"...কোন মানুষকেই তার কাজের জন্য বেশি প্রশংসা বা বেশি নিন্দা করা উচিত নয়। কারণ আমরা সকলেই অবস্থা, পরিবেশ, শিক্ষা, অভ্যাস, বংশগত ধারা ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল..." -Lincoln
ঘটনা বছর তিনেক আগের। আমার এমনিই ঠান্ডার ধাত। কিভাবে যেন কঠিন ঠান্ডা লেগে গেল। আমি পাত্তা দিলাম না।
হঠাৎ লক্ষ্য করলাম কন্ঠস্বর একটু খাদে নেমে গেছে। ভাবলাম সিক লিভ কাটানোর অজুহাত পাওয়া গেল একটা। ‘আমাদের ডাক্তারের’ সাথে কথা বললাম। তিনি ওষুধ দিলেন আর লিখলেন, ভোকাল রেস্ট ফর সেভেন ডেজ। আমাকে কথাবার্তা সম্পূর্ন বন্ধ রাখার পরামর্শ দিলেন।
তখনও আমি তার কথার গুরুত্ব বুঝিনি। আমি কথা কমিয়ে দিলাম। বন্ধ করলাম না। ক্রমে আমার কন্ঠস্বর নিস্তেজ হয়ে এল। আবার যাও ডাক্তারের কাছে।
গেলাম। আমার সাথে ডাক্তার সাহেবও নির্বাক হয়ে গেলেন। ‘আপনি আমার কথার গুরুত্ব বোঝেন নাই’। প্যাড টেনে নিয়ে লিখলেন, ‘ফর ফারদার ম্যানেজমেন্ট, দ্য পেশেন্ট ইজ রেফার্ড টু এ্যান ইএনটি স্পেশালিস্ট’। আক্ষেপ করলেন, আমার আর কিছু করার নাই।
আমি নির্ভারই ছিলাম। ভুলটা এখানেই করলাম। সমস্যার ভয়াবহতা বুঝতে দেরি করে ফেললাম। গেলাম একজন বিশেষজ্ঞের কাছে। যার কাছে গেলাম তিনি শেখ হাসিনার কানের চিকিৎসা করা ডাক্তার টিমের একজন।
সুতরাং আমি নির্ভার। সেরা চিকিৎসাটাই পাওয়া যাবে। তিনি ভেতরটা দেখলেন। ‘আপনার ভোকাল কর্ডসতো ফুলে আঙ্গুরের মত হয়ে গেছে। ’ এবং আকিঁবুকি করে দেখালেন ‘অবস্থা এই..’।
ব্যাস কথা বন্ধ ১৫ দিন। ওষুধ চলবে দুই সপ্তাহ। এতো তারিখ আবার দেখা করবেন। বারবার সতর্ক করলেন, কথাবলা সম্পূর্ন বন্ধ।
সিএনজি (থ্রি হুইলার) নিয়ে বাসায় ফিরলাম।
কথাবার্তা বললাম না। ইশারা ইঙ্গিতে সারলাম। ড্রাইভার কি মনে করল কে জানে। ভাড়া নেওয়ার সময় সেও আমার সাথে ইশারায় কথা বলা শুরু করল। প্রথমে দেখাল সাত আঙ্গুল।
টাকা ফেরত দিতে দিতে দেখাল তিন আঙ্গুল। আমি রাগ সামলাতে পারলাম না। দিলাম এক চিৎকার। থাপ্পর দিয়া কানপট্টি গরম কইরা ফালামু, তোর গলায় সমস্যা কি? হারামজাদা। তুই কথা বলস না ক্যান?
বাসায়ও ক্রমাগত রাগারাগি করতে লাগলাম।
বোবাদের রাগ বেশি, একথার সত্যতা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করলাম। সিএনজি চালকের উপর আমি ক্ষেপে ছিলাম খামোখাই । কারন বাসার সবাই আমার সাথে ইশারা ইঙ্গিত শুরু করল। আমি পানি চাই ইশারায়। তারা ইশারায় হাজারটা প্রশ্ন করে।
গরম না ঠান্ডা, খাব নাকি মেন্থলের ভাপ নেবো, গার্গল নাকি গোসল? এতো কিছুর ইশারাতো আমি জানি না। আমি রাগে কাঁপতে থাকি। শেষে নিজেই পানির দায়িত্ব নিলাম। ঢুকে গেলাম রান্না ঘরে। আমার রাগারাগি এতোটাই বেড়ে গেল যে কেউ আর ভয়ে ধারে কাছে ঘেঁষে না।
বিরক্ত হয়ে অফিসে গেলাম। একদিনেই বুঝলাম। অফিস করা সম্ভব নয়। ২২/২৩ ডিগ্রি টেম্পারেচার। ভয়ানক কাশি শুরু হয়ে গেল।
আর কৌতুহলি সহকর্মিদের প্রশ্নবাণতো আছেই। জানে আমার কথা বলা নিষেধ। তবু নাছোড় বান্দা। কেন হল, কিভাবে হল? সব প্রশ্নের উত্তর এখনই চাই। তার উপর কোন পাপে আমি এই প্রায়শ্চিত্ত করছি সে নিয়েও তাদের বিস্তর গবেষণা চলল আড়ালে আবডালে।
আমি সাধ্যমত ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চললাম। খাও গরম পানি। গোসল গরম পানি। গার্গল গরম পানি। মেন্থল ভাপ নেব, গরম পানি।
ওষুধ খাব, গরম পানি। নিজেই করতে লাগলাম। এরপর গরমে শরীর ঘামতে থাকে। ফ্যান ছাড়লে শুরু হয় দম ফাটানো কাশি। শুরু হলে আর থামে না।
মনে হয় গলাটা ছিঁড়ে যাবে। ভয়াবহ অবস্থা। মোবাইল বন্ধ করে দিলাম। কথাবার্তা বলারতো প্রশ্নই আসে না। ডাক্তারের সাথে দেখা করার সময় ঘনিয়ে এলো।
আমি নিরিবিলিতে নিজের কন্ঠ নিজে পরীক্ষা করলাম। এবং ভয়ে ঘামতে লাগলাম। আমার বাগযন্ত্র কোন শব্দ তৈরী করতে পারছে না। একজন বোবার সাথে আমার কোন তফাত নেই।
তের দিন পার করে চৌদ্দ দিনের দিন ডাক্তারের সাথে দেখা করলাম।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ডাক্তার বললেন, সে কী, অবস্থাতো আরো খারাপ। আপনি কথা বন্ধ রাখেন নাই? বলপয়েন্ট হাতে নিয়ে বসে রইলেন কতক্ষণ। ওষুধ চেঞ্জ করে দিলেন। বাড়িয়েও দিলেন। একই ওষুধ বারবার ভাল কাজ করে না।
এবার কথা বন্ধ ৩০ দিন। ওষুধ চলবে। অতঃপর শেষ কথাটি বললেন। 'এরপর দেওয়ার মত আর কোন ওষুধ আমাদের হাতে কিন্তু নেই'। তিনি আমার প্রস্থানের অপেক্ষা করতে লাগলেন।
ডাক্তারকে চিন্তিত মনে হল। তিনি আমার দিকে আর তাকালেন না। বেল টিপে দিলেন। সহকারী নতুন রোগী ঢুকিয়ে দিল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম।
তবু নিজের আশা নিজেই জাগিয়ে রাখলাম। ডাক্তার হয়তো কথা বন্ধ করতে মানসিক চাপ সৃষ্টি করছেন।
আবার নির্ধারিত তারিখে ডাক্তারের চেম্বারে গেলাম। তালা ঝুলছে। কি ব্যাপার? জানা গেল তিনি দেশের বাইরে গেছেন।
মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরার যোগার। যাহোক ওষুধ চালিয়ে গেলাম। পরের সপ্তায় তাকে পাওয়া গেল। কেমন আছেন? আমি এদিক ওদিক মাথা ঝাঁকালাম। ভাল নেই।
ডাক্তার জিহ্বার গোড়াটা চেপে ধরে বললেন, বলেন ইইইই। আমি বললাম আআআআ। উহুম.. বলেন ইইইই, আমি বললাম আআআআ। হতাশ ডাক্তার মহাশয় আবার লিখলেন কথা বন্ধ এক মাস, ওষুধ চলবে।
যাহোক, সে যাত্রা আমি বেঁচে গেলাম।
ঝাড়া ছয়মাস পর স্বাভাবিক কথা বলতে পারলাম। ডাক্তার বলে দিলেন, চোরায় বাড়ি চিনে গেছে। সাবধান। সুযোগ পাইলেই কিন্তু হানা দিবে। পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পর ডাক্তারে উপদেশ আমি দ্রুতই ভুলে গেলাম।
পরিনতি যা হবার তাই হল। তিন বছরের মাথায় চোরা আবার আমার বাড়িতে হানা দিয়েছে। মরার সেই ল্যারিনজাইটিস। এখন আমি সেই ডাক্তারেরই চিকিৎসাধীন আছি। ভেবেছিলাম অল্পতে পার পাব।
কিন্তু তা আর হচ্ছে না। গত ১০ অক্টোবার থেকে পনর দিনের ভোকাল রেস্ট চলছে এখন। কবে নাগাদ প্রান খুলে কথা বলব, প্রান খুলে হাসবো!! কে জানে।
(আশার কথা- এবারের অবস্থা আগের বারের মত ততটা খারাপ নয়। আমিও সতর্ক!!)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।