশ্বাস করেছি তিনি ভালো হয়ে উঠবেন। কিন্তু হায়! যুক্তি বলছে, তিনি আর ফিরবেন না ধূলিধূসর মায়াময় এই পৃথিবীতে। আবেগ বলছে, ফিরে আসুন, ফিরুন, ফিরতেই হবে। রাতজাগা সঙ্গী বগুড়ার রুবল ভাই ক্ষণে ক্ষণে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ‘খোদা ফিরায়ে দাও!’ ভাবি, আহা! যদি গঠিত হও, তবে কেন শূন্যে মিলাও! আমি বুঝে যাই সময় শেষ হয়ে আসছে। নয়ন আর রুমনকে (দুজনেই নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র) বলি, আমাকে একটি ব্লাঙ্ক মেসেজ পাঠাস।

অতঃপর বিকালে সব শূন্য হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিতবাহী মেসেজ পেয়ে পালাই জন্মভূমে মায়ের কাছে। আমার শিল্পগুরু সজীব, দৃঢ় আর সৌম্যকান্তি। তাঁর অন্তিম শয়ানের দৃশ্য আমার জন্যে নয়। আমি আজন্ম সেই সচল, গম্ভীর অথচ প্রশ্রয়সুলভ কণ্ঠকেই শুনে যেতে চাই স্মৃতিতে বিস্মৃতিতে। তাই পালাই, দূরে যাই, দূরে গিয়ে প্রতিক্ষণে তাঁকেই তো আরও নিবিড় করে পাই।

মৃত্যুঞ্জয়ী শিল্পী কালের কুমার সেলিম আল দীন দেহান্তরিত মাত্র। লোকান্তরিত নন মোটেও। সৃষ্টি আর কর্মের হাত ধরে কাল থেকে কালান্তরে তিনি বাহিত হবেন প্রবল শক্তিতে আর সম্মানে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।