বাকশাল শেখ মুজিবের জীবনের এক গুরুত্বপুর্ণ নতুন অধ্যায়!এ অধ্যায়ে শাসক হিসেবে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব ভার গ্রহন করেন। তিনি এমন এক সময়ে শাসনভার হাতে নেন দেশ যখন যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত। চারিদিকে ব্যাপক ধ্বংস,অসঙ্খ্য নরকঙ্কাল,গলিত লাশ!ভস্মীভুত ঘরবাড়ি,আর্ত হাহাকার,কল কারখানা বন্ধ মেশিন পত্র লুন্ঠিত,রেলের চাকা অচল,গোল্ড রিজার্ভ নেই,ফরেন কারেন্সি নেই,কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের একটি পয়াসাও দেয়া হয় নি আমাদেরকে। রাস্তা ভাঙ্গা,যানবাহন ধ্বংস,একটি বিমান ও নেই,নেই কোন জাহাজ,বিধ্বস্ত বন্দর। থানা ভাঙ্গা,পুলিশ নেই,নেই প্রয়োজনীয় সুশৃঙ্খল বাহিনী,এক কোটি অর্থাৎ সাত ভাগের একভাগ লোক দেশ ত্যাগ করে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল,দেশের অভ্যন্তরে ছিল তিন কোটি শরনার্থী যাদের ঘর বাড়ি লুন্ঠিত হয়েছিল দেশী আলবদর রাজাকার দের হাতে।
জীবন হারালো ত্রিশ লক্ষ মানুষ। নির্যাতিত হয়ে হয়েছিল তিন লক্ষ মা বোন!দেশের প্রায় তিনশত কালভার্ট ধ্বংস হয়েছিল ভয়াবহ যুদ্ধে। প্রায় অর্ধেকের বেশী কৃষি উপকরন লুন্ঠিত হয়েছিল হানাদারদের সহযোগীদের মাধ্যামে। তাই কৃষি ও ব্যাবসাও ছিল অচল। পাকিস্তানে আটক কয়েকলাখ বাঙ্গালী।
খাদ্যগুদাম খালি। ত্রিশ লক্ষ টন খাদ্য ঘাটতি। অষুধ চাই খাবার চাই বাসস্থান চাই।
তেতাল্লিশ লক্ষ বিদ্ধস্ত ঘর বাড়ি পূর্ননির্মিত হল। পঁচিশ বিঘা পর্যন্ত খাজনা মাফ করা হল।
অতীতের ষাট লক্ষ সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার করা হল। উৎপাদনের স্বার্থে গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের ৭২ কোটি টাকা সাহায্য দেয়া হল। পরিবহনের জন্য সাড়ে সাত হাজার বাস ট্রাক আমদানী করাহল। বন্যা নিয়ন্ত্রন ও বিদ্যুৎ শক্তি উন্ন্যনের জন্যে ব্যাপক পরিকল্পনার কাজে হাত দিল। প্রতিটি থানায় পল্লী স্বাস্থ্য কেন্দ্র নির্মানের কাজ এগিয়ে চলল।
পঞ্চমশেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে বই বিতরণ করা শুরু হল। দশ হাজার নতুন প্রাইমারী স্কুল স্থাপিত হল। এই প্রথমবার ও শেষবারের মত একসাথ ৬০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ করা হল। বার হাজার স্কুল উন্নয়নের ব্যাবস্থা করা হল। প্রাইমারী শিক্ষকদের এই প্রথমবার সরকারী পর্যায়ে উন্নীত করা হল।
গঠন করা হল ইসলামী ফাউন্ডেশন যা পাকিস্তান রাষ্ট্রের ২৩ বছরেও করা হয়নি। কয়েকটি নতুন কাপড়ের কল নির্মিত করা হল,স্থাপিত হল বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ,টি এস পি সার কারখানা ও দুগ্ধ খামার ইত্যাদি। খেত খামারে উৎপাদনের জন্য ৪০ হাজার পাওয়ার পাম্প দেয়া হল,১০ হাজা শ্যালো পাম্প ও ৩ হাজার ডিপ টিওবোয়েল। ক্রয় করা হল ৭২ টি ট্যাঙ্ক। মাত্র তিন মাসের মাথায় ফেরত পাঠানো হয়েছিল ভারতীয় মিত্র বাহিনীকে,যা বিশ্বের আর কোন দেশে ঘটে নি।
বংগবন্ধু ক্ষমতা হাতে নিয়েই সবকিছুর আগে বিধ্বস্ত দেশের পুনর্বাসনে হাত দেন। এক কোটি শরনার্থীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হল। তাদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিতে হল!অথচ আটকে পড়া পাকিস্তানিদেরকে এখন পর্যন্ত পাকিস্তান ফেরত নেয় নি!কয়েক লক্ষ অস্ত্র সারাদেশে ছড়ানো ছিল। তা উদ্ধারের ব্যবস্থা করা হল। অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পুনর্বাসিত করে রক্ষীবাহিনী গঠন করা হল।
এটাই ছিল শেখ মুজিবের একমাত্র ভুল!কেননা সেদিন যদি শেখ মুজিব সেদিন রক্ষীবাহিনী গঠন না করলে যুদ্ধ পরবর্তীতে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ও বিশৃঙ্খল নাগরিকদের হাতে এ দেশে রাজাকারের কোন বংশধর থাকত না!
ফরেন অফিস নেই,নেই দক্ষ অফিসার বা একটি সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য কোন যথাযোগ্য প্রশাসন। প্রশাসনিক কাঠামো ছিল প্রাদেশিক,পরিচালিত হত কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাদের ছিল না,ছিল না অভিজ্ঞতা!এম কে আনোয়ার বা মোফাজ্জল করিম সাহেবদের মত যারা ছিল তারাও মূলত বিপক্ষে কাজ করত!কূটনৈতিক স্বীকৃতি না থাকায় বাংলাদেশ ছিল মুলত বিচ্ছিন্ন। বহিঃবিশ্বের সাথে কোন বিমান যোগাযোগ ছিল না। দুটি সামুদ্রিক বন্দরও ছিল অচল!চরম প্রতিকুলতার মাঝে ক্ষমতা হাতে নিয়ে সমস্যা মোকাবেলার চেষ্টা করেন।
বঙ্গবন্ধুর দেশ গড়ার সংগ্রামকে বাঞ্চাল করার জন্য সারা দেশে স্বাধীনতা বিরোধীদেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র আত্মঘাতীমুলক কার্যকলাপ শুরু করেন। চলল ডাকাতি হাইজ্যাকিং চোরাকারবারি মুনাফাখোরি ইত্যাদি!শুরু হল খতমের রাজনীতি। রেল লাইন উড়িয়ে দেয়া হল,কারখানাত ডিনামাইট মারা হল। ৫ জন এম পি কে হত্যা করা হল। স্বাধীনতাযোদ্ধা সহ বিশ হাজার আওয়ামিলিগ কর্মীকে হত্যা করা হল।
কিছু লোক অতি বিপ্লবী হয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড কার্যকলাপ শুরু করেছিল। কেউ কেউ আবার দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়ে অল্পবয়সেই নেতা সাজতে চেয়েছিল।
এই অবস্থার সাথে শুরু হল প্রাকৃতিক বৈরিতা!খরা হল------হল প্রচন্ড বন্যা । রাজধানীতে নৌকা চলল। পর পর দুবছর খাদ্য ঘাটতি দাড়াল ৪০ লক্ষ টন।
আমাদেরটাকায় ক্রয় করা খাদ্য যথাসময়ে এদেশে আসতে দেয়া হলা না,চট্টগ্রাম বন্দর হতে ফিরিয়ে এনে ডুবিয়ে দেয়া হল। যুদ্ধবিদ্ধস্ত এদেশের পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ হয়েছিল য জাতিসঙ্ঘের এক রিপোর্টে আশঙ্কা করা হয়েছিল যে,বাংলাদেশে অন্তত ৫০ লক্ষ লোক মারা যাবে। বংগবন্ধুর সফল নেতৃত্বেই ঠেকানো সম্ভব হয়েছিল!
বঙ্গবন্ধু সফল শাসক ছিলেন এর প্রমাণ,আজকের তত্তাবধায়ক সরকার। বিশ্ববাজারে দ্রব্যমুল্য বঙ্গবন্ধুর সময়েও বৃদ্ধি পেয়েছিল। আজকেও দ্রব্যমুল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার উর্ধ্বে,নীরব দুর্ভিক্ষ!অথচ অনেক গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবিরা তত্তাবধ্যক সরকারের পক্ষে কথা বলছে,বিশ্ববাজারে দ্রব্যমুল্যবৃদ্ধির কথা প্রচার করছে।
আর বঙ্গবন্ধুর সময় তারা দাড়িয়েছিল বিপক্ষে। একটা শিশুরাষ্ট্রে পর্বত পরিমান সমস্যার মাঝে দেশের দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধি পাওয়া অস্বভবিক কিছু নয়। আর স্বধীনতার ৩৮ বছর পর যদি দ্রব্যমুল্য দ্বিগুন বা তিন গুন বৃদ্ধি পায়,নিঃসন্দেহে তা দুঃখজনক!এই আলোকেই বঙ্গবন্ধু সফল শাসক ছিল।
বংগবন্ধু সফল শাসক ছিলেন তার আরেক প্রমাণ রাশিয়া। সমাজতন্ত্র থেকে পুঁজিবাদে যাওয়ার আগে রাশিয়ার এক রুবল ছিল,এক মার্কিন ডলারের সমান।
কিন্তু দু বছরের ব্যাবধানে এক ডলারের মান দাড়িয়েছে ৯০০ রুবল। অর্থাৎ রুশ মুদ্রার দাম ৯০০ ভাগের এক ভাগে এসে দাড়িয়েছিল। অথচ সমাজ ব্যাবস্থা পরিবর্তনের এ প্রক্রিয়ায় রাশিয়ায় রক্তক্ষয়ী ঘটনাও ঘটেনি। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার মত কোন চ্যালেঞ্জ আসে নি!বাংলাদেশের মত ত্রিশ লক্ষ প্রান হানীতো দুরের কথা,একটি লোকেরো প্রাণ দিতে হয় নি। কোন প্রাকৃতি দুর্যোগ হয় নি,বরং সমাজতন্ত্রের অবসানের জন্য রাশিয়া আমেরিকার কাছ থেকে পেয়েছে বিশাল অঙ্কের সাহায্য।
দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিধর দেশ রাশিয়ায় যদি শুধুমাত্র সমাজ ব্যাবস্থা পরিবর্তনের জন্যা বেকারত্বে ভুগতে পারে,যদি জিনিশ পত্রের দাম ৯০০ গুন বাড়তে পারে তবে যে দেশটা ভয়াবহ যুদ্ধে পুরোপুরি বিদ্ধস্ত হয়েছিল,যে দেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগারে একটি টাকাও ছিল না সে দেশে কতটুকু সঙ্কট হতে পারে তা বুদ্ধিমান মানুষই বুঝতে পারে!কিন্তু শেখ মুজিব তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের দ্বারাই এর প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বংগবন্ধু দেবতা ছিলেন না,অতি মানব ও ছিলেন না। তার যত গুন থাক মানবিক ভুল ত্রুটির উর্ধ্বে ছিলেন না!কিন্তু তিনি ছিলেন মহান দেশ প্রেমিক!ব্যাক্তিত্ব ছিল হিমালয়ের মত মহান!শাসক হিসেবে দেশপ্রেমের আদর্শ তিনি লালন করেছেন!তিনি বাকশাল কায়েম করতে চেয়েছিলেন। আসলে বাকশাল হল একক জাতীয় দল যার পুরোনাম বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামীলীগ। আওয়ামী লীগ শব্দটা বাদ দিলে দাঁড়ায় কৃষক ও শ্রমিকের জন্য গড়া দল।
যে দেশের মানুষের ৯০ ভাগই কৃষক ও শ্রমিক,সে দেশের একটি দলের নাম বাকশাল হওয়াটাই স্বাভাবিক। এদেশের মানুষের অধিকাংশই দরিদ্রসীমার নিচে অবস্থান করে,যাদের রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও সামাজিক তথা সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে,দেশের বিপুল সঙ্খ্যক গরিষ্ঠ অবহেলিত জনসঙ্খ্যার কল্যানে পুর্ণ অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক স্বাধীনতা এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শোষণমুক্ত ও সুষম সাম্যভিত্তিক এক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য জাতির জনক জনগনের প্রতিনিধিদের প্রণীত এক সাংবিধানিক ধারাবলে গঠন করলেন বাকশাল। বাকশাল হল শোষণমুক্ত সমাজ ব্যাবস্থার এক রাজনৈতিক দর্শন!আজ বংগবন্ধু জ়ীবিত থাকলে এবং বাকশাল কায়েম হলে আমরা কিউবা বা মালয়েশিয়ার অবস্থানেই থাকতাম!স্বাধীনতার ৩৮ বছর পর আমাদের বুদ্ধিজীবিরা জাতীয় সরকার নিয়ে চিৎকার করছেন। আসলে বুদ্ধিজীবিদের কথায় জাতীয় সরকার গঠিত হয় না। এর জন্য প্রয়োজন নেতৃত্ব!সত্তুরের গোড়ার দিকে বঙ্গবন্ধু যে জাতীয় সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন,আমাদের বুদ্ধিজীবিরা তা বুঝতে পেরেছেন ৩ যুগ পরে!
স্বধীনতার পর বাকশাল বা জাতীয় সরকার কায়েম করা আমাদের জন্য জরুরী ছিল!একটি যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশে জাতীয় সরকার কায়েম হওয়াটাই স্বাভাবিক।
'৭৩ এ নির্বাচন দিয়ে বংগবন্ধু ভুল করেছিলেন। নির্বাচনের পূর্বেই প্রয়োজন ছিল সর্বদলীয় সরকার বা বাকশাল। যার পরিধি হওয়া উচিত ছিল অন্তত ২০ বছর বা লক্ষ্য অর্জন পর্যন্ত। সেদিন যদি সেটা সঠিক ভাবে কায়েম হত তাহলে ৭৫,৮১ বা ১/১১ হত না!
নবাব সিরাজের পতনের পর দু'শ বছর পর্যন্ত ইংরেজরা অপপ্রচার করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরও যদি আরো ২০০ বছর অপপ্রচার চালানো হয় তবুও বংগবন্ধুর অবদান মুছে যাবে না!
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।