আত্মবিশ্বাসহীনতায় প্রকট হচ্ছে আত্মার দেউলিয়াত্ব, তবুও বিশ্বাস আগের মতই নিশ্চল..
[বিভ্রম-১, বভ্রিম-২ না পড়লে এটাও পড়ার দরকার নেই, আগের পর্ব দুটি আমার ব্লগে সংরক্ষিত আছে]
(#)
“আচ্ছা প্রভাত, অধির চেয়ে আমি কি তোমার বেশি ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছি?”-স্বর্ণালীর অর্থবহুল প্রশ্নে প্রশান্তির হাসি দেয় নীলাদ্রী, স্বর্ণালীকে অবাক করে দিয়ে ওর চুল স্পর্শ করে-“হাত ধরা নয়, আমার দৃষ্টিতে ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ প্রেয়সীর চুলের মাঝে! ভালোবাসারা স্বর্গীয় সুগন্ধি হয়ে চুলের মাঝে ছড়িয়ে থাকে, আর তার সুরভি ভেসে বেড়ায় হৃদয় থেকে হৃদয়ে-‘হে প্রার্থিত ঈশ্বরী, আমি প্রশ্রয়ের স্বর্গ চাইনা/ শুধু তোমার চুলের গহীনে- একটুখানি ছায়া দিও’। গত দেড়বছরে মনের ভুলেও কখনো তোমার হাত ধরেছি কিনা স্মরণ করতে চেষ্টা কর; তোমার জিজ্ঞাসার জবাব পেয়ে যাবে। ”-উচ্ছ্বাসের প্রাবল্যে স্বর্ণালীর বাকরোধ হতে চায়- “তোমার সঙ্গে প্রতিটি কথাই আমার প্রথম কথা, আমি যেন শিশু হয়ে উঠি তোমাকে দেখলে আদরে আদরে বর্তে যেতে চাই । ধর্ম যতই প্রাচীর গড়–ক, স্বর্ণালী-নীলাদ্রী একইসঙ্গে প্রভাতের সূর্যোদয় দেখবেই; পরীক্ষাটা শেষ হতে দাও। ”- চিরচেনা নীলাদ্রীর কণ্ঠস্বর বদলে গেল-“ আমার জীবনের নির্মম সত্যটি তোমায় বলিনি নীলিমা: সংসারের সুধাপান আমার হারাম।
‘ আলোকিত মানুষ’ হওয়ার বন্ধুর পথ আমায় একাই চলতে দাও ; তুমি পাশে থাকলে আমি হয়ত শুধু তোমাতেই নিমগ্ন থাকব, আলো রয়ে যাবে নাগালের বাইরে!”
স্বর্ণালী যেন তড়িতাহিত হল-“তুমি কি জীবিত মানুষ ; দেখি হাত দাওতো, ঢ়ঁষংব পাই কিনা! আমি তোমার চলার প্রতিবন্ধক না হয়ে পাথেয়ও তো হতে পারি। একা মানুষ বোকা, কার স্বার্থে নিজের সঙ্গে প্রতারণা করবে? আমায় ভালোই যদি বাস তবে কাছে পেতে কেন এত অনীহা!”
নীলাদ্রী আরও গম্ভীর-“তুমি আমায় চিনতে ভুল করেছো নীলিমা : আমার কাছে স্ত্রী মানে নির্ভরতা, আর প্রেয়সী পরম নির্ভারতা। আমি সেই মানুষ যে কখনো কারও উপর নির্ভার হয়ে নির্ভর করতে পারিনা। তোমার সঙ্গে এই যে বসে আছি একবারও কি সোজাচোখে তোমার দিকে তাকিয়েছি? আমার ভালোবাসা ঈশ্বরের ইবাদতের মত,যাকে না দেখেও ধারণ করে আছি বিশ্বাসে; তুমিও তো তাই নীলিমা! তোমায় নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজব, ঘাসফড়িঙের উড়াউড়ি দেখব, কিন্তু তোমার ঘরের জানালায় জোছনা দেখার জন্য স্বামী হবনা; কারণ জানালা থেকেই বদ্ধতার সূচনা!বিশ্বাস কর,৩০ বছর পূর্ণ হওয়ার পর পৃথিবীর প্রতিটি দিন আমার জন্য এক একটি মৃত্যুর প্রহর ; এই ক’দিনের মাঝেই আমি এমন কিছু করতে চাই যাতে ৩০লক্ষ বছর পরেও মানুষ বলে-‘ নীলাদ্রী শেখর ’ বলে কেউ পৃথিবীকে উদ্ভাসিত করেছিল! মরণ কালেও শুধু এটুকুই বলতে চাই "I was born to beautify the entire world"-সংসারের মোহে আমায় লক্ষ্যচ্যুত হতে বলনা। ” স্বর্ণালী বিস্ফোরিত হয়ে পড়ে-“তোমার কথা-বার্তা ‘day-dreamer’’ এর মত ,চিন্তা-চেতনায় তুমি এখনওimmature; আসলে তুমি দায়িত্ব নিতে ভয় পাওÑ তাই কচুরিপানার মত ভাসমান থেকে তুমি জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াতে চাও।
”Ñ নীলাদ্রী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে-“নীলিমা, আমি নিজের কাছেই এক অচেনা মানুষ, তুমি আর কী বলতে পার?আমি জানি আমার ভাবনার ভুল কোথায়, কিন্তু মাঝে মাঝে এই ভুলের মাঝেও অনির্বচনীয় আনন্দ লাভ করি। তুমি কি বিয়ে করাতেই পূর্ণতা ভাবছো? আমিতো তোমার বিয়ের পরই তোমাকে প্রকৃত ভালোবাসতে শুরু করব: যখন তোমার হাতে অন্যের হাত, তোমার বুকে কারও সন্ধানী নিঃশ্বাস Ñ সেই নিবিড়তম মুহূর্তে যদি তোমাকে পাবার অসম্ভব তামান্নায় ব্যাকুল হই Ñ তবেইতো ভালোবাসা!” স্বর্ণালীর কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে-“ প্রভাত, পৃথিবী তোমায় মনে রাখবে কিনা জানিনা, তবে এই সন্ধ্যা অনন্তকাল তোমার স্মৃতিচারণ করবে সেই প্রণয়ী হিসেবে যে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে প্রেয়সীর অন্যত্র বিয়ে দিয়েছিল । আমার শেষ অনুরোধটা অন্তত রাখ: মাত্র একবার তোমার নীলিমাকে পূর্ণদৃষ্টিতে দেখ!”- নীলাদ্রী দৃষ্টি নামিয়ে নেয়-“নীলিমা,তোমায় আজীবন দেখব বলে মাত্র একমুহূর্তের দৃষ্টিতে তাকে সীমাবদ্ধ করতে চাইনা। তারচেয়ে বরং- আজ এই সন্ধ্যায় নিশ্চুপ বসে থাকি পাশাপাশি/ আলো-আঁধারির অবিরাম মাখামাখি ; উড়ে যাক বিরহের যত আছে পাখি/ স্পর্শমেঘের অশ্র“নীরে সিক্ত হয়ে- তুমি-আমি নির্বাকতার চিত্র আঁকি / মিলনের নদী নাইবা হলাম; বিচ্ছেদে হব কাছাকাছি//
স্বর্ণালীর বিয়ে; পাত্র ওরই চাচাতো ভাই- গ্রামীণফোনের দামী চাকুরে, স্বর্ণালীরও বৃটিশ কাউন্সিলে যোগদান করেছে স¤প্রতি ; পরিবারের মধ্যেই যেহেতু যোগ্য পাত্র-পাত্রী আছে, বিয়ের ক্ষেত্রে ঘটক পাখী ভাইয়ের দ্বারস্থ হতে হবে কেন? স্বর্ণালীদের দাদা বাড়িতেই বিয়ের সার্বিক আয়োজন চলছে। “পুঁজিবাদী শ্রেণী”,“বেতাল পঞ্চবিংশতি” ছাড়াও ক্লাসের অনেকেই এসেছে, আসেনি শুধু নীলাদ্রী।
অবশ্য স্বর্ণালীই ওকে না আসতে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছিল; ঐশ্বরিক স্বামীর উপস্থিতিতে বাস্তবিক স্বামীকে গ্রহণ নাকি ব্যভিচার! উপল এসেছে সুচিত্রাকে সঙ্গে নিয়ে; সুচি যথারীতি ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কেই’ তার ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে, আর উপল বিসিএস ক্যাডারে ফরেন মিনিস্ট্রিতে চাকরি করছে। সুচির এখন ২য় বর্ষ চলছে বলে বিয়েটা ২বছর পেছানো হয়েছে উভয়ের সম্মতিতে। তবে সংসারের ছোটখাট মহড়া তারা প্রতিনিয়তই দিয়ে যাচ্ছে; স্বর্ণালীর বিয়েতেও তাদের আদর্শ দম্পত্তি বলেই ভ্রম হচ্ছে! নীলাদ্রী তার বাউণ্ডুলে জীবনের রাশ এখনো টানতে পারেনি: একটি বেসরকারী স্যাটেলাইট চ্যানেলের সংবাদ পাঠকের কাজ করতে গিয়ে অলক্ষ্যেই এক সহকর্মীর ‘হৃদয়ের প্রধান শিরোনাম’ এ পরিণত হয়েছে;এসমস্ত অনিয়মতান্ত্রিক সম্পর্কের বাগাড়ম্বরে ইদানীং নীলাদ্রী প্রায় ত্যক্তবিরক্তই । সেই পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালীন এক সহপাঠিনী চিঠি লেখা শুরু করেছিল, এরপর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-কর্মক্ষেত্রে যেন তারাই প্রত্যাবর্তন করছে ঈষৎ পরিবর্তিত রূপে! যাহোক, নিজের বিয়েতেও স্বর্ণালী বন্ধুদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আসর জমিয়ে তুলল। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পণ্ন হলে অতিথিরা বিদায় নিলেও উপলরা সবাই রয়ে গেল, এরপর বাড়ির চৌহদ্দিতে নবদম্পতির সঙ্গে ওদের নানা মুখরোচক আলোচনা চলতে থাকল।
এমন সময় উপলের ফোনে নীলাদ্রীর কল এলে সে কিছুটা দূরে সরে এল-
“হ্যালো উপল,নীলিমাকে দে তো, ভীষণ জরুরী !”
নীলাদ্রীর জন্য উপলের প্রাণে হাহাকার তুললেও সে তা প্রকাশ করল না-“পাগলামি করিসনা নীলাদ্রী, এ মুহূর্তে এরকম অদ্ভুত আবদার করতে নেই। ”
নীলাদ্রী নাছোড়বান্দা-“ জীবনে আমার জন্যতো বহুবিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিস; আজকে নাহয় আর একবার হ। ”
- উপল কেীশলে স্বর্ণালীকে সবার থেকে আলাদা করে ফোন হাতে দিতেই ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে সেই তেপান্তরের ধ্বনি শুনতে পেল
“ নীলিমা, আমি এখন তোমাদের বাড়ির ঠিক সামনে রয়েছি ; প্রভাতকুমারের জীবনের শেষ কাব্য তোমাকে শোনাই-
স্বর্ণালী আলো, তুমি কি বহুদূরে কোন দিগন্ত দেখছো?
আজ কি তোমার সফেদ শরীরে জেকে বসেছে নির্বেদ?
তুমি কি তবে ঐক্যের নীড়ে জাগিয়ে তোল বিভেদ?
তুমি কি তোমার লাবণ্য রঙে নীলিমার চোখে আল্পনা আঁকছো?
কিংবা লীন হয়ে আছো নীলিমার নীলে , চেনা নীলিমার পরিণয় ফুলে?
তোমাকে চেয়েছি বলেই নীলিমা চলে গেছে দূরে সেই কবে
তবু তোমাতেই রয়ে গেছে সে বিমুগ্ধতার অনুভবে-
নীরের নীড়ে নীলিমার পাশে তোমার সঙ্গে
দেখা হবে, দেখা হবে, দেখা হবে। ।
তোমাকে বধূর সাজে দেখার প্রলোভন জয় করা আর হলনা বলে তোমার অনুরোধ উপেক্ষা করলাম; তুমি যেভাবে আছ সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাক; আজ তোমাকে পূর্ণদৃষ্টিতে দেখব।
একটু অপেক্ষা কর, আমি আসছি! (সমাপ্ত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।