দাগ খতিয়ান নাইতো আমার/ঘুরি আতাইর পাতাইর...
আজ অভিশপ্ত ১৫ নভেম্বর। হাওররাজ্য সুনামগঞ্জের বিরলপ্রজ জনপ্রতিনিধি, জোছনাপ্রিয় (যিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বর্ষার ভরা পূর্ণিমা রাতে পৌরসভার বাতি নিভেয়ে জোছনা দেখতেন, হাওরে বজরা ভাসিয়ে তরুণদের নিয়ে গান কবিতা গাইতেন) কবি-বিপ্লবী মমিনুল মউজদীনের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী। ২০০৭ সালের সিডর তান্ডব আকাশ ঘোমরা করা মেঘদুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল নামক স্থানে বৃহত্তর সিলেট বিভাগের জনপ্রিয় এই মুখ, আলোকিত মানুষের রোল মডেল, অসাম্প্রদায়িক মমিনুল মউজদীন স্ত্রী তাহেরা চৌধুরী, পুত্র কাহলিল জিবরান ও ড্রাইভার কবির মিয়াসহ মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।
ভয়ঙ্কর সিডর তান্ডবে যখন বাংলাদেশের সমুদ্র উপকুলবর্তী এলাকাসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চল তছনছ, তখন বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সুনামগঞ্জ এর উপর দিয়ে বয়ে যায় এক বিধ্বংসী সিডর। একটি সম্ভাবনাময় প্রাণের অকাল প্রয়াণে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে এই অঞ্চলের লোকজন।
শোক উড়ে শহরে, গ্রামে, যানবাহনে। মানুষের বুকের ভেতরে নেমে যায় শোক। প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে ধর্ম, বর্ণ, দলমত নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ আপনজন হারানোর বেদনায় ডুকরে কেঁদে উঠে। প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বতস্ফুর্ত শোকপ্রকাশ, কালো পাতাকা, পোস্টারে ছেয়ে যায় সুনামগঞ্জ। শোকের ছায়া শহরের সীমানা পেরিয়ে সুনামগঞ্জ জেলার শ্যমলিমা গ্রামেও পৌছে, স্বজন হারানোর বেদনায় হাহাকারে ভেসে যায় গ্রাম্য লাজুক বধু, শিশু, যুবকরা হাহাকার করে ওঠে।
এই কষ্ট তাদের বিদীর্ণ করে বুকের গভীরে নেমে হৃদপিন্ডে আঘাত করে। তারা স্বজন হারানোর বেদনায় কাতর হয়ে ওঠে। এসকল গ্রাম্য বধূ, যারা কখনো দেখেনি মউজদীনকে, কথা বলার সুযোগ পায়নি, শুধু শোনেছে লোকমুখে এই মহা নায়কের কথা। তারা জানতে চায় নিকটজনদের কাছে কিভাবে এমনটি হলো। কেন এমন বিনয়ী, হাসি হাসি সৌম্য দর্শনের যুবরূপী প্রৌঢ়কে সপরিবারে অকালে যেতে হলো।
এভাবেই গ্রামের নারী-পুরুষ শিশু-যুবক মউজদীনের চেনাজানা লোকদের আকুল হয়ে প্রশ্নবাণে জর্জড়িত করেন। তার ঘনিষ্টজনদের হাজার হাজার শোককাতর ভক্ত, অনুরক্তদের প্রশ্নে বোবা কান্না ছাড়া আর কিছুই বলার ছিলনা। তারা এসব প্রশ্নে পাথরচাপা দিয়েছিলেন বুকে।
আমিও এই পাথরচাপাদের একজন। ঘটনার দিন ব্যক্তিগত কাজে সিলেট ছিলাম।
প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় কাজ করার সুবাদে দুপুরেই ফোনে দুর্ঘটনার ভাসাভাসা অবিশ্বস্থ সূত্রের খবর পাই। ফোনে অনেকেই মউজদীন ভাইয়ের দুর্ঘটনার বিষয়ে জানতে চায়। প্রথম দিকে উড়িয়ে দেই গুজব মনে করে। বারবার ফোনকলে অতীষ্ট হয়ে আমার কলিগদের ফোন করি। ওপাশের কান্না থেকে আমার বুঝতে বাকি থাকেনা কি ঘটেছে।
সবার বোবাকান্নায় আমিও শব্দহীন কান্নার অতলে হারিয়ে যাই। পত্রিকা টেলিভিশনেও নিউজ পাঠানো কঠিন হয়ে উঠে। মন শক্ত করার পরও কেপে কেপে ওঠে কলম। বাংলাভিশনের ন্যাশনাল ডেক্সের এসিস্ট্যান্ট ইনচার্জ গেলমান ভাইয়ের মউজদীন ভাইর স্টিল ছবি পাঠানোর তাগদার কথাও বেমালুম ভুলে যাই। ভুলে যাই যায়যায়দিন সিলেট অফিস প্রধান সিরাজ ভাইর সাইড স্টোরীর কথা।
এক ভয়ঙ্কর প্রলয়ের মুখোমুখি দাড়িয়ে তখন আমি...। স্বজন হারানোর শোক এতো পাহাড়ভারী কেন? রাত দেড় টায় সিলেট থেকে তার লাশের সঙ্গে আসি তার ভালোবাসার শহরে। দেখি গভীর রাতেও জেগে আছে শান্ত শহর সুনামগঞ্জ। হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষা করছে তাদের প্রিয় মানুষটিকে দেখতে।
আমৃত্যু বিপ্লবী মউজদীন ভাই শিল্প-সাহিত্যেরও বড় পৃষ্টপোষক।
অন্তরঙ্গ মুহুর্তে কাল মার্কস, এঙ্গেলস, মাও সেতুং, চে গুয়েভারা, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, হুগো শাভেজ, হো চি মিন, নাজিম হিকমত, ম্যক্সিম গোর্কী, আন্তন চেখভদের গল্প করতেন। আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে কথা বলতেন। তার রাজনৈতিক ও সমাজ উন্নয়ন বিষয়ক কথা বলতেন। হালের বিপ্লবী, দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট প্রগতিশীল ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন রাজনীতিবিদদের নিয়ে কথা বলতেন। কথা বলতেন সম্ভাবনাময় এদেশের তরুণ রাজনীবিদদের নিয়ে।
কঠিন মানুষেরও হৃদয় জয় করার অসম্ভব ক্ষমতা ছিল তার। কোথায় রপ্ত করেছিলেন এমন মায়ার টান? পৌরসভার স্ট্রিট লাইট নিভিয়ে জোছনা দেখার এমন আইডিয়া কোথায় পেয়েছিলেন কবি?
দুর্ঘটনার কয়েক মাস আগ থেকে আমাকে নিয়ে সুনামগঞ্জ থেকে নিয়মিত সাহিত্য ম্যাগাজিন করার কথা ছিল। মারুফ মান্না ভাইয়ের বাসায় ঈদের পর উজ্বল ভাই, খলিল ভাই আমি ও মউজদীন ভাই এ নিয়ে ঘরোয়া মিটিংয়ে বসি। আলাপ অনেক দূর এগোয়। দুর্ঘটনার তিনদিন আগে সংবাদপত্রের লতিফ ভাইয়ের দোকানে শেষ কথা হয়।
বলেছিলেন, ''শামীম ঢাকা থেকে এসে একসাথে বসবো; তুমি কবিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে লেখা নিয়ে কথা বলো''। এর আগে হাসন উৎসবের জন্য পুরাতন পৌরসভায় বসি। সেখানেও দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রতিষ্টিত তরুণ লিখয়ী, নাট্যকার, শিল্পিদের নিমন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়ে কথা উঠলে তিনি আমার নাম প্রস্তাব করেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। বিশেষ করে শিল্পী সাংবাদিক সঞ্জীব চৌধুরীকে আনার কথা উঠে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য আমাকে বলেন মউজদীন ভাই।
সঞ্জীবদার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও আমাদের আশা অপূর্ণই থেকে যায়। মউজদীন ভাইর মতো পিঠাপিঠি সময়ে সিডর রাতে সঞ্জীবদাও মারা যান আমাদের কাঁদিয়ে...।
কথা হচ্ছিল গ্রামের বধূদের নিয়ে; যারা কখনো দেখেনি, কথা বলেনি। অথচ তার কথা কেবল অন্যদের কাছ থেকে শোনেছে। আর শোনেই কেবল ভেতরে এমন শান্তসুন্দর মানুষটিকে মনে গেঁথে নিয়েছে।
কোমল নারীর পলিহৃদয় উথলে উঠে প্রথম প্রেমের দারুণ আবেগে জানতে চায় কিভাবে এমনটি ঘটতে পারে। এমন মানুষের জীবন এত মর্মান্তিক ঝড়ে পড়ে কেন। তাদের জানার কৌতুহল দেখে মনে হয় এমন মানুষটি যেন তাদের হাজার বছরের চেনাজানা। আমার নিজ গ্রাম ও পার্শবর্তী গ্রামের এমন হাজার বধূ, তরুণীদের গভীর আগ্রহ নিয়ে তার বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। জানতে চেয়েছেন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছেন এমন বয়সী নারী পুরুষ, স্কুল-কলেজ পড়–য়া ছাত্র।
তাদের প্রশ্নের ধরণ বুঝে মনে হয়েছে তাদের কাছে মউজদীন এক বিশাল মানুষ; যিনি কেবল ছায়া দেন, মায়া দেন মানুষের জন্য নিঃস্বার্থ ভালোবাসা উজার করে দেন। তারা গল্প শোনেছে বিভিন্ন মাধ্যমে-অভিযাত পরিবারের সন্তান কিভাবে খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষের পাশে মমতাসিক্ত হৃদয় নিয়ে দাড়ান। তারা শোনেছে, মউজদীন দিনমজুর, রিক্সাঅলা, নিগৃহীত, নির্যাতিতদের পাশে দাড়ান। অন্যায়কারী, ঘুষখোরদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন, যব সমাজকে রক্ষার জন্য নকল ও মাদকের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন, কৃষকদের দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনের ঢাক দেন। ঘুষখোর আমলাকে খেদিয়ে বিদায় করেন।
তারা শোনেছে অসাম্প্রদায়িক মউজদীন ভন্ড, ধর্ম ব্যবসায়ী বক ধার্মিকদের বিরুদ্ধে লড়েন; মসজিদ-মন্দিরের মুয়াজ্জিন-পুরোহিতের বেতন দেন। তারা শোনেছে প্রসব বেদনায় ছটফট করা কোনো অসহায় নারীকে মউজদীন চিকিসাকেন্দ্র পাঠিয়ে ডাক্তারদের প্রেসার ক্রিয়েট করে করে তাদের সূচিকিৎসার ব্যবস্থা করেন; রিক্সা ড্রাইভারের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলের ফরম ফিলাপের ব্যবস্থা করেন। অসহায় নিম্নবর্গের মানুষ যারা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সমস্যায় ভোগতো তারা মউজদীনের অকৃপণ সহযোগিতা পেতো। তাই এসকল নারী-পুরুষ মউজদীনকে দেবতুল্য মনে করতো।
এসব শোনে শোনেই তারা ''একজন মউজদীন''কে আপন করে নেন।
তাদের হৃদয়ে স্থান দেন একজন মহানায়ক হিসেবে। একজন মউজদীন এভাবেই হয়ে উঠেন অনন্য। অসাধারণ। জোছনার মতো কোমল বিনয়ী। সংগ্রামী।
হৃদয় হরণকারী। দাবি আদায়কারী জননেতা। হয়ে উঠেন মানুষের আশা-ভরসার প্রতীক। অবশেষে তাকে হারিয়ে হয়ে পড়েন অভিভাবকহীন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।