আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আজকের এই মহান বিজয়ের দিনে শহীদ আলতাফ মাহমুদকে বিষন্নচিত্তে স্মরণ করছি।

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

আলতাফ মাহমুদ ৩০ আগস্ট। ১৯৭১। অসহ্য যন্ত্রনায় মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন এই কৃতি সঙ্গীতজ্ঞ।

আলতাফের জন্য বুলেট খরচ করেনি পশুরা। শরীরে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মেরেছিল । তার আগে সিগারেটের আগুন সারা শরীর অল্প অল্প করে পুড়িয়ে দিয়েছিল। সিলিং ফ্যানে বেধে ঘুরিয়েছে। রডের আঘাত তো ছিলই।

তবু সহযোগী মুক্তিযোদ্ধাদের নাম বলেননি আলতাফ। ১৯৩৩। বরিশাল শহর। আলতাফ মাহমুদ জন্ম ঐ বরিশাল শহরেই। আলতাফ মাহমুদের পুরো নাম অবশ্য এ.এন.এম আলতাফ আলী।

ছেলেবেলা থেকেই গান আর ছবি আঁকার ঝোঁক। অপরুপ এক নদী কীর্তনখোলার পাড়ের তিরিশ-চল্লিশের দশকের নিঝুম শহরটি তার সমস্ত সঞ্চিত সুধা দান করেছিল স্পর্শকাতর সেই বালকটিকে। শহরের নির্জন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে একদিন আলেকান্দার মোড়ে যেন ঘোর লাগা জীবনানন্দকে দেখে থমকে গেল বালক। (আমার এমনটা কল্পনা করতে ভালো লাগে। ) আর ঐ তো কলাঝোপ আর পুকুরের পাশে শহরের বিখ্যাত বেহালাবাদক সুরেন রায়ের বাড়ি।

এক অনুষ্ঠানে সুরেন রায়ের বেহালা শুনে স্থানকালপাত্র বিস্মৃত হয়েছিল কিশোর আলতাফ। অনুষ্ঠান শেষে গুণী শিল্পীর পায়ে পড়ল কিশোর। আমি বেহালা শিখুম। ভায়োলিন শিখবা? তাইলে আমার বাড়ি আইস। হেসে বললেন সুরেন রায়।

যামু। আমার বাড়ি চেনো মনু? চিনি কাকা। ছেলে বেহালা কিনবে শুনে বাবা গম্ভীর। আর মা? মা জমানো টাকা থেকে কোলকাতা থেকে বেহালা আনিয়ে দিলেন। সুরেন রায়ের কাছে সঙ্গীতের হাতেখড়ি হল।

কিছুদিন পরে ছেলের বেহালার সুর শুনে গম্ভীর বাবার মুখে হাসি ফুটল। আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো-এই ঐতিহাসিক গানটার জন্য আলতাফ খ্যাতি হলেও ওঁর একটা অসাধারণ গান আছে। সাবিনা ইয়াসমীন গেয়েছেন- শুধু গান গেয়ে পরিচয়। চলার পথে ক্ষণিক দেখা ...এই জায়গার সুর ...মানে যারা গানের ব্যকরণ জানেন ...আর যারা গানের ব্যকরণ জানেন না -এই দু-দলই স্বীকার করবে যে আলতাফ মাহমুদ স্বর্গমহল থেকে সুরটা পেয়েছিলেন। গানটা মাইনর স্কেলে।

মানে- (দরবারী রাগের আমেজ রয়েছে) চলার পথে ক্ষণিক দেখা ...এই জায়গার স্বরগুলি ...মানে ...জীবন এখানেই রহস্যময়...গভীর রহস্যময় ...কাকে এ কথা বোঝাব? সুর ওহীরুপে আসে সাধকের কাছে। এমন সাধককে পুড়িয়ে মারল ওরা? জগৎ এখনও টিকে আছে। কেন? একাত্তরের খুনিদের সমর্থকেরা কেন আজও অনুতপ্ত নয়? কেন? তারা গান বোঝে না বলে? যে গান সুরসাধকের কাছে ওহীরুপে আসে। অনেক কিছু যেন পরিস্কার হয়ে আসে। বলছিলাম,চলার পথে ক্ষণিক দেখা ...এই জায়গার স্বরগুলি ...মানে ...জীবন এখানেই রহস্যময়...গভীর রহস্যময় ...কাকে এ কথা বোঝাব? সুর সাধকের কাছে ওহীরুপে আসে।

সলিল চৌধুরী। আলতাফ মাহমুদ। আলাউদ্দীন আলী। সুর সাধকের কাছে ওহীরুপে আসে। সুর সাধকের কাছে ওহীরুপে আসে।

সুর সাধকের কাছে ওহীরুপে আসে। (আবেগপ্রবন হয়ে পড়ার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী) বরিশাল জেলা স্কুল পড়াশোনা চলছিল আলতাফের। ১৯৪৮। ঐ স্কুল থেকেই ম্যাট্রিক পাস করল কিশোর। অবশ্য তার আগে থেকেই গানের আসর মাত করে দিচ্ছিল সে।

ও বলায় হয়নি। আলতাফের গানের গলাও ছিল চমৎকার। শিল্পসংগঠনের প্রতি তীব্র টান। বরিশালে সে সময় নানান শিল্পসংগঠন ছিল। আলতাফ ওদের সঙ্গে গণসঙ্গীত গাইত।

ম্যাট্রিক পাসের পর বি এম কলেজে ভর্তি হয়ে কিছুদিন পড়াশোনাও হল। ছবি আঁকার ইচ্ছেটাও এমন জেঁকে বসেছে। মা আমি কইলকাতা যামু। কা? ছবি আঁকা শিখমু। তোর বাবায় রাজী হইবে? না হউক।

আমি যামু। যা। কিশোর ছুটল কোলকাতা। তারপর আর্ট স্কুলে ভর্তি। ছবি আঁকা শেখা।

(ঔপন্যাসিক এখানে বিস্তারিত লিখবেন। ) ১৯৫০। এবার ঢাকা। শিল্পসংগঠনের প্রতি তীব্র টান। আর সময়টাও তখন তীব্র গণজাগরণের।

তখন ঢাকায় “ধূমকেতু শিল্পী সংঘ” নামে একটি সংগঠন ছিল। আলতাফ সেই সংগঠনে যোগ দিলেন। দলটির সঙ্গে গণসঙ্গীত গাইত আলতাফ। পথে এবার নাম সাথী পথেই হবে এপথ চেনা ... ১৯৫২। ভাষা আন্দোলনের বছর।

আলতাফের জীবনের স্মরণীয় বছর। আব্দুল গাফফার চৌধুরী ভারাক্রান্ত হৃদয়ে লিখে ফেলেছেন স্পর্শকাতর একটি গান। দেখ তো আলতাফ কেমন হয়েছে? আলতাফ মন্তব্য করলেন, ভালো। কন্ঠস্বর কেমন গম্ভীর। তাইলে হারমোনিয়াম লইয়া বহ।

তাই বসল আলতাফ। সুর করলেন- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ... তখন বলছিলাম শুধু গান গেয়ে পরিচয় গানটা মাইনর স্কেলে এবং সে গানে দরবারী রাগের ছোঁওয়া আছে। আলতাফ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ...গানটি সুর করলেন মেজর স্কেলে। কী ভাবে একই সঙ্গে দুঃখ বেদনা গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তোলা যায়? বিষাদের এমন মহিমা ...ছেলেহারা শত মায়ের অশ্র“ ... হায় এমন করুন আর্তি! সুর সাধকের কাছে ওহীরুপে আসে। এমন সাধককে পশুরা পুড়িয়ে মারল? একটা গানেই বাঙালির মন চিরকালের জন্য জয় করে নিলেন আলতাফ।

একই সঙ্গে পাকিস্থানী শাসকগোষ্ঠীর নজরে পড়ে গেলেন। বিরাগভাজন হলেন পশ্চিমা লুটেরা শাসকগোষ্ঠীর। আজ আমরা জানি, তারা-সেই পশুরা প্রতিশোধ যথাসময়েই নিয়েছিল। ১৯৫৬ সাল। ভিয়েনায় একটি আর্ন্তজাতিক শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে।

ভিয়েনা যাওয়ার আমন্ত্রণ পেলেন আলতাফ। ভিয়েনার উদ্দেশে যাত্রা করে করাচি পৌঁছলেন। তাঁর পাসপোর্ট জব্দ করল পাকিস্থানী গোয়েন্দা সংস্থা। বিষন্ন হলেন আলতাফ। কী আর করা।

ওস্তাদ আদুল কাদের খাঁর তখন খুব নাম ডাক। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের তালিম নেওয়া হয়নি বলে মনে মনে ক্ষাণিক আফসোস ছিল। আলতাফ ওস্তাদ আদুল কাদের খাঁর শিষ্যত্ব বরণ করলেন। টানা ৭ বছর চলল সাধনা। গানের এমনই টান।

আসলে তো আলতাফ গানের মানুষ। এমন মানুষকে পুড়িয়ে মারল তারা! ১৯৬৩। ঢাকায় ফিরে এলেন আলতাফ। অনেক দিন পর। সংগঠনের খোঁজ খবর নিলেন।

১৯৬৫। ছায়াছবির সঙ্গীত পরিচালনা করতে শুরু করলেন। সে সময় বাংলা এবং উর্দু ভাষায় ছবি নির্মিত হত। সব মিলিয়ে ১৯টি ছবিতে কাজ করেছেন আলতাফ। উল্লেখযোগ্য হল- এবং, তানহা. কার বউ ...ইত্যাদি।

ছবির কাজের পাশাপাশি ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে গণসঙ্গীত গাইতেন। ১৯৭১। পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে পশুরা। গড়ে উঠেছে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। দেশাত্মবোধক গান রচনা করলেন আলতাফ।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সে সব উদ্দীপনাময় গান প্রচার করা হতে লাগল। দেশাত্মবোধক গান রচনার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থ ও খাদ্য যুগিয়ে সাহায্য করতে লাগলেন আলতাফ। ৩০ আগস্ট। পাকবাহিনীর লোকেরা বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। অভিযোগ-মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা অস্ত্রের খবর জানে আলতাফ ।

তারপর ... মৃত্যুর আগে অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল আলতাফকে। আলতাফের জন্য বুলেট খরচ করেনি পশুরা। শরীরে কেরোসিন ফেলে পুড়িয়ে মেরেছিল । তার আগে সিগারেটের আগুন সারা শরীর অল্প অল্প করে ... ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সরকার মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে আলতাফকে। ছবি: বাংলাপিডিয়ার সৌজন্যে তথ্য; মোবারক হোসেন খান লিখিত বাংলাপিডিয়ার একটি নিবন্ধ


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।