আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অমি রহমান পিয়ালের সেই কালোরাতে ইথারে খুনীরা যা বলেছিলো



আইরিন সুলতানার "১৯৭১ : বীরাঙ্গনা অধ্যায়" পোষ্টটা স্টিকি করার আহবান জানিয়েছিলাম। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সাড়া দেননি। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, প্রতিবেলায় যে কারও একটি দলিল ভিত্তিক পোষ্ট আমি কপি-পেস্ট করে পোষ্ট করবো। হয়তো ব্লগ কর্তৃপক্ষ আমাকে এর শাস্তি দিবেন। যদি কেউ আমার সিদ্ধান্তটিকে মেনে না নেন তাহলে বলবেন; আমি তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবো।

---------------------------------------------------------------------------------- ২৫ মার্চ, ১৯৭১। অপারেশনে নেমেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। আনুষ্ঠানিক নাম- অপারেশন সার্চলাইট। বাস্তবে নির্বিচার হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও। স্বাধীনতাকামী বাঙালীর কণ্ঠ বুলেট দিয়ে চিরতরে স্তব্ধ করার সামরিক নকশা।

সেরাতে দেড়টা থেকে পরদিন সকাল ৯ টা পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওয়ারলেস ট্রান্সমিশন রেকর্ড করেছিলেন আনবিক শক্তি কমিশনের ড. এম এম হোসেইন। ঢাকার খিলগাও চৌধুরীপাড়ার বি-১৭৪ নং বাড়িতে বসে প্রাণের উপর ঝুঁকি নিয়ে কাজটি করেছিলেন এই প্রকৌশলী। ইংরেজি-উর্দূ মেশানো অসম্পূর্ণ এই ট্রান্সক্রিপ্টের অনুবাদ একটু কঠিন ঠেকেছে। মিলিটারি জারগন জানার চেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে প্রতিটি অপারেশনে বিশেষ কোড থাকে, যা সংশ্লিষ্টরাই শুধু জানে। সেগুলো ডিসাইফার করতে সমস্যা হয়েছে খুব।

কিছু বিশেষ সম্বোধনের অর্থ ধরতে পারিনি। আবার কিছু আন্দাজ করে নিয়েছি। যেমন ইমাম (ধারণা করছি এর অর্থ কমান্ডার। সেটা টিক্কা খান, আবার জাহানজেব আরবাব থেকে শুরু করে ইউনিট কমান্ডারও হতে পারে)। আবার মেইন বার্ড বলতে বোঝানো হয়েছে শেখ মুজিবর রহমানকে।

টিক্কা খানের (স্ক্রিপ্টে যাকে কন্ট্রোল হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে) তত্বাবধানে পরিচালিত এই অপারেশনের রেকর্ডকৃত ট্রান্সক্রিপ্টে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানায় অপারেশনের দায়িত্বে থাকা ইউনিটগুলোর কথাবার্তা উল্লেখযোগ্য, যদিও প্রতিটি বার্তা ধারাবাহিক এমন নয়, অনেকে কথা বলছে, অনেক সময় বেশ সময় নিয়ে বলছে। কল্পনায় দিব্যি দেখতে পাচ্ছি রিসিভার হাতে এসব বার্তা বিনিময়ের সময় জ্বলছে ঢাকা, মরছে বাঙালী। একইসঙ্গে শুরু হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার প্রথম প্রহর। : ৭৭, আমার কথা বোঝা যায়? ওভার। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না(রিডেবল)।

কোনো খবর আছে ? ওভার। কারেকশন, ৭৭, অপেক্ষা করেন, ওনাকে... উনি নিজেই কল করবেন... কন্ট্রোল : ৭৭, অপেক্ষা করো। পরে কথা বলছি তোমার সঙ্গে, হ্যালো ৯৯, তুমি যোগাযোগ রাখো নয়তো ২৬ এবং অন্যরা দুবার করে পরিস্থিতি জানাবে। তুমি স্রেফ টিউনে থাকো, এখনও নতুন কিছু ঘটেনি; রিজার্ভ লাইন দখল করা গেছে আর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এখনও লড়াই চলছে। আউট।

: ইমামের জন্য অপেক্ষা করো। : ৭৭, ইমাম এখানে এসেছে, আর তার সঙ্গে আমার ইমাম এখন ব্যস্ত আছে, এজন্য এই মুহূর্তে আমি কিছুই বলতে পারছি না। ওভার। : কন্ট্রোল অগ্রগতির তথ্য চাচ্ছেন, আপনি খোঁজ নিয়ে নিজেই জানান। ওভার।

: দাঁড়াও। পরে কথা বলছি, হ্যালো, ৭৭। ইমাম শুনছেন, বার্তা পাঠাও। ওভার। : ৭৭, ৮৮র কাছ থেকে সর্বশেষ জানা গেছে যে সে এগিয়ে চলেছে, কিন্তু ওখানে এত দালান যে যেসব বাড়ি থেকে ওর দিকে গুলি করা হচ্ছে ও সেগুলিকেই বেছে নিচ্ছে।

ওর যা কিছু আছে সবই ব্যবহার করছে। ওভার। : ওকে জানান যে তার বড় ভাইরা (আর্টিলারি) শিগগিরই চলে আসছে, আশা করি বড় বিল্ডিঙগুলো গুড়িয়ে দেওয়া যাবে। ওদিকে মনে হচ্ছে লিয়াকত আর ইকবাল (বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস) চুপ মেরে গেছে। কি ঠিক বলেছি? ওভার।

:৭৭, কাহিনী শেষ কিনা নিশ্চিত না হলেও ওরা এ দুটো নিয়ে বেশ খুশীই মনে হলো। ওভার। কন্ট্রোল : দুর্দান্ত। এখন ছেলেদের বলে দাও রাস্তায় রাস্তায় কারফিউর কথাটা প্রচার করতে। এটাই সবার আগে।

দ্বিতীয় যেটা, ওরা যেন বাংলাদেশের সব পতাকা নামিয়ে ফেলতে বলে। আর কোনো বাড়িতে যদি বাংলাদেশের পতাকা পাওয়া যায় তাহলে বাড়িওয়ালাকে সেজন্য শাস্তি পেতে হবে। কোনো কালো পতাকা যেন না উড়ে, আর শহরের কোনো জায়গায় যেন বাংলাদেশের পতাকা দেখা না যায়। আর যদি সেগুলো নামানো না হয়, তাহলে তার ফল হবে ভীষণ মারাত্মক। এটা সবাইকে পরিষ্কার বুঝিয়ে বলতে হবে।

রজার। ওভার। : ৭৭, রজার, ওভার। : ৭৭, এছাড়া রোড-ব্লকগুলার ব্যাপারেও ঘোষনা দিতে হবে। যদি কাউকে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা বসাতে দেখা যায় তাহলে সেখানেই গুলি করে মারা হবে।

এটা হচ্ছে প্রথম কথা। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে যে জায়গায় দেখা যাবে, সেখানকার মানুষজনকে শাস্তি দেওয়া হবে (মানে মেরে ফেলা), আরে ডানে-বায়ের বাড়ি-ঘরেরও হবে একই দশা। রোড ব্লকের আশপাশ গুড়িয়ে দেয়া হবে। এটা সবাইকে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিতে হবে, জনগনকেও। আর রাত থেকে সকাল পর্যন্ত এবং আগামীকাল সারাদিন মাইকে ঘোষনা করতে হবে এই নির্দেশ।

ওভার। : ৭৭, উইলকো। আউট অন ইউ। হ্যালো ৪১, ইমামের নির্দেশ পেয়েছো? ওভার। : ৪১, ইমাম কি শুনতে পাচ্ছে? ওভার।

: ৪১, ইমামের নির্দেশ। প্রথম হচ্ছে, সব কালো পতাকা... এসব পতাকা বাড়ির মালিকদের অবশ্যই নামিয়ে ফেলতে হবে; কাউকে এরকম পতাকা উড়াতে দেখলে শাস্তি দিতে হবে। এই নির্দেশ কার্যকর করতে হবে (ভুল উচ্চারন করে প্রসিকিউটেডকে পারসিকিউটেড বলা হয়েছে) এবং বাড়ি ধ্বংস করে দিতে হবে। এটা মাইকে ঘোষনা করতে হবে। রজার সো ফার।

ওভার। : ৪১, ঠিক একইভাবে কোথাও কোনো রোডব্লক দেখা গেলে সেটাকে ফৌজদারী অপরাধ হিসেবে ধরা হবে। কাউকে এমন করতে দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে মেরে ফেলতে হবে। রোড ব্লকের আশেপাশের বাড়ির মালিকদের শাস্তি দিতে হবে এবং তাদের বাড়ি গুড়িয়ে দিতে হবে। এই ঘোষনাটাও টহলদার সেনাদের দিয়ে দেয়াতে হবে।

ওভার। : ৪১, আউট টু ইউ। হ্যালো ৮৮, বলো। ওভার : ৮৮, ইমাম অপেক্ষা করছেন। বার্তা পাঠাও।

ওভার। : ৮৮, ইমামের নির্দেশ সব বাংলাদেশের পতাকা বা কালো পতাকা এবং যেসব বাড়িতে এগুলো উড়ছে এ মুহূর্তে তা নামিয়ে ফেলার জন্য মালিকদের সতর্ক করে দিতে হবে, নয়তো তাদের শাস্তি দেওয়া হবে (এ জায়গায় বক্তা পারসিকিউটেডকে সংশোধন করে আবার প্রসিকিউটেড বলেছেন)। রজার সো ফার। ওভার। : ৮৮, উইলকো।

ওভার। : ৮৮, কোথাও কোনো রোডব্লক দেখা গেলে সেটাকে ফৌজদারী অপরাধ হিসেবে ধরা হবে। কাউকে এমন করতে দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে মেরে ফেলতে হবে। রোড ব্লকের আশেপাশের বাড়ির মালিকদের শাস্তি দিতে হবে এবং তাদের বাড়ি গুড়িয়ে দিতে হবে। এই ঘোষনাটাও টহলদার সেনাদের দিয়ে দেয়াতে হবে।

ওভার। : ৮৮। উইলকো। আর কিছু? ওভার। : ৮৮।

তোমার ইমাম কি বলেছে যে কাজটা সারতে প্রায় তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগবে? ওভার। : ৮৮। হ্যাঁ। কাজটা ঠিকমতো সারতে কমপক্ষে তিন থেকে চার ঘণ্টা লাগবে। ওভার।

কন্ট্রোল : ৮৮, ইমাম এখন ইমাম ২৬ এর সঙ্গে আছেন। যদি আর কোনো ধরনের সাহায্য প্রয়োজন হয় তাহলে তাকে জানাতে পার। আর ব্যাদারগুলো (এম-২৪ ট্যাঙ্ক) নিরাপদ অবস্থান থেকে যাত্রা শুরু করেছে এবং ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে তোমার সামনের সব বাধা ধ্বংস করতে তোমাকে সাহায্য করবে। ওভার। : ৮৮, অনেক অনেক ধন্যবাদ।

আমার আর কিছু বলার নেই। সব ঠিকঠাক মতোই হচ্ছে। কন্ট্রোল : ৮৮, রজার। আউট টু ইউ। হ্যালো ৪১।

ম্যাসেজ। ওভার। কন্ট্রোল : ৪১, রেলওয়ে লাইনের পশ্চিম দিকে পালানোর পথগুলো তোমার এলাকায় পড়েছে। আশা করি জায়গামতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখবে যাতে ক্যাম্পাসে ২৬ ও ৮৮র হাত থেকে সেদিক দিয়ে কেউ পালিয়ে যেতে না পারে। ওভার।

: ৪১, আমরা এলাকাটায় টহল জোরদার করেছি। প্রতি মিনিটেই আমরা চক্কর দিচ্ছি আর সতর্ক থাকছি। ওভার। কন্ট্রোল : ৪১, রজার। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে তুমি পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে।

২৬ এর ওরা ডেইলি পিপলে আমাদের বন্ধুদেরও খুজে বের করেছে। খবরটায় তোমার খুশী হওয়া উচিত। আউট। কন্ট্রোল: হ্যালো ৮৮কে ৯৯। হাইয়েস্ট কন্ট্রোল জানতে চাইছে প্রতিপক্ষ কি ধরনের গুলিবর্ষণ করেছে।

ওভার। : ৯৯কে ৮৮। অপেক্ষা করুন। আমি আমার ইমামকে ফোন করছি ,ওনার সঙ্গে কথা বলুন। : ৯৯কে ৮৮।

আমার ইমাম শুনছেন। ম্যাসেজ দিন। ওভার। : ৮৮কে ৯৯। সর্বোচ্চ কন্ট্রোল জানতে চাইছেন জগন্নাথ, ইকবাল ও লিয়াকতে (বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাস) কি ধরনের প্রতিরোধের মুখে পড়েছেন।

ওভার। : ৯৯কে ৮৮। শুরুতে জগন্নাথ ও ইকবাল হল থেকে প্রচুর গুলি ছোড়া হয়েছে। রজার সো ফার। ওভার।

:রজার। ওভার। : ৮৮, আমরা রোমিও রোমিও (রিকয়েলেস রাইফেল) দিয়ে হামলা করার পর আর কোনো আওয়াজ আসেনি, তবে কয়েকটাকে নিষ্ক্রিয় করেছি। রজার সো ফার, ওভার। : ৮৮কে ৯৯।

রজার। ওভার। : ৯৯কে ৮৮। আমি এখন লিয়াকতে যাচ্ছি কারণ ওদের সেটটা অকেজো হয়ে গেছে। ওদের অগ্রগতি জানি না।

খোজ নিয়ে জানাচ্ছি। ওভার। : ৮৮কে ৯৯। ওপাশ থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলি কিংবা গ্রেনেড ইত্যাদি ছোড়া হয়েছিল কিনা জানিও। ওভার।

: ৯৯কে ৮৮। প্রচুর থ্রি নট থ্রির গুলি। তবে কোনো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বা গ্রেনেডের আওয়াজ শুনিনি। ওভার। : ৮৮, রজার আউট।

: ৯৯কে ২৬। মারখোর (এডজুটেন্ট) এসেছেন। বার্তা পাঠাও। ওভার। : ২৬কে ৯৯।

দয়া করে আমাদের বলো তোমরা এখন পর্যন্ত কি কি কব্জা করেছো। ওভার। : ৯৯কে ২৬। ২০০০ (রাজারবাগ পুলিশ লাইন) দখল, তারপর রমনা থানা দখল, কমলাপুর থানা দখল, টিভি ও রেডিও নিয়ন্ত্রনে, (টেলিফোন) এক্সচেঞ্জ দখল। প্রথম ধাক্কাতেই সব ইয়া আলী।

ওভার। ২য় পর্ব: প্রাসঙ্গিক কিছু কথা : অপারেশন সার্চ লাইট চূড়ান্তকরণ হয়েছিলো সাধারণ একটি নীল রংয়ের প্যাডে (নীলনক্সা হিসেবে ঠিক আছে) সাধারণ একটি কাঠ পেন্সিলে! পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআরও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সিদ্দিক সালিক তার লেখা উইটনেস টু সারেন্ডারে বর্ণনা দিয়েছেন এর। জেনারেল রাও ফরমান আলী খসড়া করেছিলেন মূল পরিকল্পনাগুলোর। আর এর দ্বিতীয়ভাগ লিখেছেন জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা। সেনা বন্টন এবং কোন ব্রিগেড ও ইউনিট কোন অপারেশনের দায়িত্বে থাকবে তারই নির্দেশনামা।

পাঁচ পৃষ্ঠাজুড়ে ১৬টি অনুচ্ছেদে পরিকল্পিত এই অপারেশনের মূল লক্ষ্য ছিলো ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, বর্তমানে বিডিআর) ও পুলিশসহ বাঙালী সেনা সদস্যদের নিরস্ত্র করা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানসহ আওয়ামী লিগ নেতা এবং গুরুত্বপূর্ণ ১৬ জন ব্যক্তির বাসায় হানা দিয়ে তাদের গ্রেপ্তার। ২০ মার্চ ফ্ল্যাগস্টাফ হাউজে জেনারেল হামিদ ও লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পড়ে শোনানো হয় এই হাতে লেখা পরিকল্পনা। দুজনই তা অনুমোদন করেন। সে অনুযায়ী রাও ফরমান আলীর তত্বাবধানে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাবের নেতৃত্বাধীন ৫৭ ব্রিগেড ঢাকা ও আশপাশে অপারেশন চালায়, মেজর জেনারেল খাদিম রাজা দেশের বাকি অংশে। ২৫ মার্চ রাত ঠিক সাড়ে ১১টায় রেডিও ট্রান্সমিটারগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে।

মূল অপারেশনের সময়সীমা ছিলো রাত একটা (ক্যালেন্ডারের পাতায় ২৬ মার্চ শুরু), তার আগেই টার্গেটের আশেপাশে ইউনিটগুলোর অবস্থান নেওয়ার কথা। তার মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পশ্চিম পাকিস্তানে পৌঁছে যাবেন। কিন্তু স্বাধীনতাকামী বাঙালী ছাত্র-জনতা তার আগে থেকেই রাস্তায় প্রতিরোধ গড়ে তুলছিলো, গুরুত্বপূর্ণ সড়ক থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় গাছের গুড়ি ও নানা কিছু দিয়ে রোডব্লক তৈরি করেছিলো তারা। গোয়েন্দাসূত্রের এই খবরেই সাড়ে ১১টায় সবগুলো ইউনিটই ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে যাত্রা শুরু করে। ঢাকার এই অপারেশনে বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলো : ১৩ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স : ঢাকা সেনানিবাস আক্রান্ত হলে সেটা সামাল দিতে রিজার্ভ হিসেবে রাখা হয়েছিলো তাদের।

৪৩ লাইট অ্যান্টি এয়ারক্রাফট রেজিমেন্ট : তেজগাঁ বিমানবন্দরের দায়িত্বে ২২ বেলুচ : পিলখানায় ইপিআরদের নিরস্ত্রিকরণ ও তাদের ওয়ারলেস এক্সচেঞ্জ দখলের দায়িত্বে। ৩২ পাঞ্জাব : রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দায়িত্বে ১৮ পাঞ্জাব : নবাবপুরসহ পুরান ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলোর দায়িত্বে ১৮ পাঞ্জাব, ২২ বেলুচ ও ৩২ পাঞ্জাবের একটি করে কোম্পানির সমন্বয়ে যৌথ ইউনিট ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিল স্পেশাল সার্ভিস গ্র“পের একদল কমান্ডোর দায়িত্ব ছিলো শেখ মুজিবকে (কলসাইন : মেইন বার্ড) জীবিত গ্রেপ্তার করা। এক স্কোয়াড্রন এম-২৪ ট্যাঙ্ক ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায় ছিলো। এছাড়া সেকেন্ড ক্যাপিটাল (শেরেবাংলা নগর/সংসদভবন এলাকা) এবং মীরপুর ও মোহাম্মদপুরের বিহারী অধ্যুষিত এলাকায় দায়িত্বরত ছিলো ফিল্ড রেজিমেন্ট। কিছু শব্দার্থ জেনে রাখলে সুবিধা হবে পাঠকদের : ৮৮, ৪১, ২৬, ৫৫ এসব হচ্ছে দায়িত্বরত ইউনিটগুলোর পরিচিতি সংকেত।

কথা বলার আগে কোন ইউনিট কথা বলছে তারই পরিচয় দিতে সংখ্যাটা বলেছে তারা। একইভাবে কোনো নির্দিষ্ট ইউনিট যখন অন্য কোনো ইউনিটের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে তখন সে সেটা উল্লেখ করছে, যেমন ৮৮কে ৯৯। রজার মানে বোঝা গেছে, লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার মানে পরিষ্কার বোঝা গেছে, উইলকো মানে উইল কমপ্লাই বা আদেশ পালিত হবে, ওভার মানে বাক্য শেষ, আউট টু ইউ মানে তোমার সঙ্গে কথা শেষ, ইমাম হচ্ছে কমান্ডিং অফিসার, মারখোর এডজুটেন্ট/কমান্ডিং অফিসারের স্টাফ অফিসার। কন্ট্রোল হচ্ছে রেজিমেন্ট কন্ট্রোল রুম। আবারও বলছি, বার্তা বিনিময়ের মধ্যে বিরতি ছিলো, তাই প্রতিটি লাইনকে ধারাবাহিক ধরে নেওয়া উচিত হবে না।

আগের অংশের পর : : কমিশনার অফিসে আমাদের এখান থেকে পুরানো পল্টন এলাকায় প্রচুর আগুন জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। এটা কি হেড অফিস নাকি অন্য কোনো জায়গা? ওভার। : ৯৯কে ২৬। ২০০০ (এরিয়া টু থাউজেন্ড/রাজারবাগ পুলিশ লাইন) আগুন জ্বলছে। আবার বলছি ২০০০ জ্বলছে।

ওভার। : ৮৮কে ৯৯। পিপলস ডেইলির (হোটেল ইন্টারকনের/এখন শেরাটন উল্টোদিকে অবস্থিত পত্রিকা অফিস) কি অবস্থা? : ৯৯কে ২৬। উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে (ব্লাসটেড)। আবার বলছি, উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

গুরুতর আহত অবস্থায় আমাদের দুজনকে সিএমএইচ (সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল) পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, আরও দুজন অল্প আঘাত পেয়েছে। ওভার। : ২৬কে ৯৯, প্রতিপক্ষের ক্ষয়ক্ষতির কোনো আন্দাজ? ওভার। : ২৬, না। এই মুহূর্তে অনুমান করা কঠিন।

লক্ষ্যবস্তুগুলোতে আগুন জ্বলছে অথবা পুরোপুরি ধ্বংস করা হয়েছে। এই মুহূর্তে কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। ওভার। : ২৬কে ৯৯, পুলিশ লাইনেরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে গেছে? ওভার। : ৯৯কে ২৬।

হ্যাঁ বলেছি, দুই হাজার, পুলিশ লাইন জ্বলছে। ওভার। : ২৬কে ৯৯। দারুণ দেখিয়েছো। আউট।

: ৫৫। লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার। ওভার। : ৫৫, মারখোর শুনছে। পাঠাও।

ওভার। : ৫৫, বার্তা পাঠাও। ওভার। : ৫৫ আপনি কল করেছিলেন। মেসেজ পাঠান।

মারখোর শুনছেন (উর্দু)। ৫৫, আপনার মেসেজ পাঠান। ওভার। : ৫৫.... : ৫৫, আবার বলেন। ওভার।

: ৫৫.... : ৮৮কে ২৬। অগ্রগতি জানাও। ওভার। : ৫৫। রজার।

এদের সঙ্গে ঠিক কোথায় যোগাযোগ হয়েছিলো? ওভার। : ৮৮কে ২৬। আপনার কথা ভেঙে ভেঙে আসছে আর জগন্নাথের ব্যাপারে অগ্রগতি জানান, জগন্নাথের ব্যাপারে (উর্দু)। ওভার : .... আপনার কাছে রিপোর্ট করবে। :৮৮কে ২৬।

রজার। আউট। : ৫৫। আমি আবার বলছি, আমাদের.... সামনে একটা রোড ব্লক ছিলো আর আমরা সেটা সরাচ্ছি, আর... ... ... আদার এলিমেন্টস। ওভার।

: ৫৫। জলি গুড শো (দারুণ দেখিয়েছো)। তোমার এলিমেন্টগুলো (সম্ভবত সাপোর্টিং আর্টিলারির কথা বলা হয়েছে) ২৬ এ পাঠানোর কথা। তবে তারা বেশি কাজে আসবে ৮৮র, যারা এই মুহূর্তে বেশ ঝামেলায় পড়েছে। আসতে থাকো।

আউট। : ৫৫। রি-নেট (ট্রান্সমিটার সেট করার নির্দেশ)। আপনার সেটের নেটিং চেক করুন। বোঝা যাচ্ছে না আপনি কি বলছেন (উর্দু)।

৫৫, ৫৫, ৫৫, ৫৫... নেটিং কল। নেট নাও। নেটিং কল এন্ডস। : ৫৫। আমার কথা শোনা যায়? ওভার।

: ৫৫, ৫৬ ... ... ওভার। : ৫৫, এখনো শিসের মতো শব্দ হচ্ছে। ট্রান্সমিটার আবার নেট করো (উর্দু)। ৫৫, ৫৫, ৫৫, ৫৫। হিয়ার নেটিং কল।

নেট নাও। নেটিং কল এন্ডস। : ৫৫। আমার কথা শোনা যায়? ওভার। : ৫৫... ...।

: ৫৫। রজার। মাইক একটু দূরে রেখে কথা বলুন (উর্দু)। ৫৫, আর কিছু না। আউট।

: মেসেজ। ওভার। : ৮৮কে ২৬, ৮৮কে ২৬, মেসেজ। ওভার। : ২৬কে ৮৮।

আমরা যাচ্ছি... : ৮৮কে ২৬। জগন্নাথের অগ্রগতি জানাও, আবার বলছি, জগন্নাথ। ওভার। : ২৬কে ৮৮। আমার ইমাম যাচ্ছেন।

: ৮৮কে ২৬। রজার আউট। : মারখোরকে মারখোর। ওভার। : ১৬।

অপেক্ষা করো। আউট। : ওদিকের ক্ষয়ক্ষতি কেমন? ওভার। : ১৬... ... চারজন নিহত। : রজার।

আহতদের যথার্থ চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে? : ... ... ... ইপিআর হাসপাতাল। ওভার। : ১৬। খুব ভালো। আউট টু ইউ।

হ্যালো ২৬, হ্যালো ২৬, হ্যালো ২৬, মেসেজ। ওভার। : ৫৫। অবস্থান জানাও। ওভার।

: ৫৫। অবস্থান জানাও। ওভার। : ৫৫, আমি ফার্মগেটের কাছাকাছি আর এখন বিস্ফোরক ও অন্যান্য জিনিস দিয়ে রোড ব্লক সরাচ্ছি। আমরা এখনও আগের জায়গাতেই আছি।

ওভার। : ৫৫। রজার। আশা করি কেউ তোমাদের বিরুদ্ধে লাগার সাহস করেনি। ওভার।

: ৫৫। আমরা চারদিকে চিতা (কমান্ডো দল) ছড়িয়ে দিয়েছি। এখন পর্যন্ত নেতিবাচক। ওভার। : ৫৫।

রজার। (বুল)ডোজার এবং অন্যান্য উদ্ধার সরঞ্জাম আছে তোমার সঙ্গে? ওভার। : ৫৫। হ্যা, ডোজার এখন সামনে জায়গামতো যাচ্ছে সরাতে... ... ... শক্তি দিয়ে। আর এরাও আমাদের বেশ সাহায্য করছে।

ওভার। কন্ট্রোল: ৫৫। বেশ দারুণ। আসতে থাকো। আমরা এখন এই মূলভবনের এলাকায়।

তুমি চেষ্টা করে দেখো রাস্তাগুলোর অপ্রয়োজনীয় ক্ষতি এড়িয়ে যেতে। আউট। : .... ওভার। : ৭৭কে..., ৭৭কে ১৬, মেসেজ। ওভার।

: ১৬, মারখোরকে দিন। ওভার। : ১৬, মারখোরকে দিন। ওভার। : ১৬ ... : ১৬, আগে যেভাবে বলা হয়েছিলো, তোমার আসল দলের (অরিজিনাল ফোর্স) ইমাম প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালন করবে এবং আনুষঙ্গিক কি কি করতে হবে সেগুলো বের করে সে অনুযায়ী সাজাবে।

ভোর না হওয়া পর্যন্ত কিংবা তোমাদের ওখানের ইমাম না আসা পর্যন্ত যেমন ছিলে সেভাবেই থাকতে বলা হচ্ছে। : ১৬, উইলকো। আউট। : ... ইমামের জন্য। ওভার।

: ... অপেক্ষা করো। ওভার। : ইমাম শুনছেন। মেসেজ পাঠাও। ওভার।

: ৪১, তোমার এলাকায় ফিজিকাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (মোহাম্মদপুর, এখানেই পরে আল-বদর হেডকোয়ার্টার স্থাপিত হয়) এবং পুলিশ স্টেশনগুলোর অবস্থা জানাও। ওভার। : ৪১। ফিজিকাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ভালোভাবে তল্লাশী করা হয়নি, তবে আমরা সেখানে সশস্ত্র সেনা মোতায়েন করেছি। এই এলাকায় কোনো পুলিশ স্টেশন নেই।

ওভার। : ৪১। ধন্যবাদ। আউট। : ৪১।

আমাদের এখানে অনেকগুলো লোক আছে যারা বেশ কিছু রোড ব্লক দিয়েছিলো, এদের ধরা হয়েছে এবং সেগুলো পরিষ্কার করতে কাজে লাগানো হয়েছে। ওদের কি আপনার কাছে নিয়ে যেতে হবে, নাকি খতম করে দেবো (বন্দী হিসেবে পাঠিয়ে দেবো না মেরে ফেলবো)? ওভার। : ৪১, শ্রমের দারুণ ব্যবহার করেছো দেখছি। আপাতত এদের ব্যবহার করতে থাকো আর যতক্ষণ পর্যন্ত ইমামের কাছ থেকে নির্দেশ না পাচ্ছি ততক্ষণ আটকে রাখো। তারপর পরিস্থিতি বুঝে হয় তোমরা তাদের খালাস করবে নয়তো আমাদেরকে পাঠাবে।

ওভার। : ৪১। রজার। আউট। : ৮৮।

মেসেজ। ওভার। : ৮৮, মেসেজ পাঠাও। ওভার। : ৮৮, রোমিও সিয়েরা ইউনিফর্মের (রিভেরাইন ইউনিট/নদীর কুল পাহারা দেয়া পদাতিক ইউনিট) সঙ্গে আপনার এক এলিমেন্ট (সেনা কর্মকর্তা) আছে তার মাধ্যমে জিজ্ঞেস করুন তো রোমিও সিয়েরা ইউনিফোর্ম পানিতে টহল দিচ্ছে কি না (উর্দু)।

ওভার। : ৮৮। রজার। ওভার। : ৮৮, আউট।

: ... স্রেফ মনে করিয়ে দিতে চেয়েছি যে রোমিও সিয়েরা ইউনিফর্মের সঙ্গে থাকা আপনার এলিমেন্টের উচিত হবে তাদেরকে নৌকায় করে টহল দিতে বলা (ক্যারি আউট প্যাট্রলিং ইন দ্য রিভার বোটস)। ইমামের সঙ্গে আলোচনা অনুযায়ী নদীতে টহল শুরু করুন। ওভার। : ৮৮, আমরা এরমধ্যেই তা শুরু করে দিয়েছি, আবার বলছি, আমরা ইতিমধ্যে তা শুরু করে দিয়েছি। ওভার।

: ৮৮... আমি তার কাছে পুরাটা দিচ্ছি : ৮৮, খুব ভালো। চালিয়ে যাও। আউট। : হ্যালো ২৬। ওভার।

: ২৬। পাঠাও। ওভার। : তোমরা কি ডেইলি পিপল থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাউকে আটকাতে পেরেছো? ওভার। : ২৬ না, নেগেটিভ।

তবে আমাদের সৈন্যরা অন্য কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ লোকের খোঁজে গেছে আর আমরা তাদের অগ্রগতি জানতে অপেক্ষা করছি। ওভার। কন্ট্রোল: ২৬। রজার। আলফা লিমার (আওয়ামী লিগ) কার্যালয় কি দখল হয়েছে? ওভার।

: ২৬। না। ভোর বেলা ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ওভার। : ২৬।

রজার। তাহলে হয়তো সেখানকার বাসিন্দারা সব রেকর্ড বা কাগজপত্র এর মধ্যেই পুড়িয়ে বা নষ্ট করে ফেলেছে। তারপরও তোমরা তোমাদের পরিকল্পনামতোই এগোতে থাকো আর তোমাদের অগ্রগতি খুবই চমতকার হচ্ছে। ছোটখাটো যাই ঘটুক না কেনো আমাদের জানিও। ওভার।

: হ্যালো ৯৯, ৯৯। মারখোর। ছোটাকে দিন। ওভার। : ৯৯, অপেক্ষা করো।

আউট। : মেসেজ পাঠান, ওভার। : আউট টু ইউ, হ্যালো ২৬, ২৬, ৭৭ থেকে মেসেজ, মারখোরকে জানান যে ইমাম বলেছেন, ভোরের আলো ফোটার আগেই যত লাশ আছে সব যেন সরিয়ে ফেলা হয়; বাকি সবাইকে এটা বলে দাও (উর্দু)। ওভার।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।