আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

'দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরীস'



১৯৬৭ সালে বন্দী অবস্থায় কাপরুষ এক বলিভিয়ান আর্মি সেনার গুলিতে অমরত্ব পাওয়ার প্রায় ১৫ বছর আগে ১৯৫২ সালের জানুয়ারীতে ২৩ বৎসর বয়সী মেডিকেল শেষবর্ষের ছাত্র আর্নেস্তো চে গুয়েভারা তার বায়োকেমিস্ট বন্ধু আলবের্তো গ্রানাদো'কে নিয়ে বের হয়েছিলেন 'দিগবিজয়ী' এক দেশভ্রমণে। উদ্দেশ্য- পড়াশুনা শেষ করে 'সিরিয়াস' জীবনযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বার আগে একটু মজা করে নেওয়া। আনন্দ, উদ্দাম আর বাধাহীন উচ্ছলতায় তারূণ্যের সুন্দর কিছু সময় এডভেঞ্চারে এডভেঞ্চারে কাটিয়ে দেওয়া। প্রায় নয় মাস ধরে পুরনো থুত্থুরে এক মোটরসাইকেলে চেপে আর্জেন্টিনা থেকে পানামা পর্যন্ত দীর্ঘ ৮০০০ মাইল পথ ভ্রমণ করে মোটামোটি সমগ্র লাতিন আমেরিকা চষে বেড়াবার পর তার এই এডভেঞ্চারের শখ পূর্ণ হয়েছিলো কিনা জানিনা, তবে তার জীবনের মোড় যে ঘুরে গিয়েছিলো তাই লিখে রেখেছিলেন চিরসংগী ছোট্ট এক ডায়েরীতে। ভদ্র, বিনয়ী এবং নির্বিবাদী মধ্যবিত্ত এক সাধারণ তরুণ মনে কিভাবে জন্ম হয়েছিলো দুনিয়া কাঁপানো এক বিপ্লবী হওয়ার সাধনা তারই প্রামান্য দলিল এই 'মোটরসাইকেল ডায়েরী'।

১৯৯৭ সালে ডায়েরীটি প্রথমবারের মতো বই আকারে প্রকাশিত হবার পরপরই রাতারাতি, আশ্চর্যজঙ্ক হলেও সত্য প্রধানত আমেরিকাতে, বেস্ট সেলারের মর্যাদা পেয়ে যায়। এই সাফল্য আর চাহিদার সূত্র ধরে ২০০৪ সালে আর্জেন্টাইন ভাষায় নির্মিত হয় 'দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরীস' ছবিটি। ২০০৬-এর শীতের কোন এক সন্ধ্যায় কণকণে ঠান্ডা আর স্নো'র হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে ঢুকে পড়েছিলাম ভার্জিন মিডিয়া'র উষ্ণ শো রুমে। ছবিটার ডিভিডি ওখান থেকেই কেনা। ভেবেছিলাম বইটা আগে পড়ে নিয়ে কিছুদিন পর ছবিটা দেখতে বসব।

কিন্তু হাজার ঝামেলায় বইটা আর কেনা হয়ে উঠেনি, ছবিটাও তাই পড়ে রয়েছিলো শেলফের কোনায়। অবশেষে গত ৯ই অক্টোবর চে'র মৃতুবার্ষিকীর দিনে সময় করে দেখে ফেললাম মুভিটি। সামহোয়ারইনে লিখতে লিখতে দেরী হয়ে গেলো। তাও অক্টোবর শেষ হবার আগেই যে পোস্ট করতে পারছি এটাই সান্ত্বনা। মহান বিপ্লবীর আদর্শের প্রতি সংহতি জানিয়ে এ আমার ক্ষুদ্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

'দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরীস' সেমি-ড্রামা/সেমি-বায়োপিক একটি মুভী। যেকোনো একটি ঘরানার স্বরূপ এখানে খুঁজতে গেলে হোঁচট খেতেই হবে। তাই কেউ যদি চে'র বায়োগ্রাফি'র প্রতিফলন দেখার আশায় ছবিটা দেখতে বসেন তিনি যেমন হতাশ হতে পারেন, তেমনি যিনি গল্প-সর্বস্ব দারূন একটি ছবি দেখার ধারনা করবেন তিনিও যে আশাহত হবেন না এ গ্যারান্টি দিতে পারছিনা। আর চিরাচরিত ভ্রমণকাহিনীর সাথে এ ছবির সাজুয্য না খোঁজাই ভালো। আরো অনেক ছোটখাটো হোঁচটের ব্যাপার আছে, সে বিষয়ে পরে আসছি।

আর্জেন্টিনা থেকে বের হয়ে চে আর তার বন্ধু গ্রানাদো ঘুরে বেড়িয়েছেন চিলি, পেরু, ভেনেজুয়েলা, কলম্বিয়া, ইকুয়াডোর আর পানামা'র পথে প্রান্তরে। রাত্রি হলে ঘুমিয়েছেন খোলা আকাশের নীচে, কখনোবা খড়ের গাদায় কোনো গৃহস্থের গো-শালায় চাকর-বাকরদের সাথে। চলার পথে তাদের দেখা হয়েছে সাধারণ মানুষদের সাথে, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর ত্যাগের সোপান বেয়ে গড়ে উঠেছে লাতিন আমেরিকার আজকের ঐতিহ্য। কৃষক, মজুর, শ্রমিক, বিপ্লবী- সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বয়ে নিয়ে চলেছে তাদের আবহমান লাতিন পরিচয়, তাদের গর্বিত সংস্কৃতি। কিন্ত চে'র অন্তরভেদী দৃষ্টিতে এ সব কিছু ছাপিয়ে ধরা দিয়েছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমে থাকা নিদারুন বৈষম্যের এক প্রতিচ্ছবি।

তিনি আবিষ্কার করেন যে- সবার পাতে অন্য জুগিয়ে দেয়া কৃষকরা এদেশে আজো রয়ে গেছে গরীব, হাড়ভাংগা খাটুনি খাটা শ্রমিকদল এখনও বুলডোজার আর ছড়ির আঘাতে হচ্ছে নিষ্পেষিত, আর প্রতিবাদী বিপ্লবীরা হয়ে আছে ঘরছাড়া ফেরারী। সহজেই ঝেড়ে ফেলা যায় এরকম ছোট্ট অনেক ইস্যু গড়ে দিচ্ছে ধনী-গরীব, পাওয়া-নাপাওয়া'দের ব্যবধান। বৈষম্যের এক কণ্টকচারা মহীরুহ হয়ে ঢেকে দিচ্ছে সুললিত লাতিনভুমি। সমাজে শাষক আর শোষিতের এই ব্যবধান ঘুচিয়ে দেবার স্বপ্ন নিয়ে চে'র মনে তাই আস্তে আস্তে বাসা বাঁধে প্রতিবাদী মনোবল, একই জাতিগোষ্টীর সমন্বয়ে একটি 'ইউনাইটেড লাতিন আমেরিকা' গড়ে তোলার এক বিপ্লবী চেতনার। পুরো ছবি জ়ুড়ে বিভিন্ন ঘটনা, সংলাপ আর অভিব্যক্তির মাধ্যমে উঠে এসেছে এই কথাগুলো।

তার সাথে আবহ সংলাপের মতো করে চে'র ডায়েরী থেকে বিভিন্ন উদ্ধৃতি তো ছিলই। সব মিলিয়ে বেশ ভালো। শুরুতে, ছবিটি সিরিয়াস হয়ে উঠার আগে বড়লোক গার্লফ্রেন্ডের বাড়িতে কাটানো চে'র কিছুদিনের ঘটনাগুলো বেশ ভিন্ন একরকম স্বাদ এনে দিয়েছিল। আবিষ্কার করা যায় রোমান্সে ভরপুর এক চে'গুয়েভারাকে। এর আগে আত্মীয়স্বজনদের সান্নিধ্যে চে’র অন্তরংগ আলাপচারিতার সময় কিংবা বাবা-মার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার মুহুর্তে নিতান্ত ঘরোয়া চে কে বেশ ভালই লাগে।

আরও কিছু অসধারন দৃশ্যের মধ্যে মনে দাগ কেটে যাওয়ার মতো হলো- মোটরসাইকেল নষ্ট হয়ে যাবার পর পায়ে হেটে পথ চলতে চলতে ঊষর মরুভুমির প্রান্তে দেখা হয়ে যাওয়া প্রায় পরাজিত এক বিপ্লবী দম্পতির সাথে চে'র কথোপকথন। শোষনবিহীন, সাম্যবাদী এক সমাজ গড়ার আপোষহীন সংকল্প নিয়ে বিপ্লবীদের ঘর ছেড়ে পথে নামা আর তার নিজের এই পথ চলা- এ দুয়ের দুস্তর ব্যবধানটুকু তখন স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে তার চোখে। মাথা নীচু করে প্রায় অস্পষ্ট স্বরে চে’কে তাই আমরা বলতে শুনি, '' (অথচ) আমরা পথ চলি শুধু পথ চলার জন্যেই''। পেরুর 'মাচুপিচু'তে গিয়ে প্রাচীন ইনকা নগরীর ভগ্নাবশেষ দেখে সে যুগের প্রাগ্রসর লাতিন সভ্যতা নিয়ে গর্বে নেচে উঠেছে চে'র চোখের তারা। আদিবাসী কিশোর আর তার সহচরদের সাথে সময় কাটিয়ে উপলব্ধি করেছেন যে কি কঠোর পরিশ্রম আর সীমাহীন ভালোবাসায় এরা আজো ধরে রেখেছে তাদের আবহমান কৃষ্টি- তাদের ভাষা, পোষাক আর বিলুপ্তপ্রায় লোকাচারে।

কিন্তু সব দেখে চে’র মনে প্রশ্ন জেগেছে '' ইনকা'রা তাহলে হারিয়ে গেলো কেনো?' জবাব নিজেই দিয়েছেন, 'কারণ স্প্যানিশদের কাছে ছিলো অস্ত্র'। এছাড়া আমাজন নদীতীরবর্তী অঞ্চলে কুষ্ঠরোগীদের আশ্রমে শিক্ষানবীশ ডাক্তার হিসেবে কাটানো সময়টুকুর বর্ণণা বা দৃশ্যায়ন ছিলো বলতে গেলে এ ছবির প্রাণ। অস্পৃষ্য এই কুষ্ঠরোগীদের সেবা করে, তাদের সাথে ফুটবল খেলার মধ্য দিয়ে আর মিশনারী নার্সদের চাপিয়ে দেয়া বৈষম্যমূলক নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে চে বুঝিয়ে দেন যে তিনি এসেছেন নতুন এক একাত্মতাবোধ, সাম্য, সংহতি আর বিপ্লবের স্বপ্ন নিয়ে। বন্ধু আলবার্তো গ্রানাদো এক সংলাপেই যার শেষ টেনেছেন এভাবে- ''আমি জানতাম আর্নেস্তো পারবেই। '' লাতিন আমেরিকার মিউজিক আমার সবসময়ই ভালো লাগত।

এ ছবিতেও তাই, বিশেষ করে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকটা। আর ধুলোমাখা পথের চারপাশে পাহাড়-নদী-সরোবর দিয়ে সাজানো লাতিন আমেরিকার চিরাচরিত গ্রাম্য প্রকৃতি ছিলো অসাধারণ। লাতিন পটভূমিকায় বিত্তশালী, অভিজাত পরিবেশের পাশাপাশি গরীব সহায়হীন সাধারণের ছবিটাও সুন্দর হয়ে ফুটে উঠেছে। তবে ছবির যে দিকটা আমার একটু খারাপ লেগেছে সেটা হলো চে'র ডায়েরীর কথাগুলার মর্মটুকু অভিনয়ে আরেকটু গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলতে না পারা। এজন্য আমি ছবিতে চে'র চরিত্র রূপদানকারী অভিনেতার সীমাবদ্ধতার কথা বলব।

অবশ্য আমার ধারনা চে’র ডায়েরীর মৌলিকতা ধরে রাখার স্বার্থে পরিচালক তার চিত্রনাট্যে ডায়েরীতে বর্ণিত ঘটনা বা সংলাপের বাইরে অন্য কোনো ঘটনা বা সংলাপ সংযোজন করতে চাননি বলে ডায়েরীর সাধারণ কথামালায় গভীর অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা একজন অভিনেতার পক্ষে কঠিন হওয়াই স্বাভাবিক। বিপ্লবী চে'কে যারা জানেন তারা নিশ্চই স্বীকার করবেন যে মহান এই নেতার সবচে বড় প্রতিবাদী অভিব্যক্তি ফুটে থাকত তার গভীর স্বচ্ছ দুটি চোখে (এখনো চে’র যেকোনো ছবিতে তার ওই চোখদুটোর দিকে তাকালে এক সীমাহীন বিশালতা অনুভব করা যায় )। আর সেই গভীর চোখদুটো তৈরী করা কোনো পরিচালক বা অভিনেতার পক্ষে কি সম্ভব? তবে চে'র বন্ধু আলবার্তো গ্রানাদো চরিত্রটা অনেক ক্ষেত্রে চে'কেও ছাড়িয়ে গেছে। স্বল্পভাষী, বিনয়ী চে'র বিপরীতে উচ্ছল, অত্যুৎসাহী গ্রানাদো'কে অনেক বেশী পরিচিত মনে হয়েছে। প্রধানত তাকে ঘীরে যেই দৃশ্যগুলা ছিলো সেগুলা ছিলো ভিন্ন স্বাদের।

ছবির শেষে ডিভিডি- তে এখন ৮৭ বছর বয়সী আসল আলবার্তো গ্রানাদো'র একটি আগ্রহোদ্দীপক সাক্ষাৎকার রয়েছে। চে'র সাথে ওই মোটরসাইকেল জার্নির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি দারুন সব মর্মস্পর্শী কথা বলেছেন। চে শুভানুধ্যায়ীদের কথাগুলা ভালো লাগবেই । এ ছবির পরবর্তীকালে ভিন্ন এক সাক্ষাৎকারে তার বন্ধু চে সম্বন্ধে আলবার্তো গ্রানাদো খুবই সুন্দর একটি কথা বলেছেন। ছবিটির আলোচনায় অপ্রাসংগিক মনে হলেও তার বক্তব্যতা তুলে ধরবার লোভ সামলাতে পারলাম না- ''Because he was a man who fought and died for what he thought was fair, so for young people, he is a man who needs to be followed. And as time goes by and countries are governed by increasingly corrupt people ... Che's persona gets bigger and greater, and he becomes a man to imitate. He is not a God who needs to be praised or anything like that, just a man whose example we can follow, in always giving our best in everything we do.''


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।