আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রহিম-রূপবান যাত্রাপালা.......... বয়স শেখায় বর্ণমালা পর্ব-২

আত্মবিশ্বাসহীনতায় প্রকট হচ্ছে আত্মার দেউলিয়াত্ব, তবুও বিশ্বাস আগের মতই নিশ্চল..

পর্ব-১ এর পর থেকে কয়েক বছর কেটে গেছে, রহিম এখন শেষবর্ষের ছাত্র ;তাজেলের সঙ্গে হৃদসংযোগ সর্বোচ্চ মাত্রায় উন্নীত হয়েছে...পরিণয় থেকে সামান্য দুরত্বে ...তাদের অবস্থান রহিম: না না না প্রণয়িনী, এমন অশুভ কথা দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করোনা ; আমার রেজাল্ট খারাপ তো কী হয়েছে?সাহিত্যচর্চা-সঙ্গীতসাধনা করেই আমি নাম-যশ অর্জন করতে পারি! তবে কেন তুমি অন্যের ঘরণী হতে চাও? বলি বলি তোমায় হে নারী... চল.. কাজী অফিস...ঘুরে আসি সইগো...কইরো না দেরি// তাজেল : আমায় ভুল বুঝো না রহিম; জীবনে যদি কাউকে ভালোবেসে থাকি সে অবশ্যই তুমি ; কিন্তু ভালোবাসাও এখন ভাল -বাসায় আসবাবপত্রের মধ্যে অবলম্বন সন্ধান করে যা তোমার পক্ষে দুঃসাধ্য। স্বপ্ন সবসময়ই রঙিন, পক্ষান্তরে বাস্তবতার আকাশ ধূসর বর্ণের ; সেখানে তোমার চেয়ে শতগুণ প্রতিভাবান সাহিত্যিক-শিল্পীরা অনাহারক্লিষ্ট - মৃতপ্রায় পড়ে রয়েছে। তাছাড়া আমাদের সন্তান তার বাবার পেশার কী পরিচয় দেবে বলতে পার? বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করা-পরীক্ষা দেয়া যেমন স্বাভাবিক নিয়ম, কারও সঙ্গে প্রয়োজনাধিক ঘনিষ্ঠ হওয়াটাও প্রায় সেরকম_ এ নিয়ে বাড়তি আবেগ-উত্তেজনা দেখানো নিরর্থক!, আর পিতা-মাতার পছন্দের পাত্রকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার_ বয়স সামান্য বেশি, কিন্তু সম্পদে পরিপূর্ণ। তা... বয়সে কী আসে যায় বল... স্বামী যে-ই হোক কর্মতো সেই একই...!(নীরবতা) আমাদের আর সাক্ষাৎ না হওয়াই বোধহয় মঙ্গলজনক; বিবাহের নিমন্ত্রণ রইল... ( তাজেলের মঞ্চত্যাগ এবং নেপথ্য চরিত্র বিবেকের পুনঃপ্রবেশ) ওরে বেকুব বুঝলি রে ভুল... বহুদিন.. পরে... রূপবান আজও বসে আছে...তোর.. পথ.. চেয়ে.. রহিম: হু ,তাজেলের মত মায়াবিনীর মোহে পড়ে প্রকৃত বন্ধু চিনতে বড্ড ভুল হয়ে গেছে...! দাঁড়াও রূপবান, আমি আসছি, আমি আসছি... ( রহিমের সবেগে মঞ্চত্যাগ, নেপথ্যে যন্ত্রসঙ্গীতের অবিরাম প্রদর্শনী) ($) (মঞ্চে অফিসের কৃত্রিম আবহ ; অধীনস্থ কর্মচারীদের সঙ্গে বৈঠক করছে রূপবান ; সম্ভবত অত্র অফিসের কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত সে ) রূপবান : আমি বুঝতে পারছি না আপনাদের প্রজেক্টের কাজ শেষ করতে এত দীর্ঘ সময় লাগার কী কারণ থাকতে পারে; জুন মাস চলে আসছে; অডিটেরতো দেরি নেই! জনৈক কর্মকর্তা: ( কণ্ঠে ব্যঙ্গ) সময়তো লাগবেই,এই প্রজেক্টে ২জন নারী কর্মকর্তা আছেন না! কাজ যতটুকু করে তার তিনগুণ কাজ আরও বাড়ায়! রূপবান : ( রাগত) ;dnt speak no..n..se..nse, আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন এই প্রজেক্টের প্রধান নির্বাহী আমি স্বয়ং; ... আপনার মানসিক সুস্থতা নিয়ে আমি সন্দিহান! ( হঠাৎ রুমে টেলিফোন বেজে উঠবে ; রিসিভার কানে তুলবে রূপবান) হু, কী নাম বললে ...রহিম? তা সে রহিম-করিম যে-ই হোক বলে দাও মিটিংয়ে আছিÑ ১ঘণ্টার আগে দেখা করা im..po..ssible (দর্শকসারিতে পুনরায় হাসি) রূপবান : আপনাদের একটি কথা না বলে পারছি না : আপনাদের মনে রাখা প্রয়োজন এটি একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, তাই এখানকার নিয়মনীতি সরকারী অফিসের তুলনায় অনেক সুশৃঙ্খল ; অথচ আমি লক্ষ্য করেছি অধিকাংশ কর্মকর্তাই দেরিতে অফিসে আসেন, lunch এর পর সুযোগ পেলেই ঘুমান; আপনাদের অনিয়মের কারণে আমায় জবাবদিহি করতে হয় । তাই আপনারা নিজে থেকে সংশোধন না হলে আমি কঠোর হতে বাধ্য হব ; এখন সবাই আসতে পারেন ।

( পুনরায় ফোন আসবে ) হু..শোন.., দর্শনার্থীকে বলে দাও আমি এখন অফিসের কাজে বাইরে যাচ্ছি ; সে যেন কাল ৪টার পর দেখা করে! (কর্মচারি পরিবেষ্টিত হয়ে রূপবানের মঞ্চত্যাগ) ($) (রূপবান অফিসে বসে কফি পান করছে; হন্তদন্ত হয়ে রহিমের প্রবেশ; রূপবান অবাক না হয়ে তাকে বসতে বলে) রহিম: রূপবান, আমার রূপবান; দেখ আমি ফিরে এসেছি ; আজ কোন দ্বিধা নয়, নয় কোন অনুচ্চারের অনুযোগ আজকের তারকাপুঞ্জ-নীহারিকা আমাদের মিলনোৎসবের সবাক অতিথি! রূপবান : hold your tongue! মূর্খ মানব , আমায় নাম ধরে সম্বোধনের স্পর্ধা তোমার হল কী করে? তোমার কি স্মরণে নাই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি তোমার সিনিয়র ছিলাম! রহিম: এতদিন পর বয়সের হিসাব কেন তুলছো রূপবান ; তুমিইতো সেই যে আমার সঙ্গীত-সাহিত্যের প্রগাঢ় প্রীতিমুগ্ধ ছিলে... আজ আমি নিজে যখন তোমার দুয়ারে মাধুকর হলাম, তুমি সে সময় কাঙাল ভেবে আমায় উপহাস করছো? রূপবান : (উচ্চস্বরে) আবারও বলছি, সম্মানপূর্বক কথা বলতে না পারলে আপন রাস্তা দেখ ; বিশ্ববিদ্যালয়ের আমসত্ত্ব এই বাজারে অচল _ তখন বয়সটাই ছিল দুরন্তপনার ; তুমি লিখতে ভাল - গাইতে ভাল , ভাবতাম তুমিই বোধহয় বেটোফেনের আধুনিক সংস্করণ ; তখন বয়সকে মনে হত ঈশ্বরের মিসটাইমিং । কিন্তু এখন বুঝতে পারি _ “প্রতিভার মোহ সাময়িক ; সুন্দরভাবে বাঁচতে হলে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অবিকল্পিক ”। সত্যি বলতে কি , বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো পাগলামী ক্যাম্পাস প্রাঙ্গনেই ফেলে রেখে এসেছি ; আজ আমি যে অবস্থানে এসে পৌছেছি সেখান থেকে বয়সে ছোট- বেকার এক বাতাবী লেবুকে স্বামী নির্বাচন করাটা প্রচণ্ড নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক হবে!... তোমার অন্য কিছু বলার থাকলে শুনতে পারি! রহিম: সব বলা তো আপনার ফাইলের নিচে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা পড়েছে ম্যাডাম রূপবান ; তার শেষকৃত্যের আনুষ্ঠানিকতাটাই কেবল বাকি....! (নীরবতা) শুধু একটি ক্ষুদ্র জিজ্ঞাসা : এতদিন পরও কেন সেরকম কাউকে খুঁজে পেলেননা যে হেমন্তকালেও আপনার মাঝে শ্রাবণের জলধারা বয়ে দিতে সক্ষম ...! বলুন, বলুন... রূপবান : পাইনি বললে ভুল হবে, বলা যায় নিইনি! তোমাদের মত শিক্ষিত(!) পুরুষেরা নিঃসঙ্কোচে নারীকে সহকর্মী-সহপাঠী ভাবতে পার, কিন্তু বিবাহের ক্ষণ আসলেই কলেজ পড়–য়া -লাবণ্যের আকর স্ত্রী অনুসন্ধানে ব্যস্ত হও! আমার বয়স এখন ৩০ ছুঁই ছুঁই। ব্যস, আমি বাতিলের সারিতে: যাদের সঙ্গে সম্বন্ধ আসে হয় চল্লিশোর্ধ নয়তো বিপত্নীক! এ সমাজে একটা ছেলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যে কোন বয়সে বিবাহের অধিকার রাখে , কিন্তু কোন মেয়ে এমন আকাক্ষা প্রকাশ করলে প্রায়শই আইবুড়ো হয়ে থাকতে হয়! আচ্ছা , কেবল শারীরিক তৃষ্ণা নিবারণই যদি বিবাহের শেষ কথা হয় তবে স্ত্রী আর বারবণিতার প্রভেদ কোথায় ভেবেছো কখনো? (নীরবতা) তবুও এক সহকর্মীর সঙ্গে বহুদূর আলোচনা গড়িয়েছিল ; কিন্তু তার সরল কথা _চাকরিজীবী স্ত্রী সংসারের শান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ! রহিম: ভদ্রলোক যথার্থই বলেছেন : স্ত্রী চাকরি করলে সংসার গোছানো, সন্তান প্রতিপালন এসবে নিদারুণ ব্যাঘাত ঘটে ; তাছাড়া আমার পর্যাপ্ত উপার্জন থাকলে স্ত্রী’ র চাকরি করাটা রীতিমত অনাবশ্যক ঝামেলা! রূপবান : এখানেই তোমার শিক্ষার দারিদ্র! শোন নির্বোধ , মানুষ চাকরি করে তার মেধার প্রয়োগকে নিশ্চিত করতে; তুমি-আমি সমযোগ্যতা সম্পণ্ন হওয়া সত্তেও কেবল লিঙ্গ ভিন্নতার কারণে দুজনের গতিপথ ভিন্ন হবে এমন হাস্যকর কথা গোপাল ভাঁড়ও বোধকরি বলতে লজ্জা পাবে!... যাহোক, এই বেশ আছি : স্বনির্ভর, আত্মপ্রত্যয়ী, নির্ঝঞ্ঝাট ; স্বামী নামক কোন তৈলাক্ত বাঁশবাহী প্রাণীর অনাহূত আস্ফোলন নেই...! রহিম: সত্যিই সবকিছু বদলে গেছে ... চেনা আকাশ, চেনা অনুভূতির সরোবর... সবকিছু। প্রীতিলতার বিদ্রোহের গল্প পড়েছি , কিন্তু সে নিশ্চয়ই আপনার চেয়ে তেজস্বিনী ছিল না।

হে মহিয়সী, আপনি একজন সামান্যা রূপবান নন, আপনি সেই মহাবিদ্রোহিনী প্রীতিলতা ; “তুই-তুমি-আপনি ” সকল সম্বোধনের ঊর্ধ্বে । (সলজ্জ) আমার মত “রাঙ্গা মুলো” কে ভেবে একদা আপনি পুলকিত হতেন ...এই রোমান্থনই আমার আজীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে... রূপবান : (সহাস্য বদন) হু..., একেতো রেজাল্ট খারাপ,তার ওপর চাকরির অনিশ্চিত ভবিষ্যত... তাই আমায় এভাবে নির্লজ্জ তৈলমর্দন হচ্ছে? এতক্ষণে তোমার অভিপ্রায় খোলাসা হল..... শোন তোমার যা যোগ্যতা তাতে আমার PA এর চেয়ে ভাল পদ তোমায় দিতে পারব না... পরে অন্যত্র ভাল সুযোগ পেলে নাহয় চলে যেও... কি, রাজী? রহিম: (উচ্ছ্বসিত) আপনার কাছাকাছি থাকার এমন অবকাশ কি সচরাচর মেলে? আপনি চাইলে অদ্যকালই আমার কার্যদিবস হতে পারে... তবে অধীনের সামান্য একখানি আর্জি আছে : আমার প্রতিভা বিকাশের পথটা যেন রুদ্ধ না হয়; অবশ্য আপনি এখনও আমার সঙ্গীত-সাহিত্যের সমঝদার হবেন বলেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি! ধন্য.. ধন্য.. ধন্য... রমণী.. আপনার ..শাদী না হোক... প্রণয় নাইবা হইল... জীবন এমনি// (ও আমার সঙ্গীত... আপনি) রূপবান : stop, on duty no song...no reciting.... মনে রেখো তোমার চাকরির স্থায়িত্ব তোমার দক্ষতার উপর নির্ভরশীল ; অফিসের অন্যান্যদের মত তুমিও বেতনভূক কর্মচারী মাত্র ; সুতরাং অনিয়ম করলে ব্যক্তিগত পরিচয় তোমায় রক্ষা করতে পারবে না। যাও, ডায়েরী দেখে আমার এ সপ্তাহের কার্যতালিকা তৈরি কর! রহিম: জ্বি ম্যাডাম, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই... রূপবান : (রহিমকে পিছু ডেকে) দাঁড়াও, দাঁড়াও... আজ প্রথমদিন ; চল দুপুরের খাবারটা বাইরে কোথাও একসাথে সেরে নিই। রহিম: জ্বি ম্যাডাম , এই দুপুরবেলা খাওয়ার সৌজন্যে হলেও পুরনো দিনকে ফিরিয়ে আনা যাবে! অহেতুক কালবিলম্ব না করে তবে চলুন যাই... ( মুহুর্মুহু যন্ত্রের মূর্ছনায় রহিম-রূপবানের মঞ্চত্যাগ এবং দৃশ্যপটে বিবেকের সর্বশেষ আবির্ভাব) ভোলামন... রহিম-রূপবান যা.. ভুলে যা ..শূন্য যাত্রাপালা.. অন্তরালে বসে বয়স... শেখায় বর্ণমালা// # যাত্রার বিবরণ লিখতে গিয়ে অজান্তেই নিজেকে রহিমের মাঝে হারিয়ে ফেলেছিলাম যা আমাকে মুখোমুখি করেছে কিছু অমীমাংসিত প্রশ্নের : রহিমরা আসলে কী চায়_ প্রাজ্ঞ স্ত্রী’র পবিত্রতম সাহচর্য নাকি অসমবয়সী তরুণীর যৌবনের প্রাচুর্য? অসমবয়সী পত্নী বড়জোর প্রমোদসঙ্গিনী হতে পারে, “ পরিপূর্ণ স্ত্রী” হওয়া তার সাধ্যাতীত ; কিন্তু এই নির্মল সত্যটিই রহিমদের কাছে যুগান্তরের গোলকধাধা হয়ে রয়েছে । আমরা সেই পচনশীল মানসিকতার প্রতিনিধি বয়স যাদের ইন্দ্রিয়সুখের বর্ণমালা শেখায় , বিয়েকে একটি শরীরচর্চাবিষয়ক কর্মশালায় পরিণত করে! আমাদের এই শেখার কি কোন শেষ নেই?স্বাপ্নিক রূপবানদের স্বপ্নের সঙ্গে স্বপ্ন মিলিয়ে “স্বপ্নপুরী” তৈরির স্বপ্ন কি তবে দুঃস্বপ্নে রূপ নেবে? আধুনিকতার উর্ধ্বমুখী বল আমাদের যতই উপরের দিকে ঠেলুক, মানসিকতার “নবসংজ্ঞায়ন” ব্যতীত প্রাপ্তি পরমশূন্য!!


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।