আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি তুমি সে: অজ্ঞান অনুসন্ধান

সকল অন্ধকারের হোক অবসান

যা নাই তা দেয়ার নামই ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা দিয়েই সলিমুল্লাহ খান শুরু করেন তাঁর জাক লাকাঁ বিদ্যালয় গ্রন্থধারার দ্বিতীয় খন্ড: আমি তুমি সে। অব্যাহত যাত্রার অংশ হিসেবে এই গ্রন্থেও সন্ধান চলেছে অজ্ঞানের- জ্ঞানে, শব্দে, রাজনীতিতে ও ব্যক্তিতে। ফ্রয়েডের পর ইউরোপের যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশী ফ্রয়েডকে বুঝেছেন- সেই জাক লাকাঁকে দিয়েই সলিমুল্লাহ খান তর্জমা করতে চেয়েছেন কখনো লালন শাহকে, কখনো বা আবুল হাসানকে। সমালোচনা করেছেন আব্দুল মান্নান সৈয়দের- গোলাম সাবদার সিদ্দিকির কবিতায় রাজনৈতিক বোধের অন্দরমহল সঠিক দৃষ্টিগোচর না হওয়ায়।

ফ্রয়েডের চশমায় দেখেছেন সিমন দো বুভোয়ার, কাজী নজরুল ইসলাম ও এডোয়ার্ড সায়িদকে। তবে এসবের আগে গ্রন্থটি শুরু হয়েছে জাক লাকাঁর একটি ইংরাজি বক্তৃতার তর্জমা দিয়ে। শেষও হয়েছে মূল বক্তৃতা যোগে। এ দুয়ের মাঝে রাখা হয়েছে তিনটি ভাগ: ফ্রয়েড ও লাকাঁ, লালন ফকির ও গয়রহ। এ ভাগগুলোতে হাজির আছে বিভিন্ন সময়ে লেখা সলিমুল্লাহ খানের ১৮টি প্রবন্ধ।

লাকাঁ পড়ার ভূমিকাতেই ইঙ্গিত দেয়া আছে- লাকাঁর বক্তৃতার মূল ভাব: ‘গঠন’। ১৯৬৬ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রে জাক লাকাঁ ‘গঠনতন্ত্র’ বিষয়ে ইংরাজিতে একটি বক্তৃতা করেন। সেখানে তিনি অজ্ঞান ও ভাষার গঠন নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি প্রস্তাব করেন অজ্ঞানের উপাদান বা অঙ্কুর পাওয়া যাবে ভাষাতেও। কেবল তাই নয় ভাষার গঠন অনেকটা অজ্ঞানের মতোই।

যে অজ্ঞানের সন্ধানদাতা ছিলেন জিগমুন্ট ফ্রয়েড। ১৯৩৬ সালে লেখা এক প্রবন্ধে লাকাঁ লোকজনদের বুঝিয়ে দেন ‘অজ্ঞান’ শুধু মনোবিশ্লেষণ শাস্ত্রেই নয় বিপ্লবের সূচনা করেছে তত্ত্বজ্ঞানেও। যা বিভিন্ন আকারে বিস্তৃত হয়েছে সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে। সেই সন্ধান পাওয়া অজ্ঞানের সঙ্গে লাকাঁ জুড়ে দেন ভাষার গড়ন। আর এভাবেই শুরু হয় ভাষার গলিঘুপচি অনুসন্ধান।

বলা যায় ব্রহ্মার অনুসন্ধান। কারণ ভাষার মধ্যেই পরম লুকায়িত। ‘কেন’ উপনিষদে বলা হয়েছে ‘যদবাচাহনভ্যুদিতং যেন বাগভ্যুদ্যতে। ’ অর্থাৎ, যিনি (ব্রহ্ম) বাক্যের দ্বারা অপ্রকাশিত; যাঁর দ্বারা বাক্য স্ফূর্ত হয়, প্রকাশের মাধ্যম হয়। আর এ বলা বাহুল্য নয় যে যিনি অপ্রকাশিত তিনিই লুকায়িত।

অর্থাৎ অধরা। এই সত্যকেই ধাবন করে লাকাঁ বলেন- ‘ঈশ্বর পরলোকে যায়েন নাই, ঈশ্বর আছেন ভাষায়। ’ তবে অপ্রকাশিত। আর এই অপ্রকাশিত ঈশ্বরের কাছে- অন্য অর্থে ভাষার কাছে মানুষ নিজেকে সমর্পণ করে। জীবনের যে সময় থেকে শিশু ভাষা শিখতে শুরু করে, গঠনের মধ্যে প্রবেশ করতে শুরু করে ঠিক তখন থেকেই শুরু হয় নিজের সাথে নিজের বিভাজন।

লাকাঁর মতে শিশু ‘আমি’ বলতে শেখে আয়নায় নিজের পাল্টে যাওয়া প্রতিবিম্ব দেখেই। এই প্রতিবিম্বই পরবর্তীকালে অবিরতই দেখতে হয় অন্য দৃষ্টির দর্পণে। সলিমুল্লাহ খান এখানটায় বলেন:‘শেষ পর্যন্ত সমাজ জীবনেও মানুষ পরের চোখেই নিজেকে দেখে, আর অপরের মধ্যে নিজেকে খোঁজে। ’ লাকাঁ আরো বলেন শিশু যে বিম্ব আয়নার মধ্যে বা বলা যায় ভাষার মসৃণ তলে দেখে তাতে অজ্ঞান নাই। অজ্ঞান প্রকৃত আছে ঐ আয়নার আপে বা বাঁধাইয়ে।

আর এজন্যই অজ্ঞান লুকায়িত। একই কারণে অপ্রকাশিত থেকে যান ব্রহ্ম। কিন্তু তাঁর দ্বারাই স্ফূর্ত হয় বাক্য। মজার বিষয়টি ঐ জায়গাতেই- আমরা বাক্য দিয়েই তাঁকে খোঁজার চেষ্টা করি। কারণ মানুষ এ বাক্য বা ভাষা বিনা অচল।

সোজা কথায় মানুষ ভাষার অধীন। সলিমুল্লাহ খান ফ্রয়েডের জবানিতে বলেন- এই ভাষা, পদ-পদাবলি কেমন করে মানবসন্তানের ওপর অপার ভোগদখল কায়েম করলো সেটাই ফ্রয়েডের প্রথমতম জিজ্ঞাসা। এর সরাসরি জবাব না পাওয়া গেলেও একটা ব্যাপারে ফ্রয়েড পরিষ্কার: মানুষের পরম যন্ত্রণার উৎস এই ভাষা। আর এই যন্ত্রণা থেকে ণিক মুক্তির মন্ত্রণা হলো: মনোবিশ্লেষণ। আর এই মনকে বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে অজ্ঞানের হদিস পাওয়া যেতে পারে।

সলিমুল্লাহ খানের প্রস্তাব এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ: তিনি বলেন, ‘লালন ফকিরের আরশি নগর ফ্রয়েড-কথিত ‘অচেতন’ বা অজ্ঞান নামক ধারণার অপর নাম। আর লালন অভিহিত ‘পড়শি’ ফ্রয়েড-পথিক জাক লাকাঁ প্রস্তাবিত ‘অপর’ বৈ নয়। লাকাঁ দুই অপরের কথা পেড়েছেন: বড় অপর ও ছোট অপর। লালনের পড়শি ‘বড় অপর'কে নির্দেশ করে। চলতি বাংলায় একেই ‘পরম’ বলা হয়।

এজন্যই লালন বলেন: বাড়ির কাছে আরশি নগর সেথায় এক পড়শি বসত করে আমি একদিনও না দেখিলাম তারে\ লালন কেন, কেউই তো ঐ পড়শি ওরফে পরমের দেখা পায় না। পরম যে অপ্রকাশিত। পরম যে খোদ ব্রহ্ম। ব্রহ্ম বাক্য ও মনের অতীত। এক্ষেত্রে ফ্রয়েড মনে করেন মনের বিশ্লেষণের মাধ্যমে মনের ঐ অতীতকে বর্তমানে কিছুটা হলেও হাজির করা সম্ভব।

কিন্তু বাকিটার ব্যাপারে সুরাহা হয়নি এখনো। তাই লাকাঁ বলছেন: মানুষের ভিতরের যেইটুকু তার নিজের হয়েও তার নিজের নয় সেই বস্তুকেই অচেতন বলে। এই অচেতন বা অজ্ঞানকেই সলিমুল্লাহ খান ভিন্ন প্রবন্ধে আবিষ্কার করেছেন নজরুল ইসলামের মধ্যে। কীভাবে? সলিমুল্লাহ খান লিখছেন: ‘বাংলার হিন্দু ও মুসলিম-পুরাণ নজরুল ইসলামের আবিষ্কার এই কথা অস্বীকার করার জো নাই। এই দুই পুরাণের দুই দেয়ালের মাঝখানে একটি চিপা গলি আছে।

ওই গলির নাম নজরুল ইসলামের গলি। আমরা একেই বলছি কাজী নজরুলের অজ্ঞান। নজরুলের এই অজ্ঞান হিন্দু ও মুসলমান প্রকৃতির বাইরে। এই প্রকৃতির নাম স্বাধীনতা। ইরাক-বাহিনীর সঙ্গে বঙ্গ-বাহিনীর তপ্ত নীর ফেলার নাম নজরুল ইসলামের অজ্ঞান।

এই জ্ঞানই বাসনার দীপশিখা। ’ সলিমুল্লাহ খান এই গ্রন্থে অজ্ঞানের পরিচয় পেতে ভাষার নাড়ি-নক্ষত্র মেপেছেন দর্শন ও সাহিত্য দিয়ে আর ভাষার গঠন পর্যবেক্ষণ করার বাসনায় অজ্ঞানের দরজায় কড়া নেড়েছেন বারে বারে। সে যাইহোক ‘অজ্ঞানলোক যে ভাষারই অপর নাম জানিতে পারিলে গুরু ও চাঁড়ালি দুই ভাষারই গুরুতর লাভ’ হবে। ** আমি তুমি সে- (জাক লাকাঁ বিদ্যালয়: ২য় খন্ড), সলিমুল্লাহ খান প্রথম প্রকাশ: ফেব্র“য়ারি ২০০৮ সংবেদ এবং এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভার যৌথ প্রকাশনা। ** (লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ৪ঠা জুলাই দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় কিছুটা কাটছাট হয়ে, এখানে পুরোটা দেয়া হলো।

)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।