... ... ... ...
সব ইতিহাস বইয়ের পাতায় লেখা থাকে না.............................
থেরাডন রাজ্যের ইতিহাস মনে হয় আজকের ঐতিহাসিকরাও ভুলে গিয়েছেন। কিন্তু একটা সময় থেরাডন নামের একটি রাজ্যের অস্তিত্ব ছিলো, ছিল নানা উপকথা তাদের রহস্যময় রাজ্য নিয়ে। গ্রীক সাম্রাজ্য, রোমান সাম্রাজ্য আরো কতো সাম্রাজ্যের কতো কথা আমাদের ইতিহাসে লেখা থাকে, কতোই না মীথ প্রচলিত থাকে এসব সভ্যতা নিয়ে... কিন্তু এইসব সভ্যতার ইতিহাস কখনোই সভ্য ছিল না। সত্যি বলতে আমাদের ইতিহাসের পাতায় শুধুই যুদ্ধের ইতিহাস, রক্তক্ষরণের ইতিহাস, ক্ষমতার লড়াইয়ের ইতিহাস...কখনো কখনো হয়তো ভালোবাসার কিছু ইতিহাসের কথাও লেখা থাকে, সে ভালোবাসাও কিভাবে যুদ্ধ ডেকে এনেছে অথবা ক্ষমতা দখলে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে তার ভিত্তিতেই ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। থেরাডন রাজ্য ছিল এর মাঝে ব্যতিক্রম, হয়তো একমাত্র ব্যতিক্রম নয়।
তবে এইসব ব্যতিক্রম কেন যেন ইতিহাসে লেখা থাকেনি...ঐতিহাসিকেরা ব্যতিক্রমের ধার ধারেননি।
থেরাডন রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়েছিল তৎকালীন মেসোপটেমিয়া রাজ্যের উত্তরে, সমুদ্রের তীরবর্তী অঞ্চলে। উৎপত্তিরও পূর্বে মেসোপটেমিয়ার অংশই ছিল এ অঞ্চল, কিন্তু সেসময়ের এক অভিজাত পরিবারের জন্ম নেয়া নারী থিরানার নামে পরবর্তীতে এ রাজ্যের সূচনা হয়। খুব সম্ভবত ৩০০--৪৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ সভ্যতা বিদ্যমান থাকে। স্বল্পকালীন এ সভ্যতার ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিতে না পারার একমাত্র কারণ ছিল এ রাজ্যের অহিংস মনোভাব।
যুদ্ধ করে রাষ্ট্র দখল অথবা বিস্তারে কোনো আগ্রহ ছিল না বলেই হয়তো ঐতিহাসিকেরা সবসময়ই এ রাজ্যের অস্তিত্ব এড়িয়ে গিয়েছিলেন। এড়িয়ে গিয়েছিলেন সেসময়কার যুদ্ধবাজ নেতারাও, কেউই আসেননি দখল করতে এ রাজ্যকে। কেন? সে কথাই বলছি...তার আগে থিরানার কথা কিছু বলে নেয়া যাক।
অভিজাত ব্যবসায়ীর কন্যা থিরানার শৈশব ছিল ঐশ্বর্যমণ্ডিত। কিন্তু নিয়ত যুদ্ধমান গ্রীক সম্রাটদের আক্রমণে থিরানাদের বাসস্থান ধূলোয় মিশে যায়।
হাজার হাজার লোক মারা পড়লেও তখনকার যুদ্ধবাজ সম্রাটদের কাছে সেটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু এ দখলের সময়ই রূপবতী থিরানার উপর চোখ পড়ে আক্রমণকারী গ্রীক সেনাপতির। তুলে নিয়ে যায় তারা থিরানাকে। হয়তো সেসময় থিরানার অসহায়ত্ব আর কান্না থিরানাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল, তবে এরই পরিণামে পরবর্তীতে থেরাডন সাম্রাজ্যের উৎপত্তি। তো যা বলছিলাম, থিরানা খেলার পুতুলের মতো ঘুরতে লাগলো এক সেনাপতি হতে আরেক সেনাপতির হাতে।
একসময় তার উপর চোখ পড়লো গ্রীক সম্রাট নিকোমেডিয়াসের। তার রক্ষিতায় পরিণত হলেন থিরানা। ততোদিনে পৃথিবীর নিষ্ঠুর বাস্তবের স্বাদ পেয়ে গিয়েছেন থিরানা। সম্রাটের রক্ষিতা মহলে তাই নিজেকে আরো শানিয়ে নিলেন এ অপরূপ রূপবতী। নারীসুলভ ছলাকলা দিয়ে মাতিয়ে তুললেন সম্রাটকে।
থিরানার উপর খুশি হয়ে পরবর্তীতে তৎকালীন থেরাডন যে অঞ্চলে ছিল, সে অঞ্চলের শাসকের সাথে নিজে উপস্থিত থেকে বিয়ে দিলেন নিকোমেডিয়াস। তখনো কিন্তু এ অঞ্চলের নাম থেরাডন হয়নি, কিন্তু পরবর্তীতে থেরাডনের গল্প ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাবার কারণে থেরাডনের আদি নাম উদ্ধার করা সম্ভবও হয়নি।
থেরাডনের শাসকের স্ত্রী হিসেবে রাজ্যে এলেন থিরানা। এ সাম্রাজ্যও গ্রীক সাম্রাজ্যের মতোই রক্তাক্ত আর সহিংস ছিল। তাই থেরাডন রাজ্যে এসে প্রজার কথা ভেবে থিরানা শান্তি পেলেন না।
একসময় থেরাডন অঞ্চলের শাসকের মৃত্যু হয়... কোনো ষড়যন্ত্রমূলক অস্বাভাবিক মৃত্যু নয়, বৃদ্ধ শাসকের সাধারণ মানুষের মতোই মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর সুচতুরা থিরানা ক্ষমতা দখল করে নেন...তখন থেকেই উক্ত অঞ্চলের থেরাডন নামের উৎপত্তি হয়। থেরাডন রাজ্যের পুরোহিতরা আপত্তি করে বসে, নারীর শাসন মেনে নিতে চাইলো না। অজুহাত হিসেবে দিলো দেবতাদের অভিশাপের কথা। কিন্তু থিরানা ক্ষমতার লড়াইয়ের পিছের রক্তাক্ত ইতিহাস দেখে শিখেছিল, পুরো পরিস্থিতি পালটে দিতে নিলো এক আজব সিদ্ধান্ত।
যে সিদ্ধান্তের জন্যে থেরাডন রাজ্য হয়ে ওঠে অন্যরকম এক সাম্রাজ্য।
পুরোহিতেরা নারী শাসক মানবেন না, আবার পুরুষ শাসক এলেই হয়তো ক্ষমতার লোভে রাজ্য বিস্তার, যুদ্ধ, সহিংসতা শুরু করবেন। এ দ্বন্দ্ব থেকে থিরানা এক নতুন শাসন পদ্ধতির সূচনা করলেন। থিরানা নিজেকে সে রাজ্যের রানী ঘোষণা করলেন, রাজ্যের নাম রাখলেন থেরাডন। আর সবচাইতে মজার সিদ্ধান্ত নিলেন এই যে, প্রতিদিন থিরানা রাজ্যের পুরুষদের মধ্য থেকে একজনকে বেছে নিবেন যে হবেন একদিনের রাজা।
একবার যে রাজা হবেন তিনি আর রাজা হতে পারবেন না। আর সে একদিনের রাজার হাতেই থাকবে দেশ চালানোর সমস্ত ক্ষমতা। পুরো নাটকীয়তায় হত-বিহবল হয়ে পড়লো পুরোহিত সহ আশেপাশের রাজ্যের শাসকেরা। শুরু হলো নতুন ইতিহাস... থেরাডনের ইতিহাস।
কেউ কেউ বলতো যে রানী প্রতিদিন নতুন পুরুষের সঙ্গ পেতে এ শাসন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন...হয়তো সত্যি, হয়তো মিথ্যা।
থেরাডন রাজ্যের পুরুষেরা একদিনের রাজা হবার লোভে সবাই এ শাসন মেনে নিয়েছিল...ফলে এ শাসনব্যবস্থার পিছে রানীর প্রকৃত অভিলাষের কথা কেউ কখনোই উদ্ঘাটন করতে পারেননি। তবে রানীর পরবর্তীতে এক মেয়ের জন্ম হয়েছিল। কার সন্তান তা কেউ জানে না...তবে ঐতিহাসিকদের মতে, যারই হোক না কেন, কোনো একদিনের রাজার সন্তান হবে। আবার কারো কারো মতে হয়তোবা রানীর কোনো গোপন ভালোবাসা ছিল, তারও ঔরসজাত সন্তান হতে পারে। থিরানার পরে রানী হয়েছিল থিরানার এই কন্যাসন্তান।
থেরাডন রাজ্যের এ অদ্ভূত শাসন ব্যবস্থার ফলে কিছু অভাবনীয় ব্যাপার ঘটে গিয়েছিল। প্রত্যেকেই একদিনের রাজা হওয়াতে স্বচ্ছ শাসন ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল। সেই সাথে মানুষের সাথে মানুষের ভেদাভেদ কমে গিয়েছিল। কমেছিল সহিংসতা। এ রাজ্যের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল।
আশেপাশের শক্তিশালী রাজ্যের পুরুষেরা থেরাডনে ভিড় করতে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে বিনা যুদ্ধে থেরাডনের আশেপাশের রাজ্য থেরাডনের সাথে একীভূত হয়ে বিশাল রাজ্যের সৃষ্টি করে। প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেতে থাকা এ রাজ্য গ্রীকদের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ায়। গ্রীক সম্রাট এ রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে চাইলেও সম্রাটের বুদ্ধিমান পুরোহিতেরা এ কাজে বারণ করে। অজুহাত হিসেবে বলেন...থেরাডন মায়ানগরী, সেখানে পুরুষেরা মায়াময়ী নারীর জালে আটকা পড়ে।
গ্রীক সম্রাট ভয়েই আর কোনো সেনাবাহিনী থেরাডনের আশেপাশেও পাঠাননি। অন্য কোনো সম্রাটও এ সাম্রাজ্য দখল করার ইচ্ছে পোষণ করেননি। আর একদিনের রাজাদের দেশের দেশবাসীর মধ্যে দেশপ্রেম ব্যাপারটা তীব্রভাবে জেগে উঠেছিল।
এ সভ্যতার শুরু যেমন হঠাৎ করেই হয়েছিল, ঠিক তেমনি হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যায়। থিরানার কন্যাও থিরানা নামে পরিচিত ছিল।
থিরানা শেষ বয়সে কন্যা থিরানা ২য়কে নতুন রানী মনোনীত করে যান। থিরানা ২য়ও একই শাসন ব্যবস্থা জারি রাখেন, আর থেরাডন সাম্রাজ্যও রক্তপাতহীন ভাবেই উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। থিরানা ২য় এর গর্ভে জন্ম নেয় দুই ছেলে ও এক মেয়ে। পরবর্তীতে থিরানা ২য় তার কন্যা থিরানা ৩য়কে সাম্রাজ্যের নতুন কর্ণধার নির্ধারণ করেন। এ থেকে ঐতিহাসিকেরা খুব সহজেই বুঝতে পারেন যে মাতৃতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু ছিল থেরাডন রাজ্যে।
থিরানা তৃতীয়ের গর্ভে জন্ম নিয়েছিল দুই পুত্র...কোনো কন্যাসন্তান নয়। ফলে থেরাডনের শাসন ব্যবস্থা থিরানা ৩য় এর মৃত্যুর পরপরই ভেঙ্গে পড়ে। কথিত আছে ক্ষমতা নিয়ে দুই রাজপুত্রের যুদ্ধ আবারও থেরাডনকে পৃথিবীর সাধারণ সব ইতিহাসে ফিরিয়ে আনে...থেরাডন সভ্যতাও একসময় কালের গহীনে হারিয়ে যায়।
আরো অনেক মীথ প্রচলিত আছে এই থেরাডন রাজ্য নিয়ে...সত্যি-মিথ্যা অনেক গল্প জড়িয়ে আছে। তবে সকল ঐতিহাসিকই এ কথা এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন যে আরো কিছুদিন এ সাম্রাজ্য টিকে গেলে হয়তো গ্রীক সাম্রাজ্যের কথা ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাবার উপক্রম হতো।
বিঃদ্রঃসত্যির মতো করে মিথ্যা বলার খুব মজা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।