যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি
নির্বাচনের রাজনীতিতে বেশ কিছু ভানুমতির খেল আছে। বিভিন্ন সময়ে সেই সব খেল বিভিন্ন পদ্ধতিতে জনগণের সামনে হাজির হয়। গড় মাপের বুদ্ধির জনগণ সেই খেলাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। তারা এটাকে নির্বাচনের আরো একটা পদ্ধতি বা কায়দা ধরে নিয়ে ভ্যাবলাকান্তের মত ভোটটা দিয়ে আসেন। আর নিয়ম মত রাজনীতিবিদরা সেই ভোটের মহাত্ম ইনক্যাশ করেন।
এর কোন আমলযোগ্য ব্যতিক্রম নেই। ছিলও না কোন কালে। এবার যে নির্বাচন প্রায় ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে,সেখানেও এই মারফতিচালের কোন ব্যতিক্রম হবে না বলেই এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে।
গত প্রায় একবছর ধরে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম নিজেদের মোটামুটি একটা বার্গেনিং পাওয়ার ধরে নিয়ে বেশ জোরেশোরেই মাঠে নেমেছিল। মনে করা হয়েছিল,এবার যদি কিছু একটা হয়! এই ‘কিছু একটা’ জিনিসটা কি? সেটা হলো,মানুষ এমন একটা বিশ্বাস তাদের ওপর রাখতে চাইছিল যে,তারা এবার ঠিকই যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সঙ্গবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন।
কেননা,তাদের ওপর মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তিটা তৈরি হয়েছিল তাদের অতীত গৌরবোজ্জল ইতিহাসের কারণে। সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের প্রায় সব কর্মকর্তাই এক একটি সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেই হিসেবে তাদের দেশপ্রেম বা তাদের যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি ঘৃণা অন্য আর যে কোন সাধারণ মানুষের চে’ বেশী। এবার এরা যখন মাঠে নেমেছেন,তখন কিছু একটা তো হবেই!
হা-হতোষ্মি! কি দেখলাম আমরা? তাদের আন্দোলন,ক্যাম্পেইন চলাকালিনই যুদ্ধাপরাধী জামাত এবং ওই ঘোট এর সব ক’টি দল জরুরি আইনের ভেতরই হুমকি-ধামকি দেওয়া শুরু করল। তারা এমনও বলা শুরু করল যা সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের নেতাদের বরদাশত হবার কথা নয়,কিন্তু আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম মুক্তিযুদ্ধের সেনাধিনায়করা একটু প্রতিবাদ-ট্রতিবাদ করেই সব মুখ বুজে মেনে নিলেন! কেন তারা মেনে নিলেন? সে এক কোটি টাকা দামের প্রশ্ন।
সাধারণ মানুষ,চাষা-মজুর,বেকার ছাত্র-যুবক যারা একাত্তরে প্রাণটা হাতে করে যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা তখনো ছিল পেছনের সারির আনপড় গন্ড বা অপগন্ড, এখনো তাই। হাল,বৈঠা,কোদাল,কাস্তে,মাথাল,কামারের হাতুড়ি ছেড়ে রাইফেল তুলে নেওয়া সেই সব মানুষেরা নয় মাসের যুদ্ধ শেষে আবারো ফিরে গেছিল নিজের সেই চেনা জায়গায়। সেই চষা ক্ষেতে। সেই কামারের হাপরের কাছে। সেই ধানক্ষেতে।
সম্বল কি ছিল? স্মৃতি,কিছু তরতাজা জ্বলজ্বলে স্মৃতি! ব্যাস! এর বিপরীতে তখনকার সেক্টর কমান্ডার বা তার নিচের স্তরের নেতা বা কমান্ডার অথবা কর্মকর্তারা যুদ্ধ শেষে যারা যারা খেতাব-টেতাব পেলেন, তারা তো পেলেনই, আর যারা না পেলেন তারাও কোন না কোন ভাবে সরকারের,পাওয়ারের বেনিফিশিয়ারি হলেন। সেই সন্মানিত,নিরাপদ আয়েশি জীবন থেকে তাদের তো একটি বারের জন্যও পথে নামতে হয়নি! তাই পথে নামার চরম বাস্তবতা তো তাদের ফেস করতে হয়নি। যে কারণে শেষ পর্যন্ত তাদের পুরো আন্দোলনটাই হয়ে উঠেছিল নির্বিষ এক বৈঠকি আন্দোলনের মত।
এর পর পরই আরো বেশ কিছু সংগঠন যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে বলে মাঠে নেমেছিল। সেই সাথে কয়েকটি রাজনৈতিক দলও এই একই দাবী নিয়ে সোচ্চার হয়েছিল,কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি দেখা গেল? সেই থোড় বড়ি খাড়া-খাড়া বড়ি থোড়! সর্বশেষ দেখা গেল আরো একটি সংগঠন সোচ্চার হয়ে বলেছে “এবারের নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের ভোট না দিয়ে পরাজিত করে তাদের বিচার করার সুযোগ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে শহীদদের ঋণ শোধ সুযোগ এসেছে।
ভোটারদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে তারা বলেছেন, আপনারা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হোন, স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো সংসদীয় আসনে যেন যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতাবিরোধী ও তাদের দোসররা জয়ী হয়ে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত জাতীয় সংসদকে কলঙ্কিত করতে না পারে। ”
এই পর্যায়ে শুধুমাত্র এই একটি দাবী জানালেই কি যুদ্ধাপরাধীদের সংসদে যাওয়া ঠেকানো যাবে? এখানে একটা ব্যাপার কেন আমলে আনা হচ্ছে না যে, এই জামাত তথা যুদ্ধাপরাধীদের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা আছে বিএনপি নামক দেশের আর এক বৃহত্তম দল। এবং এই দলটি নিজেদের স্বার্থে জামাতকে সাথে নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি,তাকে নিয়ে মন্ত্রিপরিষদে বসিয়েছে। দুটি মন্ত্রিত্ব দিয়েছে। আবার তাদের (জামাতের) এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকেও ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিধা করেনি।
এবারো তারা জামাতকে চল্লিশটা আসন ছেড়ে দিয়েছে। এবারো বিএনপি বৈতরণী পেরুনোর জন্য জামাতের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে। পান্তরে বলা চলে উল্টে জামাতই বিএনপির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে চাইছে। আখেরে হবেও তাই। সুতরাং যদি সত্যিকার অর্থে সংসদকে যুদ্ধাপরাধী মুক্ত করতে হয় তাহলে বিএনপি-জামাত দুই দলকেই সংসদে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করতে হয়।
এটা কি কারো পক্ষে সম্ভব?এটা কি কোন একটি বা একাধিক সংগঠনের পক্ষে বাস্তবায়ন সম্ভব? এর সহজ উত্তর-না।
কিন্তু আমরা জানি। জানি যে,সামান্য কয়েকটি বিষয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলো এক হয়ে কয়েকটি কঠোর পদক্ষেপ নিলেই জামাত তথা যুদ্ধাপরাধীদের সংসদে আচ্ছুৎ করা সম্ভব হতো। কি সেই কর্মসূচী?
১। প্রচলিত আইনি কাঠামোয় যুদ্ধাপরাধের বিচার না করা গেলে বিশেষ আদালত বা বিশেষ বিচার ব্যবস্থা অথবা বিশেষআইন জারি করে তাদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হতো।
আসলে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন ছাড়া সেটা সম্ভবও না।
২। বিচারে যেহেতু তারা নিশ্চিতভাবেই যুদ্ধাপরাধে অপরাধী হতো,তখন নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ অনিশ্চিত করা যেত।
৩। নির্বাচন কমিশন কারো কোনরকম সাহায্য সহযোগীতা ছাড়াই যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে পারত।
আর সেটা তারা করতে বাধ্য হতো প্রবল বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর চাপে,এবং প্রবল গণজাগরণের চাপে।
৪। বড় রাজনৈতিক দল দুটি যদি প্রতিজ্ঞা করত যে তারা কোনভাবেই যুদ্ধাপরাধীদের সাথে জোট গড়বে না। সেক্ষেত্রে তাদের সংসদে যাওয়া ঠেকানো যেত।
৫।
যে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম এর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলরা এখন আন্দোলন করছেন তারা যদি তাদের বর্তমান সেনা সদস্যদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন তাহলে তারাই যুদ্ধাপরাধীদের নির্মূলে সহায়তা করতে পারত।
কার্যক্ষেত্রে এর কোনটাই হয়নি। হয়না। শেকড়ের সাথে সম্পর্কহীন আন্দোলন কখনোই তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারে না। ইতিহাসে এমন কোন নজিরও নেই।
অথচ আমরা দেখি সেই চল্লিশের দশকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে এখনো কিভাবে সেই নাজি যুদ্ধাপরাধীদের খুঁজে খুঁজে বের করা হয়। কিভাবে তাদের যুদ্ধাপরাধের জন্য বিশেষ আদালতে হাজির করা হয়। আর এই টোটাল ফ্রেমওয়ার্কটা করা হয় রাষ্ট্রের সহায়তায়। কোন একজন নাজি রাষ্ট্রের কোন একটা সেক্টরের নিজের নাজি পরিচয় গোপন করতে পারে না। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে,এই বাংলাদেশে রাষ্ট্র সয়ং যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন তো দেয়ই,তাদের জামাইআদরও করে! যেখানে রাষ্ট্র এবং সরকার তথাকথিত প্রটোকলের দোহাই দিয়ে চরম ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের ডেকে নিয়ে চায়ের আয়োজন করে, হাসিমুখে করমর্দন করে,আদর করে পাশে বসায়, সেখানে এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বা তাদের সংসদে না নেওয়া বা তাদের বর্জন করার ঘোষণা নেহায়েতই হাস্যকর শোনায়।
হরিদাসের গোয়ালে কি না থাকে! আমাদের এই মহামচ্ছবের মাহেন্দ্রক্ষণে, আমাদের এই নীতিহীন নীতি কপচানোর যজ্ঞে,আমাদের এই হিপোক্র্যাসির উত্তুঙ্গ জজবায় আমরা সবই মেনে নিয়েছি। তবে মাঝে মাঝে আমাদের ভেতরকার বিবেক-টিবেক একটু-আধটু খোঁচাখুঁচি করে উঠলে আমরা ক্ষণিকের জন্য বিপ্লবী হয়ে যাই। অথবা আমরা মানুষের চোখে যে চিরস্থায়ী ঠুলি পরিয়েছি, সেই ঠুলিটাকে আরো এক প্রস্থ মজবুত করে আরো মোক্ষমভাবে পরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। আর এসবের জন্য আমাদের হাতের সামনে রয়ে গেছে "পড়েপাওয়া দুআনার" মত একাত্তর আর মুক্তিযুদ্ধ। যাকে আমরা গত সাঁইত্রিশটা বছর ধরে ইনক্যাশ করে খাচ্ছি।
নির্লজ্জ বেহায়া বেলাজ মানুষেরা কি অদ্ভুৎভাবে স্থানুর মত ঠায় দাঁড়িয়ে আছে পায়ের তলায় মৃতলাশ নিয়ে। লাখো কংকালের পাঁজড়ে পাঁজড়ে খটখট শব্দে টানা বেজে চলেছে বেঈমানীর মন্দীরা। গলিত পঁচা মাংশ মেশা মাটিতে উর্বর হয়ে ফলেছে নির্লজ্জ ছেনালীর দ্রাক্ষাফল। সেই দ্রাক্ষারসে আপ্লুত প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। বিবমিষা কালো,ঘোর কালো এক রাত্রী আমাদের আয়ূষ্কালকে ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে নিরন্তর।
অজানা কু’হকের ডাকে ছুঁটে চলা সেই অনির্বাণ মানব-মানবীরা ধীর পায়ে এখনো এসে দাঁড়ায় আঙ্গিনা পাশে। অপেক্ষায় থাকে স্মরণের ক্যানভাসে কেউ কি আঁকে কিছু? নাহ ! কেউ তো নেই কোথাও! সবই তো গরল! কাল থেকে কালান্তরে যে মানুষ স্মৃতি হাতে ছুটে চলেছে দুরন্ত বেগে, সেই অক্ষয় মানবাত্মাকে কে বরণ করেছে? নেই। কোথাও কোন বরণের ইতিহাস নেই। যা আছে তা এই সমাধীতে আরো নতুন নতুন লাশের আয়োজন আর লাশের স্তুপে প্রজ্জলিত শিখা জ্বালিয়ে সেই আগুনে খুঁচিয়ে ছাই বের করা আর সেই মৃত মানুষের লাশস্তুপের ছাইয়ে কেবলই অমূল্যরতন খোঁজা। মোহর খোঁজা।
লেখাটা ২২ ডিসেম্বর ০৮, ভোরের কাগজে ছাপা হয়েছিল। সামহোয়ারইন এর পাঠকদের জন্য এখানে প্রকাশ করা হলো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।