কেবলই নিজেকে খুঁজছি
বাঁশঝাড়ে পাখির কিচিরমিচির শব্দ, লালুর ঘেউ ঘেউ চিৎকার আর প্রতিবেশীদের মোরগের সুউচ্চ কক্ কক্ কক্ ধ্বনি সকাল হবার ইঙ্গিত দিচ্ছে। রাতে কখন ঘুমিয়েছে মনে নেই মনীশের। ঘুম ভাঙলে নিজেকে আবিষ্কার করলো এক নারীর বুকের ওপর হাত দিয়ে শুয়ে আছে। নারীও তার গলা জড়িয়ে ধরে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। যদিও ঘর এখনও অন্ধকার তবুও এই দৃশ্যটির নায়ক সে ভাবতেই নিজের কাছে লজ্জা লাগছে মনীশের।
বলতে গেলে সদ্য পরিচিত এক নারী। মাত্রই কয়েকদিন আগে পরিচয়, আংটি বদল অতঃপর বিয়ে। আর এখন সে সেই নারীর পাশে শুয়ে আছে। তবু আবার ঘনিষ্ঠ হয়ে। চোখ খুলতে ইচ্ছা করছে না।
রাতে কখন ঘুমিয়েছে কে জানে! বাতি নিভে গেল, তারপর অনেকণ দুজনে মিলে গল্প, কত রকমের গল্প, তারপর রাত যখন গভীর হলো, চারপাশে প্রাণের স্পন্দন থেমে গেল, পাথরের মত ভারী হয়ে এলো নীরবতা, তখন...ছিঃ ছিঃ। এখন নিজের কাছেই লজ্জা লাগছে। এমনটা এতদিন শুধু স্বপ্নে ভেবেছে যৌবনের তাড়নায়। কত স্বপ্ন দেখেছে, কত রঙে রঙিয়েছে স্বপ্নগুলো। আর এখন বাস্তব সত্যের সঙ্গে বসবাস।
কিন্তু স্বপ্ন দেখতে লজ্জা লাগতো না। সত্যে এতো লজ্জা কেন? রাতের অমন ঘটনার পর সকালের আলো ফুঁটলে পাশের এই নারীকে মুখ দেখাবে কি করে? না, নারী নয় বধু। এই নারী এখন তার স্ত্রী। সমাজ সম্মত স্ত্রী। আইন সম্মত নয়।
কেননা হিন্দুদের বিয়েতে আইনগত ব্যাপার নেই। আইনের ব্যাপারে হিন্দু সমাজ প্রণেতাদের বড় ভয়। শেষে যদি হিন্দু নারীরা তাদের ন্যায্য অধিকার চেয়ে বসে। নারীরা রান্নার খুন্তি ছেড়ে ব্যানার হাতে রাজপথে নেমে তাদের অধিকারের দাবি করে বসে! এই ভয়েই হিন্দুরা বিয়ের মধ্যে আইনগত ব্যাপার আনেনি। সমাজ বিধানেই চলছে।
স্বামীর অত্যাচারে স্ত্রী ঘরের কোনে বসে চোখের জরে বুক ভাসালে তাতে সমাজপতিদের কি আসে যায়!
এই নারী হলোই বা মনীশের স্ত্রী। কি সুন্দর নাম দেবলীনা। লেখাপড়ায় তো তার সমান। আবার একটি কলেজে চাকরিও করছে। এমন একজন সুশিক্ষিতার সঙ্গে রাতে সে ব্যাহায়াপনা করেছে।
সকালে উঠে সে দেবলীনাকে কি বলবে? গুড মর্নিং? অসম্ভব। দেবলীনার চোখের দিকেই সে তাকাতে পারবে না। তার চেয়ে ভাল আগে দেবলীনা উঠুক তারপর সে উঠবে। কিন্তু একসময় তো দেবলীনার মুখোমুখি হতেই হবে। মুখোমুখি হতে হবে ম-বাবা, ভাই-বোন, আত্নীয়-স্বজন, প্রতিবেশীর।
সে যখন দরজা খুলে বের হবে সবাই তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। ঠাট্টার সম্পর্কীয় বৌদি বা অন্যরা সবার সামনে ঠাট্টা করবে। উঃ কি লজ্জা! এমন পরিস্থিতিও কপালে ছিল। আটাশ বছর বয়স হলেও মা-বাবার কাছে কত ছোট ছিল সে। কত দুষ্টুমি, কত আবদার, কত ছেলেমিপনা করেছে এতদিন।
আর আজ হঠাৎ করে সে বড় হয়ে গেল। এমনই বড় যে একটি পূর্ণবয়স্ক নারীকে নিয়ে এক ঘরে, এক বিছানায় রাত কাটালো। মা-বাবার সামনে দাঁড়াবে কি করে সে! যে বাবা ছোটবেলায় চুন থেকে পান খসলেই কত মেরেছে, শাসন করেছে।
কাস সেভেনে থাকতে পাশের বাড়ির এক মেয়েকে চোখ মেরেছিল সে। সেই মেয়ে তার মাকে বলে দিয়েছিল।
তার মা আবার যথাসময়ে পৌঁছে দিয়েছিল বাবার কানে। তারপর যা হবার তাই হলো। মার। বাপরে বাপ কি মারটাই না মেরেছিল বাবা। শুধু মেরেই ক্ষান্ত দেননি।
সেই মাঘ মাসের কড়া শীতের রাতে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন। তারপর অনেকণ পর বাবা ঘুমালে মা এসে ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন মনীশ লজ্জায় অপমানে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। প্রতিজ্ঞা করেছিল জীবনে আর কোন মেয়েকে চোখ মারবে না, কোন মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে না। প্রথম প্রতিজ্ঞাটা টিকলেও দ্বিতীয়টি প্রতিজ্ঞাটা কলেজে ওঠার পর আর টেকেনি।
আর আজ সেই একই মনীশ চোখ মারা আর কি এমন কাজ একজন পূর্ণ বয়স্ক নারীকে নিয়ে এক বিছানায় সারারাত ঘুমালো তবু বাবা কিছুই বললেন না। অমন রাগী বাবা, কোথায় গেল তাঁর রাগ! আজ হঠাৎ-ই ছেলেকে বড় ভাবতে শুরু করেছেন তিনি। আবার কাল কেমন আদর মাখা কন্ঠে দেবলীনাকে বলছিলেন, বৌমা, খেয়েছ? অথচ তাকে একবারও জিজ্ঞাসা করেনি, মনীশ খেয়েছিস কিনা। বাবা বোধ হয় ভাবতে শুরু করেছে, ছেলে বড় হয়েছে। এখন সে নিজেই গুছিয়ে খেতে পারবে।
নাকি বাবা তার কাছ থেকে দূরে সরে গেলেন! ছেলের ভার অন্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে কিছুটা নির্ভার হলেন তিনি? আর মা! মাও কি তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন? ছেলের বিয়ের পর মা-বাবা কি ছেলের কাছ থেকে দূরে সরে যান! কথা-বার্তায় আগের সেই নৈকট্য আর থাকে না! মনীশের কান্না পেয়ে গেল। মাত্র দু-দিন আগেও সে ছোট ছিল। আর এত তাড়াতাড়ি সে বড় হয়ে গেল। ছোট থাকাই ভাল ছিল। বড় হবার বিপদ অনেক।
মা-বাবা কাছে সে বড় হতে চায় না। ছোটই থাকতে চায়। মাঝখানে একটি মেয়ে এসে সব গড়বড় করে দিল।
বাইরে কাজের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। মনীশ কান পাতলো।
হ্যাঁ, মায়ের গলা। বাবা, দিদি, দাদা, অন্যান্য আত্নীয়-স্বজনদের গলাও পাওয়া যাচ্ছে। দেবলীনা বিছানায় উঠে বসলো। ঘর এখনও অন্ধকার। মনীশ চোখ বুজেই অনুভব করলো, দেবলীনা তার চুলে হাত বুলিয়ে কপালে চুম্বন করলো।
মেয়েরা কি এভাবে চুরি করে স্বামীকে ভালবাসে, আদর করে! দেবলীনা হয়তো ভেবেছে সে ঘুমিয়ে আছে। দেবলীনাকে কি সে জানতে দেকে যে সে জেগে আছে। সেও কি দেবলীনাকে জড়িয়ে ধরে একটু আদর করে দেবে। না, দরকার নেই। দেবলীনা হয়তোবা লজ্জা পাবে।
সে যেমন লজ্জা পাচ্ছে। তেমনি দেবলীনাও তো লজ্জা পেতে পারে।
জানালা খুলে দিল দেবলীনা। সূর্য এখনও না উঠলেও আলোর আভা এসে পড়লো ঘরে। মনীশের মুখেও।
মনীশ ঘুমের ভান করেই পড়ে রইলো। দেবলীনা মুচকি হেসে দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে।
আরও কিছুণ কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলো মনীশ। সম্পর্কে বৌদি, এক মহিলা এসে গায়ের কম্বল ফেলে দিয়ে বললো, কি ঘুম ভাঙে না! একদিনেই এই অবস্থা। জলদি ওঠ।
কাপড় ছেড়ে বাইরে এসো।
মনীশ বলরো, কেন আবার কি?
বৌদি বললো, আছে কাজ আছে। বোঝ বিয়ে কত ঠেলা!
মহা যন্ত্রনা! সে আছে তার নিজের জ্বালায়। তার ওপর এদের আনুষ্ঠানিকতাই শেষ হচ্ছে না। গত তিন-চার দিনের আচার-অনুষ্ঠানে সে হাঁপিয়ে উঠেছে।
আর কাহাতক সহ্য হয়!
বাইরে বেড়িয়ে এলো মনীশ। কারো দিকে তাকাতে পারছে না লজ্জায়। সবাই কেমন করে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ হাসছে। বাবার সঙ্গে একবার চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিল মনীশ।
মা দূরে দূরে আছে। ঠাট্টার সম্পর্কীয় আত্নীয়রা তাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে। নিজেকে পুতুল মনে হচ্ছে মনীশের। সে তাড়াতারি সবার সামনে থেকে সরে পড়লো। উঠোনের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দেবলীনার সাথে একবার চোখাচোখি হলো।
দুজনেই তাড়াতারি চোখ নামিয়ে নিল। ইস, দেবলীনার চিবুকের কাছে একটু সিঁদুর লেগে আছে। লোকে দেখলে কি ভাববে! এতনে দেখেছে তো নিশ্চয়। ও বোধ হয় খেয়াল করেনি। পুকুর ঘাটে গিয়ে বসলো মনীশ।
পুকুর ঘাটে বসে জলের দিকে তাকিয়ে আছে মনীশ। কে যেন বলেছেন নদীর কাছ থেকে, জলের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। মনীশের মনে হচ্ছে জল যদি নিজেকে অদৃশ্য হওয়া শেখাতো! তাহলে সবার চোখের আড়ালে থাকতে পারতো সে। আবার ভাবনায় ডুব দিল মনীশ। মিথ্যেই সে লজ্জা পাচ্ছে।
যুগ যুগ ধরে এমনই তো হয়ে আসছে। তার ঠাকুরদাও নিশ্চয় তাঁর বাবা-মায়ের সামনে এভাবেই বড় হয়েছে। আবার রাগী বাবাও ঠাকুরদা-ঠাকুমার সামনে এভাবেই বড় হয়েছে। সেও একই ভাবে বড় হলো। আবার কোন একদিন তার নিজের ছেলেও হয়তো তার এবং দেবলীনার সামনে এভাবেই বড় হবে।
মনীশ দেবলীনা বুড়ো হবে। বয়সের ভারে জীর্ণ-শীর্ণ মনীশ-দেবলীনা একদিন এই পৃথিবীর শরীরের ভাঁজে হারিয়ে যাবে। সেদিন হয়তো তারই মতো নতুন মনীশ পুকুর ঘাটে বসে ভাববে। নতুন এক দেবলীনা চিবুকে সিঁদূর নিয়ে ঘুরবে। আর লাজুক চোখে ক্ষণে ক্ষণে স্বামীর দিকে তাকাবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।