আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আজকের বই: আনিসুল হক-এর ‘মা’

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

নিটোল গল্প ক’জন লিখতে পারে? আমি স্টোরি টেলিং-এর কথা বলছি। গল্পের নামে আধা-নিবন্ধ. আধা-প্রবন্ধ নয়। গল্প মানে স্টোরি।

যিনি মুখে বা লিখে গল্পটা বলেন-তিনি স্টোরি টেলার। মনের নানাবিধ জঞ্জাল সরিয়ে নির্মেদ টানটান একটা গল্প লেখা অত সহজ নয়; দীর্ঘকালীন সাধনার প্রয়োজন; সেই সঙ্গে আবশ্যক হয় গভীর চিন্তাভাবনার। গানের মেলোডির মতোই নিটোল একটা গল্প বলাও মানবসভ্যতার প্রধানতম আর্ট। যে আর্ট আয়ত্বে আনার লক্ষ্যে কখনও কখনও নিরাপদ সড়ক ছেড়ে অচেনা বন্ধুর পথেও হাঁটার ঝুঁকি নিয়ে হয় কারও কারও। আমার অটল বিশ্বাস- আনিসুল হক তাদের মধ্যে একজন।

১৯৯৩-৯৪ সালের কথা। আমাদের বসার ঘরে লম্বা একটা সোফা ছিল। সন্ধ্যার পর মিঠুন ভাই ওখানে টানটান হয়ে শুয়ে পড়তেন। নীলক্ষেত হয়েই আসতেন। সঙ্গে থাকত হুমায়ুন রেজা কি আদিত্য কবির কি ব্রাত্য রাইসু।

তখন বিশ্ববিদ্যায়ে পড়ি। আমাদের বসার ঘরে প্রত্যেহ সন্ধ্যার আড্ডা জমজমাট ছিল। হয়তো সাজ্জাদ শরীফ লুকিয়ে একটা 'নিষিদ্ধ' বই এনেছেন। অল্প অল্প পাঠ করে তারই ব্যাখ্যা-বয়ান করতেন। তসলিমা তখন দুবাংলার মঞ্চ মাতিয়ে রেখেছেন;তাকেও গালাগালি করা হত সমানে।

তা ছাড়া আলোচনায় একে একে উঠে আসতেন জয় গোস্বামী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, টেড হিউজেস, জাঁ লাকা কি দেরিদা; শঙ্খ ঘোষ কি বিনয় মজুমদার প্রমূখ। তো, কে মিঠুন ভাই ? মিঠুন ভাই হচ্ছেন আপনাদের আনিসুল হক। আপনাদের আনিসুল হকই আমার কাছে মিঠুন ভাই। যদিও বহুবছর আমাদের দেখা হয় না- তাঁর জীবনের এক বিশেষ পর্বে আমি অত্যন্ত ঘনিষ্ট ছিলাম তাঁর সঙ্গে। আমাদের আড্ডায় অন্যতম আকর্ষন ছিলেন মিঠুন ভাই।

মিঠুন ভাইয়ের জন্ম: ১৯৬৫, ৪ মার্চ। রংপুরে বাবা মোফাজ্জল হক। মা আনোয়ারা বেগম। শৈশবে পড়াশোনা করেছেন প্রথমে রংপুরের পি টি আই প্রাইমারী স্কুলে, তারপর রংপুর জেলা স্কুলে। ম্যট্রিক পাশ করে পড়েছেন কারমাইকেল কলেজ।

তারপর ঢাকার জীবন শুরু। মেধাবী ছাত্র ছিলেন। কতকটা পরিবারের চাপেই বুয়েট-এ ভর্তি হলেন; সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং-এ। আসলে মিঠুন ভাই হতে চেয়েছিলেন একজন পথিক কিংবা ভবঘুরে কিংবা কবি। সুন্দরের অন্বেষায় কাটাতে চেয়েছিলেন এই অপার্থিব জীবন।

তেমন ঠিক হল না। আবার হলও। পাশ করলেন বুয়েট থেকে। এখন কি করবেন? সেই দোলাচল। ঠিক এই সময়টায় আমার সঙ্গে পরিচয়।

তখন বলছিলাম না-গানের মেলোডির মতোই নিটোল একটা গল্প বলাও মানবসভ্যতার প্রধানতম আর্ট। যে আর্ট আয়ত্বে আনার লক্ষ্যে কখনও কখনও নিরাপদ সড়ক ছেড়ে অচেনা বন্ধুর পথেও হাঁটতে হয়। আনিসুল হক তাদের মধ্যে একজন। বুয়েট থেকে পাশ করার পর পরিস্থিতির চাপে একটা সরকারী চাকরি নিলেন। বিবেকের দংশনে ১৫ দিন পরে সে চাকরি ছেড়েও দেন মিঠুন ভাই।

কেননা, মিঠুন ভাই কবিতার আরাধনায় ডুবে থাকতে চাইতেন; লিখতে চাইতেন গল্প চাইতেন। চাকরিবাকরি ভাল লাগত না। কবিতায় সুন্দরকে খুঁজছেন। ততদিনে কবির জীবনে এক নারী এসে গিয়েছে। (মিঠুন ভাই কি হ্যান্ডসামই না ছিলেন!) মেরিনা আপাকে অল্প অল্প ভালো লাগছে।

মেরিনা আপা তখন একটা খবরের কাগজে চাকরি করতেন। হাত ছুঁতে ইচ্ছে করে-কিন্তু, সংসারের দায়দায়িত্ব? আমি কি আজন্ম পথিক নই? নই রেললাইনের পাশে বেঁকে যাওয়া ভেজা পথটি ছায়াহীন কায়াশূন্য এক হেঁটে যাওয়া ঘোর লাগা সুন্দরের সর্বশেষ পুরোহিত? সংসার? আমি কি নই ত্যাগী? শিকড়ে লিপ্ত জল? যে জলে ঈশ্বর আছে মীনরুপে ... মনের ভিতরে তখন এমনই কলরোল। আমি কি ছোঁব মেরিনার হাত? তখন কি মিঠুন ভাই জানতেন যে-একদিন ‘মা’ নামে একটা উপন্যাস লিখবেন, ওটা ওড়িয়া ভাষায় অনুদিত হবে, তিনি উড়িষ্যা যাবেন সে বইয়ের উদ্বোধনী অনুষ্টানে। সঙ্গে স্ত্রী। মেরিনা হক।

কবির স্বপ্নের নারী। আমি সেই ১৯৯৩-৯৪ সালের কথা বলছিলাম। সন্ধ্যার পর আমাদের বসার ঘরের লম্বা সোফায় মিঠুন ভাই টানটান হয়ে শুয়ে থাকতেন। মুখের উপর হাত। আমি পায়ের কাছে বসে।

সিগারেট টানছি। মোজার গন্ধ পাচ্ছি। হুমায়ুন রেখা খাতার উপর স্কেচ করছে ...কার যেন ...আজ আর মনে নাই .... নীলক্ষেত হয়েই এসেছে ওরা। কাজেই, ইষৎ এলোমেলোই ছিল দুজন। মিটন ভাইয়ের মুখে কদিনের না-কাটা দাড়ি জন্মেছে।

নারী ও কবির অনিবার্য টানাপোড়েন চলছে। এক ভবঘুরেকে যখন নিরুপায় হয়ে নিছক চাকরির সন্ধান করতে হয় তখন নেশাই হয়ে ওঠে অন্যতম আশ্রয় । আমি ছিলাম স্পর্শকাতর হৃদয়ের অধিকারী। কবির মানসিক উদ্বেগ আমি বুঝতাম। চাকরি না লেখালেখি? সেই সময় বাংলাদেশে সংবাদপত্রের ইতিহাসে এক কল্যাণকর বিপ্লব ঘটে যাচ্ছিল।

পুরনো সংবাদপত্রের কবরের উপর নতুন কটি সংবাদ পত্র দৃঢ় পায়ে উঠে দাঁড়াচ্ছিল। তারই একটিতে জয়েন করলেন মিঠুন ভাই। মেরিনা আপাও খবরের কাগজের জগতেরই একজন। সুতরাং, ... বলছিলাম যে, আমি মিঠুন ভাইয়ের মানসিক উদ্বেগটা বুঝতাম। গল্প লেখার উদ্বেগ।

আড্ডায় আমরা গল্প লেখার কৌশল নিয়ে আলোচনা করতাম। মিঠুন ভাইয়ের হাতে হুমায়ুন আহমেদের বই। বলতেন, দেখ ইমন, হুমায়ুন আহমেরে বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় একটা গল্প থাকে । তারপর সেই গল্পটাই তরতর করে এগিয়ে যায়। হু।

আমি একমত হই। এই গল্পের শুরুতে মশারির ভিতর এক মশা ঢুকে গেছে। চরিত্র ভাবছে মশাটা স্ত্রী না পুরুষ। লেখাটা এভাবে তরতর করে এগিয়ে যায়। মিঠুন ভাই বললেন।

তাই তো। এবার হুমায়ুন রেজা সহমত হয়। গল্প লেখা নিয়ে কী ভীষন উদ্বেগ ছিল মিঠুন ভাইয়ের মধ্যে। তখন কি আমরা জানতাম- একদিন ‘মা’-এর মতন উপন্যাস লিখবেন তিনি। লিখে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

অজস্র কবিতাও লিখেছিলেন মিঠুন ভাই। ওই সময়ে লেখা এই কবিতাটি আজও মনে পড়ে। বুকের মধ্যে অই মেয়েটির ছায়া ছায়ার ভিতর অই মেয়েটি নেই। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের সামনে কতবার যে কোট করেছি এ দুটি চরণ। আমার কাছে আজও আনিসুল হক আপাদমস্তক কবি।

সুন্দরের অন্বেষক এক কবি। আপনাদের কাছেও তিনি যেন তেমনই প্রতিভাত হন। চিরকাল। Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।