আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শুভ জন্মদিন : ড. সফিউদ্দিন আহমদ / অর্ক হাসান



এই গণমানুষের বাংলাদেশে অনেক মহান মানুষের জন্ম হয়েছে। এই মাটি লালন করেছে অনেক কৃতিসন্তান। ড. সফিউদ্দিন আহমদ তাঁদেরই একজন। এক কৃতি বুদ্ধিজীবি। তাঁর স্নেহে আমি ধন্য হয়েছি বারবার।

তাঁর জন্মদিনে অসীম শ্রদ্ধা । ============================================= শুভ জন্মদিন : ড. সফিউদ্দিন আহমদ অর্ক হাসান ----------------------------------------------------------------------------- ১৯ অক্টোবর, গবেষক সাহিত্যিক প্রফেসর ড. সফিউদ্দিন আহমদের শুভ জন্মদিন। প্রফেসর ড. সফিউদ্দিন আহমদ শিকড় সন্ধানী মৌলিক গবেষক ও সৃজনশীল সাহিত্যিক এবং একজন সম্মোহক অধ্যাপক হিসেবে নন্দিত। সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ঔজ্জ্বল্যে ভাস্বর, প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডে এবং নান্দনিক ঐশ্বর্যে ভরপুর ও কৃতী সন্তানের উজ্জ্বল ভূমি রায়পুরায় তার জন্ম (১৯৪৩)। ড. সফিউদ্দিন আহমদের পিতা মোঃ আবদুচ্ছামাদ মোল্লা একজন কংগ্রেস নেতা, সমাজ সেবক ও শিক্ষক ছিলেন।

কংগ্রেস নেতা সুন্দর আলী গান্ধী, মানিক ভট্টাচার্য ও অতীন রায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তিনি। মাতা দিলবর"ন নেসা আত্মগোপনকারী বামপন্থী নেতা কর্মীদের মাতৃস্নেহে আশ্রয় দিতেন। তিনি একজন সমাজ সচেতন মহিলা ছিলেন। আত্মগোপনকারী নেতাকর্মীরা তাকে ‘মা’ সম্বোধন করতেন। ড. সফিউদ্দিন আহমদের রায়পুরা সদরে ছায়াবীথি নামক বাড়িটি দেশবরেণ্য নেতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের তীর্থ কেন্দ্র ছিল এবং বর্তমানেও।

ড. সফিউদ্দিন আহমদ বাংলা ও লজিকে লেটার মার্কসহ ইন্টার মিডিয়েট পাস করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা অনার্স ও এমএর কৃতী ছাত্র ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যে, বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্র সাহিত্যের ওপর উচ্চতর পর্যায়ে পড়াশুনা ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, মৌলিক গবেষক এবং তথ্যসমৃদ্ধ ও সৃজনশীল বক্তব্যের জন্য তিনি দেশে ও বিদেশে একজন বিদ্বত ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে তিনি কলকাতা, যাদবপুর, বিশ্বভারতী, বর্ধমান, কল্যাণী, গৌয়াহাটি, আসাম ও ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিরোজিও, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, উনিশ শতকের রেনেসাঁ ও বাংলাদেশের সাহিত্য বিষয়ে বক্তব্য রেখে নতুন তথ্য সন্নিবেশনও পাণ্ডিত্যের প্রাখর্যে তিনি পণ্ডিতজনের প্রশংসা অর্জন করেন। আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে তিনি নিখিল ভারত সাহিত্য সম্মেলন, বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন, আসাম রাজ্যের শিলচরে মাতৃভাষা সম্মেলন, সুরমা বরাক উপত্যকা বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের সহস্রাব্দ সম্মেলনে ভাষণ দেন।

ড. সফিউদ্দিন আহমদের গবেষণা ও সাহিত্যকর্ম বহু বিচিত্র মাত্রিক। লেখায় তিনি তুলনামূলক মাত্রিকতা যোজনা করে উভয় বাংলার সাহিত্যে একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করেছেন। তার গদ্য ছন্দিত, ধ্বনি তরঙ্গময়, অনুপ্রাসের অভিযোজনে রসমাধুর্য এবং আকর্ষণীয় ও সুখপাঠ্য। বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত দশটি গবেষণা গ্রন্থসহ তার মোট গবেষণা গ্রন্থ ত্রিশটি এবং এ সমস্ত গ্রন্থ দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রেফারেন্স বই হিসেবে পাঠ্য তালিকাভুক্ত। এ সব ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা পত্রিকা ও বিশ্বভারতী পত্রিকায় পঞ্চাশটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

এ সমস্ত প্রবন্ধে আরো দশটি বই হতে পারে। এখনো তিনি নিরলস গতিতে লিখছেন বাংলাদেশ ও কলকাতার বিভিন্ন সাময়িকীতে। বাংলাদেশ উনিশ শতকের রেনেসাঁর বিশ্লেষণ ও গবেষণায় তিনি একজন ম্যাচিয়্যুর অথরিটি এবং এ বিষয়ে তিনি একক ও অনন্য। অতিসাম্প্রতিক প্রকাশিত তার ‘ভাষার সংগ্রাম-শিক্ষার সংগ্রাম’, ‘ইয়ংবেঙ্গল মুভমেন্ট ও ডিরোজিও’ খুবই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কবীর চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বইগুলোর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে ‘প্রথম আলো’ ও অন্যান্য পত্রিকায় আলোচনা করেছেন।

তার গবেষণা গ্রন্থ ‘ডিরোজিও’ এবং ‘ইয়ংবেঙ্গল মুভমেন্ট ও ডিরোজিও’ আমাদের গবেষণা সাহিত্যে মৌলিক ও অনন্য অবদান। তিনি একজন দক্ষ ও কৃতী অনুবাদক। প্লেটোর 'ঞঐঊ খঅঝঞ উঅণঝ ঙঋ ঝঙঈজঅঞঊঝ’ নামক মহৎ গ্রন্থটি তিনি ‘সক্রেটিসের শেষ দিনগুলো’ নামে অনুবাদ করেছেন এবং বইটি প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমী। এ ছাড়াও তিনি পাবলো নের"দা, ডিরোজিও এবং টি.এস. এলিয়টের কবিতা অনুবাদ করে পন্ডিতজনের প্রশংসা অর্জন করেছেন। বাইপাস সার্জারির পর হাসপাতালে ও বাসায় শয্যায় শুয়ে,বসে তিনি ডিরোজিওর কবিতা অনুবাদ করে বিস্ময়কর সাহিত্য প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন।

তার প্রকাশিত গল্প ‘মানুষ গড়ার কারিগর’, ‘ডাক পিয়ন; ‘মের"দণ্ড; ‘উত্তরণ সিঁড়ি’, ‘ঈদ মানে আনন্দ’ ‘ওরা আমাদের কেনো খেতে দেয় না’ প্রভৃতি খুবই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ‘ডাক পিয়ন’ ও ‘মের"দণ্ড’ ইভনেভ কৃদ্রভ কর্তৃক র"শ ভাষায় এবং ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ নয়েল গার্নিয়ে কর্তৃক ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়। অনুবাদ সাহিত্যেও তার প্রতিভার ঔজ্জ্বল্য প্রকাশ পেয়েছে। ছাত্র জীবনেই তিনি তুখোর বক্তা ছিলেন। আবৃতি, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা, নির্ধারিত বক্তৃতা ও পর্যায়ক্রমে বলায় এবং নান্দনিক উপস্থাপনায় তিনি চৌকস ছিলেন।

হল ভরা শ্রোতাদের তিনি মাতিয়ে তুলতেন। ঢাকসুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় দু’দুবার তিনি চ্যাম্পিয়ন হয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। প্রথম জীবনে তিনি নেত্রকোনা কলেজ, পরে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে পরীক্ষা দিয়ে বি.এম. কলেজ, আনন্দ মোহন কলেজ ও সিলেট এম.সি. কলেজ এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্তব্যরত অবস্থায় ২০০৫ সালে অবসর গ্রহণ করেছেন। স্বাতন্ত্র্য ব্যক্তিত্ব, মুক্তবুদ্ধি, প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা ও আত্মপ্রত্যয়ে তিনি ঋদ্ধ। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিনয়ী, অমায়িক, সুসংস্কৃত মন-মানসিকতার অধিকারী ও লোকপ্রিয়।

ঘরোয়া আলোচনা ও সাহিত্যের আড্ডায় তিনি সদাহাস্য, উচ্চকণ্ঠ ও প্রাণ খোলা। তথ্যসমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয় বক্তব্যের জন্য তিনি শ্রোতাদের কাছে যেমন প্রিয় ব্যক্তিত্ব, ছাত্রছাত্রীদের কাছেও তেমনি একজন সম্মোহক শিক্ষক হিসেবে শ্রদ্ধান্বিত। ড. সফিউদ্দিন আহমদ পরিশ্রমী ও সচেতন লেখক। তার লেখায় শব্দ ও বাক্য এবং এর বিন্যাস প্রয়োগ পরিমিত, সুচিন্তিত ও নান্দনিক ঐশ্বর্যে উজ্জ্বল। ক্লাসিক ও আধুনিক উভয় সাহিত্যে তার স্বছন্দ পরিক্রম।

বিশ্ব সাহিত্যের ওপর তার লেখাগুলো আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তার বিভিন্ন লেখায় এবং অনুষ্ঠানে তিনি প্রায়ই বলেন, খ্যাতি বা পরিচিতির দুয়ারে আমি কোনোদিনই হাত পাতিনি। জনগণের প্রদত্ত ট্যাক্সে আমি পড়াশুনা করেছি। আমার প্রতি রক্ত কণিকায় এ ঋণের স্পন্দন আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় তাদের অবদানের কথা এবং এ ঋণ আমাকে ঘনিষ্ঠ একাত্মতায় সম্পৃক্ত করে দেয় শ্রমে-ঘামে সিক্ত, উষ্ণ নিঃশ্বাসে উপ্ত নিরন্ন ক্লিষ্ট মানুষের সঙ্গে। এ ঋণের স্বীকৃতি ও দায়বদ্ধতাকে ব্রত হিসেবেই আমি গ্রহণ করেছি।

আমি বিশ্বাস করি মানুষ কখনো পরাজিত হয় না, মানুষ কখনো পেছনে যায় না। প্রগতির পদাতিক হয়ে আমার যাত্রা সামনের দিকে। আমার জীবনে পরাজয় বলতে কিছু নেই। প্রথম দিনের সূর্যকে প্রণাম করে আমি সামনে চলেছি। ড. সফিউদ্দিন আহমদ গতানুগতিক সাহিত্যের ধারা ও বিলাসী নন্দনতত্ত্বেও বিশ্বাসী নন, তাই তিনি বলেন, ‘আমি জানি আমার লেখা বাণীর বেদীতে পুজোর ফুল হিসেবে স্থান পাবে না, তবে সে বেদীতে ফাটল ধরাতে ও অনিয়ম সৃষ্টি করতে পারবে।

সাহিত্যে ও শিল্পে কলাকৈবল্যবাদ ও নন্দনলোকের নান্দীপাঠ তত্ত্বেও আমি বিশ্বাসী নই। আমি মনে করি মেহনতই সমস্ত শিল্পকর্মের উৎস। সাহিত্য ও সংস্কৃতি সমাজ ও সভ্যতার সুস্থ বিকাশের জন্য এবং সমাজ পরিবর্তনের শানিত হাতিয়ার। এজন্যই আমার ছাত্রছাত্রীদের আমি বলি তোমাদের এক হাতে থাকবে বই অপর হাতে থাকবে হাতুড়ি। বই থেকে জ্ঞান অর্জন করবে আর হাতুড়ি দিয়ে পুরাতন সমাজ ভাঙবে ও নতুন সমাজ গড়বে এবং তোমাদের দৃষ্টি থাকবে আকাশে আর পা থাকবে দেশের মাটিতে।

--------------------------------------------------------------------------------- ভোরের কাগজ সাময়িকী । ১৭ অক্টোবর ২০০৮

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।