কেবলই নিজেকে খুঁজছি
হাতের বিড়িটা শেষ হতে হতে একেবারে তুলোর দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছে। তবু তাতেই ইঁদূরমুখো হয়ে দুটো টান মেরে অবাধ্য শিশুর মতো ঘাড় গুঁজে ধরলো মাটিতে। ছোট্ট উঠোনের একপাশে অন্ধকারে উনুনের পাশে বসে একের পর এক বিড়ি ফুঁকছে আফসার মিয়া। আর মাঝে মাঝে নিজের পা চাপড়ে মশা তাড়াচ্ছে। কোমরের লুঙ্গির ভাঁজ থেকে আরেকটা বিড়ি বের করে ঠোঁটে পুরে তাতে আগুন জ্বাললো।
কয়েক মুহূর্তের জন্য আফসার মিয়ার বিশ্রি মুখখানা আলোকিত হয়ে উঠলো। পান বিড়ির অত্যাচারে কুৎসিত কালো দাঁত। মুখ ভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি-গোঁফ। কোটরাগত চোখ। বিড়িতে দুটো টান মেরে রাস্তার দিকে টর্চের আলো ফেলে বললো, কিডা?
আমি আর মজনু চাচা।
আমি'র গলার স্বর চেনা আফসার মিয়ার। সর্বনাশ! মোল্লা বাড়ির আয়নাল মোল্লার ছোটছেলে জয়নাল। উঠতি বয়সের জোয়ান ছেলে। প্রায়ই আসে।
জয়নাল বললো, চাচা, অন্ধকারে বসে আছো যে..........।
আফসার মিয়া টর্চ জ্বেলে ইঙ্গিত করলো চুপ করার জন্য। ততক্ষণে জয়নাল আর মজনু আফসার মিয়ার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আফসার মিয়া গলা নামিয়ে বললো, তুমরা খানিক পড়ে আসো। একজন মুরুব্বি আছে। তুমাগের দেকলি লজ্জা পাবেনে।
জয়নাল আর মজনু তাড়াতারি রাস্তায় উঠে পড়ে। তাদের পায়ের আওয়াজ ক্রমশ মিলিয়ে যায়। আফসার মিয়া আবার বিড়ি ফুঁকতে থাকে। আর মাঝে মাঝে খুক খুক করে কাশে।
আফসার মিয়ার বয়স খুব বেশি নয়।
পঞ্চাশ পেরিয়েছে মাত্র। কিন্তু বার্ধক্য এখনই পেয়ে বসেছে তাকে। মুখের কাঁচা-পাকা দাড়ি-গোঁফ তাকে আরও বৃদ্ধ বানিয়ে দিয়েছে। একটা সময় মানুষের বাড়িতে কাজ করতো সে। এখন আর মানুষের বাড়িতে কাজ করার মতো জোর শরীরে নেই।
নানা রোগে জরাজীর্ণ শরীর।
প্রথম স্ত্রী অসুখে মারা যাবার পর আবার বিয়ে করেছে আফসার মিয়া। প্রথম পক্ষের এক মেয়ে ছিল লতিফা। লতিফার বিয়ে হয়েছে চৌদ্দ গ্রামের আজিজ শেখের ছোট ছেলে মজিদ শেখের সাথে। বাল্যবিবাহ।
উনিশ বছরেই তিন সন্তানের জননী সে। দ্বিতীয় পরে স্ত্রীর নাম ময়না। তার গর্ভে কোন সন্তান হয়নি। কত কবিরাজ, পীর-ফকিরের কাছে নিয়ে গেছে আফসার মিয়া। কত গাছ-গাছড়া, তাবিজ-কবজ কিছুতেই কিছু হলো না।
বরাট গ্রামের সবুরফকির কত টাকা নিল। তাবিজ-কবজ, গাছের শিকড়-বাকর দিয়ে বললো, নে এবার কাম হবেনে। সামনের পূর্ণিমার রাতে মিলিত হবি।
কই! কিছুই হলো না। মধুপুরের বড় পীরও কম টাকা খায়নি।
কিন্তু সেখানেও কিছুই হলো না। শেষে সন্তানের আশা ত্যাগ করেছে আফসার মিয়া।
ময়নার বয়স এখন পঁয়ত্রিশ। গায়ের রঙ একটু কালো হলেও শরীরের গড়ন বেশ মজবুত। দুজনের সংসারে ময়নার শরীর ছাড়া আর কিই বা আছে! রাস্তার পাশে অল্প একটু জমিতে ছোট এক ছাপড়ার নিচে দুজন থাকে।
সে ছাপড়ার অবস্থাও আফসার মিয়ার মতোই জরাজীর্ণ। ঘরে রোদ-বৃষ্টির অবাধ যাতায়াত। পাটকাঠির বেড়া দিয়ে কুল নেই। উইতে খায়। গত শীতের আগে নিধুবাবুর কাছ থেকে পাটকাঠি চেয়ে উত্তরের বেড়াখানা দিয়েছিলো।
নইলে শীতের দিনে উত্তরের বাতাসে টেকা দায়। খোলা মাঠের পাশে বাড়ি। শীত একেবারে হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। এবার আবার দক্ষিণের বেড়াখানার অবস্থা খারাপ। নিচের দিকে ভাঙা জায়গাটা খানিকটা ছেঁড়া তাঁবু দিয়ে রেখেছে।
অবশ্য আয়নাল মোল্লা আশ্বাস দিয়েছে কিছু পাটকাঠি দেবে।
আয়নাল মোল্লার কাশির শব্দে সজাগ হয় আফসার মিয়া। এতক্ষণ চুলার পাশে বসে বসে ঘুমে ঢুলছিল।
জয়নাল ক্যান আইছিল রে? প্রশ্ন করে আয়নাল মোল্লা।
প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে যায় আফসার মিয়া।
কথা খুঁজে পায় না। সে ভেবেছিল ভাবের রাজ্যে থেকে আয়নাল মোল্লা হয়তো জয়নালের কথা শুনতে পায়নি।
কিরে কতা কইস নে ক্যান? অন্ধকারে আফসার মিয়ার মুখের দিকে তাকায় আয়নাল মোল্লা।
ওরা রাস্তা দিয়ে যাতেছিল। আমি-ই লাইট মারে কলাম যায় কিডা।
আয়নাল মোল্লার গলার কঠোর হয়, আমার কাছে কলাম সত্যি কতা কইস আফসার। ওকি রাস্তা দিয়ে যাতেছিল না ও-উ আসে।
না, না। কি কন আয়নাল ভাই। জয়নাল আপনার ছাওয়াল।
আমাগেরও ছাওয়ালের মতোন।
আর কিছু বলে না আয়নাল মোল্লা। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপর টর্চের আলোয় শূকর তাড়ানোর মতো অন্ধকার তাড়াতে তাড়াতে রাস্তা ধরে হাঁটা দেয়।
কোমর থেকে আরেকটা বিড়ি বের করে আগুন ধরায় আফসার মিয়া।
নিধুবাবুর বাঁশবাগান থেকে পাখির ঝাঁক কিচির-মিচির করে ডেকে ওঠে। জোনাকীগুলো বাঁশঝাড়ের বাইরে এসে গোল্লাছুট খেলছে। আধ-খাওয়া চাঁদ বেশ আগেই ডুবে গেছে পশ্চিম আকাশে। কি একটা বড় পাখি নিধুবাবুর বাগান থেকে বেরিয়ে আফসার মিয়ার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। আফসার মিয়া গলা হাঁকে, ও বউ, ঘুমালি নাকি?
কোন সাড়াশব্দ আসে না।
আফসার মিয়া আবার গলা হাঁকে, ও বউ, ঘুমালি নাকি?
ঘর থেকে জবাব আসে ময়নার, মরণ না অলি কি আর আমার ঘুম আছে নাকি?
রাগিস ক্যান? মিনতির সুরে বলে আফসার মিয়া।
ঘর থেকে আর কোন জবাব আসে না। চুলার পারে বসেই থাকে আফসার মিয়া। একটু পরেই আসে জয়নাল আর মজনু। গলা খাদে নামিয়ে জয়নাল বলে, চাচা, চলে গেছে?
হ।
জবাব দেয় আফসার মিয়া।
জয়নাল আবার বলে, এতক্ষণ নিধুবাবুর বাগানে বসে মশার কামড় খাইছি। কোন হারামীর বাচ্চা আইছিল?
কিডা আইছিল তা দিয়ে তুমার কাম কি? কতজনই তো আসে। বলে আফসার মিয়া।
এই নাও।
আজকে বেশি নাই। বলে জয়নাল আফসার মিয়ার হাতে গুজে দেয় একখানা কাগজ। আফসার মিয়া টর্চের আলো ফেলে হাতের কাগজখানার ওপর। পঞ্চাশ টাকার একখানা নোট।
আফসার মিয়া বলে, যাও।
............একখান সিগারেট থাকলি দাও তো। বিড়ি খাতি খাতি মুক এহেবারে বেস্বাদ অয়ে গেছে।
মজনু পকেট থেকে সিগারেট বের করে আফসারের হাতে দেয়। আফসার সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকে। বেশ আরাম অনুভব করে সে।
ঠোঁটে ভিন্ন স্বাদ পায়। বেশ লাগে তার সিগারেট খেতে। কিন্তু তার সামর্থে কুলোয় না বলে সিগারেট তেমন খাওয়া হয়না। যারা আসে মাঝে মাঝে তাদের কাছ থেকে দুই-একটা চেয়ে চিন্তে খায়।
নিধুবাবুর বাগানের গাবগাছে কি একটা পাখি ডানা ঝাপটায়।
ঘর থেকে শীৎকার ভেসে আসে। উঃ উঃ! মাগো। আফসার মিয়া সিগারেটে টান দিতে দিতে ভাবে, উঠতি বয়সের জোয়ান ছাওয়াল। একটু তো.........।
রাত আস্তে আস্তে ভারী হয়।
থেকে থেকে নিধুবাবুর বাগানের পাখিগুলো কিচির-মিচির করে ওঠে। ডানা ঝাপটায়। ঝিঁঝি পোকা ডাকে। থামে, আবার ডাকে। নিধুবাবুর বাড়ির কুকুরটা একটু পরপরই ডেকে ওঠে।
ওর ডাকে সারা দিতে জেলেপাড়া থেকে অনেকগুলি কুকুর একসঙ্গে ডেকে ওঠে। থামে না সহজে। আফসার মিয়ার দু-চোখে ঘুম ভর করে। রানীক্ষেত মুরগীর মতো ঝিমোতে থাকে। মাথাটা সামনের দিকে ঢলে পড়ে, আবার সামলে নেয় নিজেকে।
কান খাড়া করে, উঃ.....উঃ মাগো। শব্দ থেমে যায়। অন্ধকারে নীরবতা নেমে আসে। আবার ভেসে আসে উঃ মাগো, আঃ। শীৎকার শোনা যায় জয়নাল আর মজনুর জড়ানো কন্ঠের।
আফসার মিয়া আবার ঝিমোতে থাকে। বারবার সামনের দিকে ঢুলেই আবার সজাগ হয়ে ওঠে। অনেকণ পর সামনে এসে দাঁড়ায় জয়নাল আর মজনু।
যাই গে চাচা। বলে জয়নাল।
আফসার বললো, যাও। এট্টু খোঁজ খবর নিও আমাগের।
অন্ধকারে হারিয়ে যায় জয়নাল আর মজনু। টর্চের আলো ফেলে ফেলে ঘরে আসে আফসার মিয়া। চকির নিচে নিবু নিবু করে জ্বলতে থাকা হারিকেনের সলতে বাড়িয়ে দেয়।
ঝুলিয়ে রাখে বেড়ার সঙ্গে। বিছানায় বসে লুঙ্গির খুট থেকে টাকাগুলো বের করে পূর্নঃবার হারিকেনের আলোয় দেখে বলে, একশো টাহা অইছে। টাকাগুলো বিছানার নিচে রেখে কাঁপা কাঁপা হাতে শুয়ে থাকা ময়নার কপালে হাত রাখে।
এহেবারে ঘামে ভিজে গিছিস। বলে আফসার মিয়া।
কাঁধের গামছা দিয়ে ময়নার কপালের ঘাম মুছে দেয় আফসার মিয়া। ময়না ঝামটা দিয়ে হাত সরিয়ে দেয়।
রাগিস ক্যান। অসহায় সুরে বলে আফসার মিয়া।
আবার গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে দেয়।
এলোমেলো চুলগুলো শীর্ণ অঙুলের পরিচর্যায় ঠিক করার চেষ্টা করে। মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলে, ঘুমা। ঘুমায়ে পড়।
বেড়ায় গুঁজে রাখা তালপাখা খানা হাতে নিয়ে ময়নার মাথায় বাতাস করতে থাকে। ময়নার সারা শরীর ঘামে ভিজে জবজব করছে।
শরীরের সাথে সেঁটে আছে কাপড়। চুলগুলো ঘামে ভিজে ঘাড়ে, গলার সাথে লেপটে আছে। ক্লান্তির ভারে বিছানায় ভেঙে পড়া শরীর শুধুই বিশ্রাম চায়। বিশ্রাম। দু-চোখে ঘুম নেমে আসে।
সবকিছু বিস্মৃত হয়ে আসে। আফসার মিয়ার কথা ভাসা ভাসা কোনটা কানে আসে কোনটা আসে না।
চারদিকে সুনসান নীরবতা। নিধুবাবুর বাগানের পাখিগুলো এখন কিচির-মিচির করছে না। ডানা ঝাপটাচ্ছে না।
কুকুরটিরও কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বুঝি সবাই ঘুমের রাজ্যে হারিয়েছে। আফসার মিয়ার চোখেও ঘুমের সংক্রমন। আফসার মিয়া পাখা রেখে হাত বাড়ায় হারিকেনের দিকে। হাত হারিকেন ছোঁয়ার আগেই দরজায় শব্দ হয়।
নিচু গলার স্বর ভেসে আসে ঘরে, আফসার ভাই, আফসার ভাই। দরজা খোল আফসার ভাই।
এই গলার স্বর আফসার মিয়ার চেনা। সে একবার দরজার দিকে তাকায়। আবার ময়নার মুখের দিকে তাকায়।
অক্ষম অথর্ব স্বামী সে। ময়নার জন্য কিছুই করতে পারে নাই। উল্টো ময়নার রক্ত বেচে খাচ্ছে সে। ময়নার দিকে তাকিয়ে খুব মায়া হয় আফসার মিয়ার। গভীর ঘুমের কোলে ঠাঁই নিয়েছে ময়না।
ময়না কিছুই শোনেনা। দরজার শব্দ, নিচু গলার ডাক কিছুই না। তার শরীর শুধু বিশ্রাম চায়। ঘুম চায়। ঘুম।
দরজায় ক্রমাগত শব্দ করে নিচু গলায় ডাকতেই থাকে চেনা স্বর। অসহায় আফসার মিয়া ঘুমন্ত ময়নার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। চেনা স্বর ডেকেই চলে, আফসার ভাই, আফসার ভাই, দরজা খোল আফসার ভাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।