ফ্রম দ্যা হার্ট অফ ডার্কনেস
আমার নিজ জেলা বগুড়া। জেনারেল জিয়ার জন্মস্থানও বগুড়া। এমনকি আমি যে স্কুলের ছাত্র ছিলাম "বগুড়া জিলা স্কুল", উনি কয়েকদশক পূর্বেই সেই জিলাস্কুল থেকে মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, এমনটাও শুনেছি। যে পারিবাহিক আবহে আমি বড় হয়েছি, সেখানে প্রেসিডেন্ট জিয়া এখনো এক কিংবদন্তীতুল্য মহানায়ক। কলেজ জীবন পর্যন্ত আমি তাঁকে পারিবারিক আবহের দৃষ্টিতেই দেখতাম।
তবে যে কোন অনুসন্ধিৎসু মনের নিকট সত্যকে বোধকরি বেশিদিন ঠুলি পরিয়ে রাখা যায়না। আরোপিত সেই ঠুলিকে সরিয়ে জেনারেল জিয়ার যে রুপ আমি এখন দেখতে পায়, সেখানে সে একজন স্বৈরাচারি , সুযোগসন্ধানী এবং নিষ্ঠুর রাষ্ট্রনায়কের পরিবর্তে আর কিছুই ধরেনা পড়েনা। অনেকেই তাঁর মুল্যয়নে তাঁর ব্যাক্তিগত সততার চর্চাকে খুব বড় করে তুলে ধরেন। হয়তোবা তিনি ব্যক্তিগত জীবনে সত্যই সৎ কোন ব্যাক্তি। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা শাসকের মুল্যয়নে ব্যক্তিগত সততার দাম কতটুকু? ইতিহাসের খলনায়ক হিসেবে বিবেচিত হিটলার কিংবা স্ট্যালিন ব্যাক্তিগত জীবনে অসৎ ছিলেন এমন প্রমান কিন্তু মিলেনা।
ভারত বর্ষের ইতিহাসে আর এক চরিত্রের সাথে জিয়ার সাদৃশ্য আমি খুঁজে পাই। সে মুঘল সম্রাট আওরংগজেব। বাদশাহ শাহাজাহানের চারপুত্র দারাশিকো, শাহসুজা,আওরংগজেব আর মুরাদ বখশ; তৃতীয় এবং সবচে চৌকষ আওরংজেব। সম্রাট শাহজাহানের ইচ্ছা দারাশিকোকে সিংহাসনে বসাবেন এবং মুঘলসাম্রাজ্যের রীতি তাই বলে। কিন্তু উচ্চভিলাসী চৌকস কুটকৌশলি আওরংগজেব তা মানবেন কেন? তাই তিনি কনিষ্ট মুরাদ'কে ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে বাদশাহ শাহজাহানকে বন্দী করেন আগ্রায় আর দারাশিকোকে বিতাড়িত করেন।
অত:পর সেই মুরাদকে কেই বিষপ্রয়োগে হত্যা করেন। তার কুটকৌশল আর সামরিক শৌর্যের ভয়ে শাহসুজা পালিয়ে যান আরাকানে। সেখানে আরকান রাজাদের হাতে তার মৃত্য ঘটে।
আর জৈষ্ট্যভ্রাতা দারাশিকোকে তিনি নির্মমভাবে নিজহাতে হত্যা করেন।
একথা অস্বীকার করার জো নেই আওরংজেব সফল মুঘল সম্রাটদের একজন।
রাজ্যবিস্তারে সম্রাট আকবরের পরেই তিনি সফলতম জন হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন। তার শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্য
সংগঠিত হয়েছিলো। তবে ইতিহাসবিদদের মতে তার শাসনামলই আসলে
মুঘল সাম্রাজ্যে ভাংগনের বীজ রোপিত হয়েছিলো। অমুসলিমদের উপরে
জিজিয়া কর স্থাপন, অসংখ্যা মন্দির ভেংগে , শরিয়া আইনের প্রচলন ঘটিয়ে পুর্বাপর মুঘল সাম্রাজ্যের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মুল ব্রিটিশপূর্ব যুগে তিনিই কুঠারাঘাত করেছিলেন।
ঠিক একই ভাবে, ৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশের যে রাজনীতিতে যে সামরিকশাসনের জাতাকলে বারবার বন্দীহওয়া, স্বাধীনতা বিরোধীদের যে উত্থান, বহুজাতিক গণতন্ত্রের নামে যে সংকর আদর্শের আবির্ভাব তাতে তাতে একক ব্যাক্তিত্ব হিসেবে জেনারেল জিয়ার লিগ্যাসি বাংলাদেশ আজ বহন করে চলেছে।
জেনারেল জিয়ার এরুপ লিগ্যাসিতে কর্ণেল তাহেরের অবদান কতটুকু আর
তাকে কিভাবেই বা জিয়ার পাশে তাকে উপস্থাপন করা সম্ভব?
তাহেরকে অনেকেই রোমান্টিক বিপ্লবী কিংবা ফুলিশ রোমান্টিক বিপ্লবী হিসেবে চিহ্নিত করেন। আসলে বিপ্লবী ব্যাপারটা অনেকটা রোমান্টিক, অন্তত ইমাজিনেশেনর ক্ষেত্রে। স্বপ্ন দেখতে না পারলে, ঝুঁকি নেওয়ার মতো
যথেষ্ট সাহস না থাকলে, শুধু তত্ত্বকথা আর বুলি কপচিয়ে বিপ্লব হয়না।
কর্ণেল তাহের সেনাকর্মকর্তা, চৌকষ কর্মকর্তা। হয়তোবা সে কারনেই তার বিপ্লবকেন্দ্রিক চিন্তায় প্রচলিত সেনাবাহিনীর রিফর্মেশনের ভাবনা এসেছে।
তিনি গরীব দেশের পটভুমিকায় সেনাবাহিনীকে শ্বেতহস্তির ভুমিকায় না রেখে উৎপাদনশীল সেনাবাহিনীতে রুপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন। এটাকে রোমান্টিক ভাবলে ভাবা যায় তবে এটা চিন্তার জগতে অভিনবত্ব।
সেনাবাহিনী নিয়ে শেখ মুজিব কিংবা মুজিব প্রশাসনে চিন্তাধারা বেশ লক্ষনীয়। অনেকটাই তাহের ভাবনার বিপরীতে। শেখ মুজিবের প্রচলিত সেনাবাহিনীতে কোন আস্থা কিংবা বিশ্বাস ছিলোনা।
সেই সময়ের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটও তাকে এক্ষেত্রে রসদ যুগিয়ে থাকতে পারে। সমসাময়িক সময়ে চিলির নির্বাচিত সালভাদর আয়েন্দের সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতাচ্যুতি
কিংবা তার কিছুকাল পূর্বে জেনারেল সুহার্তোর হাতে সুকর্ণের পতন মুজিবমানসে সন্দেহের বীজ ঢুকিয়ে দেয়। তিনি সেনাবাহিনীর বিকল্প হিসেবে গড়ে তুললেন রক্ষীবাহিনী যার পুরো নিয়ন্ত্রণ থাকবে নিজহাতে। রক্ষীবাহিনীর ক্ষমতার নিয়ন্ত্রন নিজহাতে থাকলে, সেই বাহিনীর অত্যাচার, অন্যায়ের, বীভৎসতার নিয়ন্ত্রণ আসলে তার হাতে ছিলোনা। সেই রক্ষীবাহিনীই আসলে তাঁর পতন ত্বরাণ্বিত করেছিলো।
(চলবে......)।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।