জন্মোপার থেকে পৃথিবী হয়ে অনন্তে >>> ©www.fazleelahi.com
'সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি' বলতে আমরা কি বুঝি? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর হতে পারে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সদ্ভাব বজায় রেখে বসবাস করা। এখন এই সদ্ভাবের বিস্তৃতি জীবনের সকল দিক জুড়ে। এর মধ্যে একাধারে যেমন থাকছে পারস্পরিক মুখদেখাদেখি তেমনি থাকছে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণও। পৃথিবীর দেশে দেশে শোনা যায় এই সম্প্রীতির কথা, কোথাও এ সম্প্রীতি পূর্ণমাত্রায় বহাল আবার কোথাও আংশিক, কোথাও লংঘিত হয়ে অত্যাচার নিপীড়ন হচ্ছে। সম্প্রীতির সুরক্ষা এবং মধ্যম পন্থা থেকে নিয়ে লংঘনের নানা চিত্র আমরা আমাদের নিজ দেশ এবং পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী দেশগুলোতে অহরহ দেখতে পাই।
এর জন্য খুব বেশী দূরে তাকাতে হয় না।
তিন দিকে ঘেরা এমন একটি দেশ বাংলাদেশকে ঘিরে আছে যে দেশে প্রতি বছর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বহু মানুষ প্রাণ হারায়। বহু নৃশংস ঘটনার সাক্ষী বিগত কয়েক দশকের ভারত। যেখানে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় শুধুমাত্র তার ধর্ম বিশ্বাসের কারণে। পৃথিবীর পথে আগমনকারী গর্ভের সন্তানও যেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হাত থেকে বাঁচতে পারেনি।
তেমন একটি দেশকে ঘিরে আছে যে বাংলাদেশ; পৃথিবীর বুকে সমকালীন বহু বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুরক্ষায় যার সুনাম, সে আমার স্বদেশ বাংলাদেশ। স্বদেশী আর বিদেশী শত্রুদের জন্য যা এক মহা যন্ত্রণা! কেন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধে না? কেন বাংলাদেশ এই প্রশ্নে প্রশান্ত! এ এক আশ্চর্য বিষয় তাদের নিকট।
তারা তাদের এহেন যন্ত্রণার অবসান কল্পে সময় সময় কলম ধরে, উপশমের প্রচেষ্টায় প্রচুর "ধারণা" এবং টানাহেঁচড়া উদাহরণ পেশ করে প্রমাণ করার ব্যর্থ প্রয়াস চালায় যে, "বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের বিষ ঢুকেছে অনেক গভীরে...."। যদিও বিজ্ঞজনের মন্তব্য যে, তারা এর মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের বিষ ঢোকাতে সচেষ্ট এসবের মাধ্যমে। এদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়, অশান্ত হয় অত্যাচারের প্রতিরোধে, নিপীড়নের প্রতিবাদে আর কখনো বা প্রচুর অর্থের বিনিময়ে বিক্রিত হয়ে।
তারা সাধারণত ব্যঙ্গরচনায় সিদ্ধ হস্ত হয়। অবশ্য একটাও অনেকগুলো দুর্বল কৌশলের মধ্যে একটা দুর্বলতম কৌশল তাদের। যেমনটি কেউ আপনার গোপন তথ্য জেনে খোঁচা দিল আর আপনি নতুন কিছু শুনলেন মনে করে ব্যঙ্গোক্তি করে সেটাকে হালকা করার প্রয়াস চালালেন; কিন্তু না, সত্য এত সহজেই লুকিয়ে রাখা যায় না। অথবা শতটি মিথ্যা দিয়েও সত্যকে ঢেকে রাখা যায় না।
প্রবাসী এক বিহারের (ভারতীয়) বাসিন্দা সেদিন খাবারে টেবিলে তোলা ভারতীয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রসঙ্গের আলোচনাকে শেষ পর্যন্ত শ্রোতাদের দীর্ঘশ্বাস আর তার না খেয়ে উঠে যাওয়ায় পরিণত করলো! তার ভাষ্যানুযায়ী, ভারতে তার এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ভয়ে তারা জোরালো ভাষায় কথা বলতে পারে না, নিজেদের অধিকারে কথা তুলে ধরতে পারে না।
তাদেরকে ঘৃণ্য-অস্পৃশ্য মনে করা হয়, তাদের অনুষ্ঠানাদিতে সবকিছু সীমাবদ্ধকরণ করা হয়, শিক্ষায় তাদের সন্তানদেরকে বিবিধ সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়, কখনো কখনো লুটতরাজ চলে মুসলিম বাড়ীগুলোতে। চাকুরীর প্রত্যাশায় বহু মুসলিম যুবক-যুবতী হিন্দু নাম ধারন করতে বাধ্য হয়। কোন হিন্দু মেয়ে মুসলিম যুবককে বিয়ে করলে তার প্রতিশোধ নেয়া হয় কঠোরভাবে আর কোন মুসলিম মেয়ে হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করলে তাকে হিন্দু বানিয়ে দিব্যি প্রটেকশন দিয়ে যাওয়া হয়। সর্বোপরি মুসলিম সম্প্রদায়ের উঠতি যুবাদের মধ্য থেকে যদি কারুর ব্যাপারে তাদের এই ধারনা হয় যে, এর দ্বারা তাদের যে যুলুম অত্যাচার চলছে তাতে ব্যাঘাত ঘটবে, তবে তাকে পুলিশেরা বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে তুলে নিয়ে যাবে এবং নির্জন কোন নদীর কিনারে নিয়ে গুলি করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়; যার ব্যাপারে সংবাদ মাধ্যমসহ সকল মাধ্যমই অন্ধ থাকে। এভাবেই বর্ণিত হলো কথায় কথায় তোলা একজন ভারতীয় পঞ্চাশোর্ধ নাগরিকের নিজেদের অবস্থার বর্ণনা!
অথচ সে তুলনায় দৃষ্টি দিন বাংলাদেশের দিকে, পৃথিবীর যে কেউ, যে কোন অবস্থান থেকে, আমাদের কোন আপত্তি নেই।
বের করুন ভারতের মত দু'একটি উদাহরণ? এদেশে একই গ্রামে হিন্দু-মুসলিম এক সাথে বসত করে আসছে, একে অপরের বিপদে আপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। হাটে-বাজারে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, লেন-দেনে, সেবা-চিকিৎসায়, কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে ব্যবধান আমার সোনার বাংলাদেশে? ভারতে যখন বাবরী মসজিদ ভাঙ্গা হয়, উত্তেজিত যুবকেরা বাংলাদেশেও জোশের বশে তেমন কিছু করতে হয়ত চেয়েছিল, কিন্তু এদেশের ঐতিহ্য রক্ষায় তৎপর মুসলিম নেতৃবৃন্দ, অভিভাবকগণ তা হতে দেয়নি। ভারতের মত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের এত জঘন্য ইতিহাসে পৃথিবীর ইতিহাসে নগন্য মিলবে। এই তো সেদিনের গুজরাটের দাঙ্গা পৃথিবীকে কাঁদিয়েছিল, আজো কাঁদাচ্ছে। সেসবের তুলনা তো বহু দূরের, বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নে, চাকুরীর ক্ষেত্রে কিংবা রাষ্ট্রীয় দপ্তরে ও রাজনৈতিক ময়দানে কোন হিন্দু এমন দাবী উত্থাপন করেছে বলে আজো কেউ শোনেনি যে, তাকে তার নাম পাল্টে মুসলিম নাম ধারন করতে হয়েছে শিক্ষার জন্য, চাকুরীর জন্য, শান্তিতে বসবাসের জন্য।
এমন উদাহরণ কেবলমাত্র বাংলাদেশই দেখিয়েছে এতদ অঞ্চলে। ভারত সে তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ার জন্য কলংক!
কথায় কথায় "সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ব্যবসায়ী"রা একাত্তরে ঝাঁপ দেন। অবশ্য সে যুদ্ধাবস্থা ছাড়া তাদের কাছে আর কোন মজবুত তথ্যও নেই যে এ ব্যবসা চালিয়ে যাবে। একাত্তর প্রসঙ্গে বলতে গেলে বলতে হয় যে, যুদ্ধ যুদ্ধই। সেখানে কেবলি ধ্বংস আর মৃত্যু।
কতটুকু লংঘিত হয়ে যুদ্ধ আইন, সে বিচার বিবেচনা হয় পরিস্থিতি শান্ত হবারও বহু বহু পরে। তাই যুদ্ধাবস্থায় যাকিছু অঘটন ঘটেছে তা যুদ্ধের সাথেই সম্পৃক্ত। সে যুদ্ধে যদি প্রাধান্য পায় ধর্মীয় বিশ্বাস কিংবা কোনভাবে জড়িয়ে পড়ে ধর্মীয় চেতনাবোধ, তবে তো অবশ্যই ধর্মভিত্তিক ধ্বংসের শিকার হয়ে থাকে মানুষ। তাই যুদ্ধের উদাহরণ টেনে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী প্রমাণ করার দুর্বল প্রচেষ্টা সন্দেহাতীতভাবে ষড়যন্ত্র। যদি যুদ্ধাবস্থার মত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী পরিবেশ তৎপরবর্তী সময়েও বহাল থাকতো, তবে বাংলাদেশে হিন্দুদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যেত না ২০০৮ সালে এসে।
কিন্তু অবস্থা কি তা আর বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না; সবকিছুই দৃষ্টির সীমানায় প্রকাশ্য।
দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় যা প্রতিটি সমাজেই বর্তমান। তা হলো, সমাজের দুষ্ট লোকগুলো। তারা যেমনি করে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে ছিল, যুদ্ধের সময়ও ছিল, তেমনি করে যুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে নিয়ে আজো আছে এবং থাকবে। তারা আগেও যেমন লুটতরাজ, সন্ত্রাস করতো, যুদ্ধের সময়কে আরো সুবর্ণ সুযোগ মনে করে বেশী মাত্রায় করেছে এবং যুদ্ধের পর থেকে আজো করে যাচ্ছে।
আর এ শ্রেণীর অত্যাচার নিপীড়নের কাছে মুসলিম হিন্দু খৃষ্টানের কোন বাছবিচার নেই। এরা অপরাধী, অপরাধের ক্ষেত্র পেলেই তাতে লিপ্ত হচ্ছে। সুতরাং এদের কৃতকর্ম থেকে হিন্দু নাগরিকেরা যে পরিমাণ অত্যাচারিত হয়েছে, সে উদাহরণ দিয়ে যদি প্রমাণ করার অপচেষ্টা করা হয় যে, বাংলাদেশ সাম্প্রাদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী, তবে তা হবে রীতিমত জুচ্চোরী।
এবার আসা যাক- কেন বাংলাদেশ এই সুনামের অধিকারী? তার আগে দেখতে হবে কাদের থেকে এই নিরাপত্তা পাচ্ছে কিংবা কারা এই সুনামের ভাগীদার হচ্ছে? এ জবাবে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৮৫% এর নামটিই আসতে পারে কেবলমাত্র, অর্থাৎ মুসলিম। তাহলে এবার দেখা যাক কি আছে এই সম্প্রদায়ের কিংবা এই ধর্মের মধ্যে যার কারণে মুসলমানগণ অন্য ধর্মের মানুষদের প্রতি এতটাই সহনশীল যে, ইতিহাস সৃষ্টি করে ফেললো? ইতিহাস সাক্ষী, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এক বিচারের জন্য মুসলিম আসলো, বিবাদটি ছিল ইয়াহূদীর সাথে, বিচারে আল্লাহর রাসূল রায় দিলেন ইয়াহূদীর পক্ষে, সে রায় সে মুসলিমের পছন্দ হলো না বলে সে গেল উমার রাদিয়াল্লাহু 'আনহুর কাছে।
উমার আল্লাহর রাসূলের ফয়সালার পর তার নিকট ফয়সালার জন্য যাওয়াতে সে মুসলিমের শিরোচ্ছেদ করে ফেললো এই বলে যে, যে ব্যক্তি স্বয়ং আল্লাহর নবীর ফয়সালার পর উমারের কাছে আসে বিকল্প ফয়সালার জন্য, তার ফয়সালা করতে হয় এভাবেই!
ইসলামের খলীফা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর কোন জিনিস চুরির অপরাধে ইয়াহূদীর বিপক্ষে খলীফা সাক্ষী আনলেন নিজের চাকরকে, হতভম্ব পৃথিবী সেদিন দেখেছিল, খলীফার শাসন ব্যবস্থার অধীন চাকুরীরত কাযী স্বয়ং খলীফার আনীত সাক্ষীকে প্রত্যাখ্যান করেছেন নিজের একান্ত গোলাম বলে, যার সাক্ষীকে বাদীর জন্য যথার্থ বিবেচনা করেননি এবং রায় ইয়াহূদীর পক্ষে গেল। খলীফা বিচার মেনে নিলেন। এভাবেই মুসলমানদের জীবন ব্যবস্থা ও সোনালী ইতিহাস থেকে এই সম্প্রদায় শিক্ষা নিয়েছে কিভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুরক্ষা করতে হয়।
সর্বেশেষে এই আশার কথা ব্যক্ত করে শেষ করছি যে, এত সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র, মিথ্যা প্রচারণা, অর্থ ব্যয় ইত্যাদির পরও এদেশের মানুষের ধৈর্য্য ও সহ্যের কাছে হার মেনেছে দালাল গোষ্ঠী। আল্লাহ্ বাংলাদেশকে রক্ষা করুন সাম্প্রাদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা থেকে এবং এই সুনাম আরো বিস্তৃত হয়ে চলে যাক কেয়ামত পর্যন্ত -এই প্রার্থনা হোক প্রতিজন বাংলাদেশী মুসলিমের।
গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার একটা ভয়ংকর ছবি দিয়েছিলাম, আসেনি বা আসতে দেয়া হয়নি। ভালোই হয়েছে, মনটা খুব খারাপ হলো ছবিটি দেখে। এখন তুলে দিয়েছি, শুধু লিংকটা রাখলাম, যারা দেখতে চান দেখে আসতে পারেন।
ছবি কৃতজ্ঞতা: Click This Link bodies of muslims.jpg
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।