http://joyodrath.blogspot.com/
১. সত্তরের দশকের শেষের দিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটার রোহান কানহাইকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন ক্যারিবিয় কবি ডেভিড ডেভিডিন। কবিতার মর্ম ছিল এমন যে, রোহান কানহাই ব্যাট হাতে কালো মানুষদের পক্ষে লড়াই করে। যখন বর্ণবাদী নির্যাতন নেমে আসে, মেয়েরা ধর্ষিত হয়, সামান্য ছলছুতোয় কালা আদমিকে জেলে ভরা হয়, প্রতিবাদ করার কারণে পলাতকের জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয় তারা, সেই ফেরারী জীবনে কানে রেডিও ঠেকিয়ে রোহান কানহাই-এর ব্যাটিং এর ধারাবিবরণী শোনে তারা। শোনে কোন্ দূরদেশে ব্যাট হাতে একা একা লড়াই করে চলেছেন রোহান কানহাই। দুঃখ, অপমান আর বঞ্চনাকে মেরে মেরে করে দিচ্ছেন বাউন্ডারির পার।
এই সেদিনের হিন্দী ছবি লগন। ইংরেজ শাসনামলের এক ভারতীয় গ্রামের ছবি। ট্যাক্স বা লগন রেয়াতের জন্য খরাপীড়িত গ্রামবাসী ইংরেজ শাসকের কাছে যায়। অদ্ভূত প্রস্তাব পায় তারা, ক্রিকেট খেলায় ইংরেজকে হারাতে পারলেই লগন মাফ করা হবে, এবং হেরে গেলে দ্বিগুণ লগন দিতে হবে। নিরুপায় গ্রামবাসীর সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না।
ছবিতে দেখা যায়, জীবনে যারা কোনোদিন ক্রিকেট খেলে নি, এমন কি যারা প্রতিবন্ধী এবং প্রায়-অকর্মণ্য, এমন মানুষদের একটি দল আমির খানের নেতৃত্বে হারিয়ে দেয় ইংরেজ ক্রিকেটারদের।
লগন এর প্রায় সমসাময়িক শ্রীলংকার জনপ্রিয় মঞ্চনাটক হোরা হোরা আম্পায়ার হোরা। এই নাটকে একটি জাতীয় মহাকাব্য বা ন্যাশনাল এপিক রচনার প্রয়াস আছে, এবং সেটা ক্রিকেটীয় ফর্মে। ব্রেখটীয় সার্কাসের ফর্ম অনুসরণ করা হয়েছে সেখানে, মেশানো হয়েছে ক্রিকেট খুবই চমৎকারভাবে। যেমন নাটকের ধারাবর্ণনাকারী বা ন্যারেটর হলেন ক্রিকেটের কমেন্টেটর বা ধারাভাষ্যকার।
মঞ্চে চরিত্রদের বিন্যাসের ধরনটি ক্রিকেটের ফিল্ডিং সাজানোর মত। এভাবে শ্রীলংকান থিয়েটার আর শ্রীলংকান ক্রিকেট মিলিয়ে সিংহলী লোক ঐতিহ্যের একটা প্রজেকশন করা হয়েছে এই মঞ্চনাটকে।
উপরের তিনটা দৃষ্টান্ত থেকে এটা পরিষ্কার যে, যেসব দেশ আগে বৃটিশ উপনিবেশ ছিল, উপনিবেশ-উত্তরকালে তাদের জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনার বিনির্মাণে ক্রিকেট একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে আশ্চর্যের। ক্রিকেট নিশ্চিতভাবেই ইংরেজদের আবিষ্কৃত খেলা এবং তারাই এই খেলাকে তাদের উপনিবেশগুলোতে রপ্তানি করেছে।
খোদ ইংল্যান্ডে ক্রিকেট শুধু একটা খেলা নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু। একটা লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট। ক্রিকেট হল এমন একটি অভিব্যক্তি যেখানে অ্যাংলোস্যাক্সন মহত্ত্ব এবং খৃস্টীয় নৈতিকতা প্রকাশিত হয়। ভিক্টোরীয় যুগের শেষদিকে ইংরেজদের কাছে চারটা “সি” ছিল একসারিতে বিবেচ্য: সিভিলাইজেশন, ক্রিকেট, ক্যাসিকস এবং ক্রিশ্চিয়ানিটি। ফলে, খুব সঙ্গত কারণেই ক্রিকেটকে তারা উপনিবেশগুলোতে নিয়ে এসেছে।
ন্যাটিভদের “চরিত্রগঠন” করার জন্য। ক্রিকেট হচ্ছে শৃঙ্খলা মেনে চলার খেলা। মাঠের মাঝখানে সাংবিধানিক সরকারের মত সাদাপোশাক পরা আম্পায়ার দাঁড়িয়ে আছে, তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আবার সাদা পোশাক হচ্ছে খৃস্টীয় শুদ্ধতার প্রতীক। ফলে, ক্রিকেটের শৃঙ্খলা দিয়েই ন্যাটিভদের সামাজিকীকরণ করা সম্ভব।
এই হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া তথা যাবতীয় বৃটিশ উপনিবেশে ক্রিকেট রপ্তানির রাজনীতি। এখন প্রশ্ন জাগে, যে ক্রিকেট ইংরেজ প্রভুদের আবিষ্কার এবং প্রভুদের শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, সেটা এই উপনিবেশ-উত্তরকালে এত জনপ্রিয় কেন? অন্য অনেক উপনিবেশিক উত্তরাধিকার আমরা যেমন পরিত্যাগ করেছি, সেভাবে ক্রিকেটকে কেন পরিত্যাগ করি নি? বরং ক্রিকেটই হয়ে উঠেছে আমাদের জাতীয়তাবাদী অভিব্যক্তি প্রকাশের জায়গা। কেন?
এই জায়গাটি থেকে যদি আমরা আমাদের উপনিবেশ-উত্তর জাতীয়তাবাদের কথা ভাবি, তাহলে দেখবো যে, উপনিবেশের সব কৃষ্টিকে স্রেফ অন্ধভাবে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দেশী জাতীয়তাবাদ চালু হয়েছে এমনটা নয়। অর্জুন আপ্পাদুরাই যেমন বলেন, বি-উপনিবেশিকরন মানে উপনিবেশিক আচার অভ্যাসকে নির্বিচারে ছুঁড়ে ফেলা নয়, বরং এর সাথে একটা সংলাপ, একটা যোগাযোগ প্রক্রিয়া। আরো মনে রাখতে হবে, জাতীয়তাবাদের প্রতিভূ যারা ছিলেন তারা তাদের চিন্তায় চেতনায় শিক্ষায় বৃটিশ উত্তরাধিকার বহন করতেন এবং সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া খুব সহজ ছিল না।
মূলত এরকম কিছু ঘুলঘুলি দিয়েই ক্রিকেটের আলো আমাদের চোখে লেগেছে। ক্রমে আমরা ভুলেই গেছি আমরা ক্রিকেটের উদ্ভাবক নই। আমরা মনেও করতে চাই না যে, ক্রিকেট জন্মসূত্রে আমাদের নয়। আশীষ নন্দী খুব চমৎকারভাবে বলেন যে, ক্রিকেট হল একটা ভারতীয় খেলা যা অ্যাক্সিডেন্টালি বৃটিশরা আবিষ্কার করেছে!
কালেক্রমে দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রিকেট আর ইংরেজসুলভ ভদ্রলোকদের খেলা হয়ে থাকে নি। ক্রিকেট ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামে-গ্রামান্তরে, রাস্তায়।
ক্রিকেটাররা, কি মুখে কি ব্যাটবল হাতে, আর সাদা পোশাকপরা ভদ্রলোক হয়ে থাকেন নি এখানে। বুলিং, স্লেজিং, জুয়াড়িদের অনুপ্রবেশ, পিঞ্চহিটিং, টোয়েন্টি-টোয়েন্টি সব মিলিয়ে ক্রিকেটের যে চেহারা দাঁড়িয়েছে তা ভিক্টোরীয় আমলের ইংরেজের অচেনা। এটা উপমহাদেশীয় ক্রিকেটের চেহারা। ক্রিকেটকে এভাবে নিজেদের মত করে ইমপ্রোভাইজ করার আর্তি ফুটে উঠেছে লগন সিনেমাটিতেও। এই সিনেমা জাতিগত অহমকে তৃপ্ত করার জন্যই বানানো হয়েছে।
লগন ছবিতে ক্রিকেটের উছিলায় যেমন উপনিবেশবিরোধী জাতিগত সংগ্রামকে রোমান্টিক মাহাত্ম্যে তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসের মধ্যে ফিকশনের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ক্রিকেটকে আত্মীকরনের একটা রোমান্টিক ভিত্তি দেয়ারও চেষ্টা করা হয়েছে। একইভাবে, সিংহলী এপিককে ক্রিকেটীয় ফর্মে মঞ্চে নিয়ে আসা, কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের “সাদা” ক্রিকেটার রোহান কানহাইকে কালা আদমিদের প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা সবই একটি সত্যকে নির্দেশ করে। আর সেটি হল উপনিবেশ আমলে যে ক্রিকেট খেলাকে ন্যাটিভকে সোশ্যালাইজ করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে, উপনিবেশ-উত্তর যুগে সেই ক্রিকেটই স্বাধীন উপনিবেশগুলোর জাতীয়তাবোধের অভিব্যক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২. এরকম প্রণোদনা থেকেই সম্প্রতি আইসিএল-এ খেলতে যাওয়া বাংলাদেশী ক্রিকেটারদেরকে আমরা প্রায় জাতীয় বেইমানের পর্যায়ে ভাবতে শুরু করেছিলাম। ভাড়া করা দল নিয়ে আরব আমিরাত যখন আইসিসি খেলল, তখনও তাকে উপহাস করাই কর্তব্য মনে হয়েছে।
এর একটাই অর্থ: ক্রিকেটকে আমরা নিছক খেলা হিসেবে দেখি না, একটা জাতিগত অভিব্যক্তি হিসেবে দেখি। ফলে আইসিএল-এ অলক কাপালির একমাত্র সেঞ্চুরির রেকর্ড কিংবা ঢাকা ওয়ারিয়র্স-এর লাগাতার বিজয় পত্রিকার পাতাতেও জড়সড় হয়ে থাকে।
তবে এই ধারণা পাল্টে যেতে আরম্ভ করেছে। টোয়েন্টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট কিংবা আইসিএল-এ আমাদের ক্রিকেটারদের যোগ দেয়া থেকে ক্রিকেটের কর্পোরেট চেহারাটিও বোঝা যায়। জাতীয়তাবোধের মন্ত্রে একে আর আটকানো যাচ্ছে না।
বিশ্বায়নের চক্করে, পুঁজির বাঁধভাঙা অনুপ্রবেশে ক্রিকেট আর নিছক জাতীয়তাবোধের অভিব্যক্তি হয়ে থাকবে না এটা মেনে নিতে হবে। এর সদর্থক দিকগুলোও কিন্তু নেহাত ফেলনা নয়। দেখুন না আইসিএল-এ অলক কাপালির ব্যাট কিরকম ধারাবাহিক হয়ে উঠেছে! বোঝা যাচ্ছে, বিশ্বকাপে পা বাঁচিয়ে কাব ফুটবলে গা উজাড় করে খেলার ফুটবলীয় ঐতিহ্য আমরা ক্রিকেটেও দেখবো অচিরেই। কাজেই জাতীয়তাবোধের অহম থেকে “বিদ্রোহী” ক্রিকেটারদের স্থানীয় পর্যায়ে নিষিদ্ধ করা খুব কাজের কথা নয় এখানে। ঢাকা ওয়রিয়র্স-এর বিজয়ে আমাদের জাতীয়তাবাদ তৃপ্ত না হলেও তুষ্ট তো হয়।
সরাসরি রণহুংকার না দেয়াই ভাল, কারণ বহুজাতিক কর্পোরেটের সাথে লড়াই-এ আমাদের মত গরিব জাতিসত্তার আত্মাভিমান নিশ্চিতভাবেই পরাজিত পক্ষ। তারচে চলুন ঢাকা ওয়রিয়র্স-এর বিজয় উদযাপন করি, আর উত্তর-ঔপনিবেশিক পর্যায় থেকে কর্পোরেট পর্যায়ে যেতে থাকা ক্রিকেটের রাজনীতি বুঝবার চেষ্টা করি।
[প্রথম আলো, ২ নভেম্বর ২০০৮]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।