আহসান মোহাম্মদ
নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ দিনগুলি নিয়ে অনিশ্চয়তা ততো বাড়ছে। দেশ যে আরেকটি অনিবার্য সঙ্ঘাতের দিকে ধাবিত হচ্ছে তা সকলেই বুঝতে পারছে। সেই সঙ্ঘাত শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে, সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকলে আমরা খুব দ্রুত এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নিপতিত হবো, যেখান থেকে কয়েক যুগেও বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে না।
২০০১ এর নির্বাচনে বাংলাদেশের রাজনীতির ভোটের সমীকরণটি খুব স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। পাচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর নির্বাচন কমিশন, কেয়ারটেকার সরকার, প্রশাসন সবকিছুকে নিজেদের মত করে সাজিয়ে এবং একচেটিয়া মিডিয়া প্রভাব কাজে লাগিয়েও আওয়ামী লীগ মাত্র ৬২টি আসন পায়, আপরদিকে কোনঠাসা বিএনপি জোটগতভাবে পেয়ে যায় দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশী।
দেখা যায়, প্রায় সকল আসনে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী ভাবধারার ভোট আওয়ামী ভোটের থেকে বেশী। রাজনীতির এই দুটি মূল ধারায় জনগণ এখন এতো বেশী বিভক্ত যে, সাধারণত: কেই তাদের রাজনৈতিক পক্ষ পরিবর্তন করে না। বাংলাদেশে খুব কম আওয়ামী লীগ সমর্থক রয়েছে যারা বিএনপি বা জামায়াতকে ভোট দিবে, একই ভাবে খুব কম বিএনপি সমর্থক রয়েছে যারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিবে।
যদি ধরা হয় কিছু সংখ্যক দোদুল্যমান ভোটার রয়েছে যারা এবার কোন না কোন কারণে পক্ষ ত্যাগ করবে তাহলে কি হতে পারে তা নীচের টেবিলে দেখানো হলো:
৫% এর কম ব্যবধানে বিএনপি হেরেছে ৮ (আ’লীগ) ১ (জাতীয় পার্টি) ৯ (মোট)
৫% এর কম ব্যবধানে আ’লীগ হেরেছে ১০ (বিএনপি) ২ (জামায়াত) ১২ (মোট)
৫% এর কম ব্যবধানে জামায়াত হেরেছে
৫% এর কম ব্যবধানে জাতীয় পার্টি হেরেছে ২ (আ’লীগ) ২ (মোট)
৫% এর কম ব্যবধানে অন্যান্য হেরেছে ২ (আ’লীগ) ২ (মোট)
১০% এর ব্যবধানে বিএনপি হেরেছে ৯ (আ’লীগ) ২ (জাতীয় পার্টি) ১১ (মোট)
১০% এর ব্যবধানে আ’লীগ হেরেছে ১৮ (বিএনপি) ২ (জামায়াত) ৩ (অন্যান্য) ২৩ (মোট)
১০% এর ব্যবধানে জামায়াত হেরেছে ২ (আ’লীগ) ২ (মোট)
১০% এর ব্যবধানে জাতীয় পার্টি হেরেছে ২ (আ’লীগ) ২ (মোট)
১০% এর ব্যবধানে অন্যান্য হেরেছে ১ (বিএনপি) ৫ (আ’লীগ) ১ জাতীয় পার্টি ৭ (মোট)
দেখা যাচ্ছে, যদি ৫% ভোটার বিএনপি-জামায়াত ছেড়ে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয় তাহলে জোটের আসন কমবে ১২ টি। অপরপক্ষে যদি একই পরিমাণ ভোটার আওয়ামী লীগ ছেড়ে বিএনপিকে ভোট দেয় তাহলে আওয়ামী লীগের আসন কমবে ১২ টি।
এই পক্ষত্যাগ যদি ১০% ভোটারের ক্ষেত্রে ঘটে তাহলে বিএনপির কমবে ২১ টি এবং আওয়ামী লীগের কমবে ১৮ টি। ফলে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের ভোট ১০% বাড়লেও আসন সংখ্যা ২০-২৫টির বেশী বাড়বে না। ২০০১ সালে দলটি পেয়েছিল ৬২ আসন। তার সাথে আরও বিশটি যোগ হলে হতে পারে ৮২ টি। ১০% ভোট বাড়ার মত তেমন কোন কাজ দলটি কিন্তু করেনি।
এক-এগারোর অভ্যূত্থানের মূল কারণ হিসাবে অনেকে এই ভোটের সমীকরণকে দায়ী করেন। বর্তমান সরকার যে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল সে কথা দলটির সভানেত্রী প্রকাশ্যে বলে বেড়াতে দ্বিধা করেন নি, এমনকি অনেক আগেই এই সরকারের সকল কর্মকান্ডের বৈধতা দেয়ার ব্লাক চেকে তিনি সই করে রেখেছেন। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে যে বর্তমান সরকার এবং তাদের নিয়োগকৃত নির্বাচন কমিশন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তা তারা বার বার বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার তো এ বিষয়ে কোন রাখ-ঢাক করার দরকার বোধ করেন নি।
৬০ আসনের দলকে জিতিয়ে আনার জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়েছে।
বিএনপিকে খন্ড-বিখন্ড করার জন্য নির্বাচন কমিশন প্রানান্ত চেষ্টা করেছে। দলটির নেতা-কর্মীদের উপর এক ধরণের কেয়ামত নামিয়ে এনে দলটিকে ভেঙ্গে-চুরে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। দুর্নীতির মামলা দিয়ে জনপ্রিয় নেতারা যাতে নির্বাচনে না দাড়াতে পারে সে ব্যবস্থা করতে চেয়েছে।
কিন্তু, এই সকল পদক্ষেপের পরও বিএনপির পরাজয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। বরং খালেদা জিয়ার চট্টগ্রামের জনসভার পর মনে হচ্ছে মিডিয়া আর সুশীল সমাজ মিলে বিএনপির যত খারাপ অবস্থা তুলে ধরেছে, দলটির জনপ্রিয়তা প্রকৃতপক্ষে ততোটাই বেশী।
আসলেই ভোটের মাঠে বিএনপি-জামায়াতকে হারানো খুব বেশী সহজ নয়। ২০০১ এর নির্বাচনে ভোটের যে সমীকরণটির প্রকাশিত হয়েছে তা এখনো খুব একটা বদলায়নি। চারদলীয় জোট গত দুই বছর এক হিসাবে বিরোধী দলে থেকেছে। বিশেষ করে বিএনপির উপর যে কেয়ামত গেছে, তার কারণে দলটির প্রতি সাধারণ মানুষের জমে থাকা ক্ষোভ অনেকটাই প্রশমিত হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুৎ, দুর্নীতি - ইত্যাদি ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের ব্যর্থতার কারণে দলটির বিরুদ্ধে আনীত অনেক অভিযোগই হাস্যরসের উপাদানে পরিণত হয়েছে।
কেউ কি এখনো বিশ্বাস করবে যে তারেক জিয়া সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিতেন? অপরদিকে বর্তমান সরকার এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক মহলের প্রকাশ্য ইসলাম বিরোধী অবস্থানের কারণে ধর্মভীরু জনগণের মধ্যে আওয়ামী লীগ ভীতি অনেক বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ২০০১ এর মতই। এখনও নৌকা ঠেকাও রব উঠলে তাতে ব্যাপক গণসমর্থন পাওয়া যাবে। ফলে একটি মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে এবং তাতে সকল দল বাধাহীনভাবে অংশ নিতে পারলে ফলাফল ২০০১ এর মতই হতে পারে।
প্রথমে চেষ্টা করা হয়েছিল জরুরী অবস্থার মধ্যে নির্বাচন করে, দেশীয় পর্যবেক্ষকদের উপর বাধানিষেধ, নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশে বেসরকারী মিডিয়াকে অনুমতি না দেয়া - ইত্যাদি বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে কারচুপির ব্যবস্থা রাখা এবং দল গোছানো, দলীয় নেতা-কর্মীদেরকে উজ্জীবিত করা ইত্যাদির জন্য বিএনপি যেন কোন সময় না সে ব্যবস্থা করার মাধ্যমে দলটিকে অপ্রস্তুত রেখে নির্বাচন সম্পন্ন করার মাধ্যমে চার দলীয় জোটকে পরাজিত করা।
কিন্তু খালেদা জিয়ার চট্টগ্রামের জনসভা এই কৌশলের সাফল্য নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতিতে সবথেকে নিরাপদ মনে হচ্ছে, বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা। জোটের শক্তিশালী শরীক জামায়াত কতৃক নির্বাচনের জন্য খালেদাকে চাপ দেয়ার কথা পত্র-পত্রিকায় আসার পর পরই দলটির আমীর ও সেক্রেটারী জেনারেলকে একসাথে গ্রেফতার করা হয়। এরপর দলটি নির্বাচনের বিষয়ে আরো নেতিবাচক অবস্থানে চলে যায়। বিএনপি নির্বাচনে না আসলে আওয়ামী লীগের পক্ষে খুব সহজেই জয়ী হয়ে আসা সম্ভব হবে, এমনকি কিছু এদিক-ওদিক করে তারা হয়তো দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠতাও পেতে পারে।
আসল খেলাটা শুরু হবে তখন। প্রকাশ্য দিবালোকে মিটিয়ে মানুষ হত্যার পর লাশের উপর কর্মীদের নৃত্য করার পর যে দলের নেত্রী আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে বলতে পারেন যে, ওগুলো তো মানুষ না, সাপ, তাদেরকে সাপের মত পিটিয়ে মারাতে তাই কোন অন্যায় হয়নি, সেই দল দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় আসলে কি করবে তা সহজেই অনুমেয়। দলটি বাংলাদেশে একবারই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল এবং তখন কি করেছে তা এখনকান প্রজন্মের অনেকেই জানে না। গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছিল, সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, বিরোধী দলের হাজার হাজার সদস্যকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই সময় বিশ্বব্যাপী জঙ্গীবাদ এতোটা ছড়িয়ে পড়েনি।
কিন্তু, তারপরও এদেশের হাজার হাজার তরুন সে সময় সশস্ত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। এখন সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সত্যি সত্যিই বাংলাদেশকে জঙ্গীবাদীদের স্বর্গ বানানো সম্ভব হবে। বাংলাদেশকে ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের কাতারে দাড় করানোর প্রচেষ্টা তখন হয়তো পূর্ণতা পাবে। স্বাভাবিকভাবেই তখন জাতিসংঘের শান্তিবাহিনীকে আরেকটি দেশের শান্তিরক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে।
একটি সিনেমার কাহিনী দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই।
সিনেমাটির নাম দ্যা টাইগার এন্ড দ্যা স্নো। ইতালিয়ান ছবি। বিখ্যাত পরিচালক ও নায়ক রবার্তো বেনিংনি পরিচালিত ও অভিনীত।
নায়ক এলিয়টি ডি গিওভানি একজন সাহিত্যের প্রফেসর, দুই মেয়ের ডিভোর্সড বাবা। ভিটোরিয়োর প্রেমে তিনি পাগল, যদিও ভিটোরিয়ো তাকে পাত্তা দেয় না।
এক গভীর রাতে এলিয়টি তার ইরাকী কবি বন্ধু ফুয়াদের ফোন পান। ফুয়াদের জীবনী লিখতে বাগদাদে গিয়েছিলেন ভিটোরিয়া। ফুয়াদ জানান সেখানে যুদ্ধে ভিটোরিয়া আহত হয়ে কোমাতে রয়েছেন। এলিয়টি তখনই ছুটলেন এয়ারপোর্টে। বাগদাদের ফ্লাইটের টিকেট চাইলে তাকে সকলে পাগল ভেবে বের করে দিলো।
কেননা, বাগদাদে তখন এয়ারপোর্ট বলে কিছু আর অবিশিষ্ট নেই। তিনি রেডক্রসের সহায়তায় ইরাকে প্রবেশ করলেন। বাগদাদ থেকে অনেক দূরে তাকে নামিয়ে দিলো রেডক্রসের গাড়ী। বাগদাদ তাদের জন্য নিরাপদ নয়। তিনি কিছুদূর গাধার পিঠে গিয়ে পেলেন একটা বাস।
একটু আগে বোমা পড়েছে তাতে। সিটে রক্তাক্ত লাশ। তিনি বাস চালিয়ে গেলেন কিছুদূর। তারপর পায়ে হেটে, পরিত্যাক্ত মোটর সাইকেলে করে, উঠের পিঠে চেপে অবশেষে তিনি বাগদাদে পৌছলেন এবং ভিটোরিয়ার দেখা পেলেন তিনি। বিধ্বস্থ হাসপাতালের এক কোনায় ভিটোরিয়া পড়ে আছেন।
ডাক্তার জানালেন, তার জন্য যে ওষুধ প্রয়োজন তা হাসপাতালে নেই। বিধ্বস্থ হাসপাতাল, ওষুধ তো দূরের কথা, সেখানে রোগীদের থাকার মত বিছানাপত্রই নেই। এলিয়টি বের হলের ওষুধের খোজে। অনেক কষ্টে একটা ফার্মেসী খোলা পাওয়া গেলে তার দরজা ঠেলে দেখা গেলো ভিতরের সব কিছু লুটপাট হয়ে গেছে, শুধু বিক্রেতার চেয়ার পড়ে রয়েছে পচে যাওয়া লাশ। অবশেষে ফুয়াদের মনে হলো একজন অশীতিপর বৃদ্ধ হেকিমের কথা।
তিনি কিছু হেকিমি চিকিৎসা দিলেন যাতে ভিটোরিয়াকে কোন রকমে বাচিয়ে রাখা গেলো। পরে তিনি জীবনের ঝুকি নিয়ে রেডক্রসের কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে এসে ভিটোরিয়োকে বাচালেন। ফুয়াদকে খবরটা দিতে গিয়ে দেখা গেলো তিনি গলায় ফাসি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। কমেডি সিনেমা। হাসতে হাসতে হাওমাও করে কাদার মত সিনেমা।
মাত্র কয়েক বছর আগের সমৃদ্ধ বাগদাদ যে কিভাবে মৃতের নগরীতে পরিণত হয়েছে, তা প্রতিটি দৃশ্যে দেখা যায়।
কে জানে, হয়তো আগামী কয়েক বছর পর এই ব্যস্ত রাজধানী পরিণত হবে ভুতুড়ে নগরীতে, চন্দ্রিমা উদ্যান, ধানমন্ডি লেক আর রমনা পার্ক ভর্তি হয়ে যাবে মাইনে। আমাদের বিশাল হাসপাতালগুলোতে হয়তো তখন সামান্য স্যালাইন পাওয়া যাবে না। রাস্তায় রাস্তায় হয়তো টহল দেবে বিদেশী সৈন্য।
অনেকেই এগুলোকে অবাস্তব কল্পনা বলে উড়িয়ে দিবেন।
দশ বছর আগে বাগদাদবাসীকে আজকের বাগদাদের চিত্র একে দেখালে তারাও হয়তো তাই ই করতো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।