"জল যে পথে যায় রক্ত সে পথে যায় না, কেননা রক্ত জলের চাইতে গাঢ় এবং ঘন। " [আহমদ ছফা] তারিখ : ২৯/৪/২০১৩ খ্রি.
সংবাদ সম্মেলন
বাম মোর্চার কার্যালয়
সাংবাদিক বন্ধুরা,
আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হওয়ায় আপনাদের ধন্যবাদ। সাভারে রানা প্লাজার ভবন ধসে যে মানবিক বিপর্যয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এই ঘটনায় মৃত ও আহত শ্রমিকদের সংখ্যায় অতীতের সকল রেকর্ড অতিক্রম করলেও বাংলাদেশে ভবন ধস কিংবা অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনা অপরিচিত কিংবা নতুন নয়। বাংলাদেশে এইসব কথিত শ্রমিক দুর্ঘটনায় শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে আসছে।
এইসব দুর্ঘটনার পেছনের কারণগুলোকে যদি সামনে আনা যায় তাহলে এগুলোর কোনোটাকেই আর দুর্ঘটনা বলার কোনো যৌক্তিকতা থাকে না। সাভারের রানা প্লাজার ক্ষেত্রে দেখা গেছে ভবনটির নকশা ত্রুটিপূর্ণ, নিয়ম মেনে ভবনের জন্যে অনুমতি নেয়া হয়নি। তার ভেঙ্গে পড়ার ধরনেই পরিষ্কার যে ভবনটির নির্মাণে নিম্নমানের উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে। এবং এই ধরনের একটি ভবনেই এতগুলো গার্মেন্ট করাখানা চালানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে, সেখানে বহু ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয়েছে। সেখানকার একজন শ্রমিক তাঁর অভিজ্ঞতায় জানিয়েছেন, প্রতিবার জেনারেটর চালানোর সময়ই ভবনটি ভয়ঙ্করভাবে কাঁপত।
এ ধরনের একটি ভবন যে কোনো দিন ধসে পড়বে সেটা ছিলো অনিবার্য। ফলে যা অবশ্যাম্ভবী তাকে দুর্ঘটনা বলার কোনো যুক্তি নেই। এটা হচ্ছে কম খরচে শ্রমের লুন্ঠনমূলক শোষণের মাধ্যমে দ্রুত মুনাফা তুলে নিয়ে যাবার মানসিকতারই পরিণতি। রাষ্ট্র এক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা, মর্যাদা ও ন্যায্য পাওনা নিশ্চিত করার বদলে বরং এই লুণ্ঠন প্রক্রিয়ারই পাহারাদারের ভূমিকা নিয়েছে।
বাংলাদেশে এতগুলো বড় বড় ঘটনার পরও কোনোবারই দায়ী ব্যক্তিদের কোনো বিচার হয়নি, যে সমস্ত কারণ এই ঘটনাগুলো ঘটাকে অনিবার্য করে তোলে তার নিসরনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
ফলে আমরা মনে করি এগুলো কোনো দুর্ঘটনা নয়, শ্রমিকদের ওপর চালানো ধারাবাহিক কাঠামোগত গণহত্যা। শুধু রানা প্লাজা নয়, আমরা বিচার চাই সমস্ত ভবন ধস ও অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর হোতাদের। শুধু বর্তমান সরকার নয়, অতীতের সমস্ত সরকারের আমলেই এই ধরনের কাঠামোগত গণহত্যার জন্য দায়ীদের বিচার চাই আমরা। কেননা এই ধরনের নিষ্ঠুর, অমানবিক প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত লোকদের বিচার না হওয়া এই ঘটনারই পুনরাবৃত্তির পথ তৈরি করে। কিন্তু শুধু একটি, দুইটি ঘটনার বিচার কিংবা একজন দুইজনের শাস্তিই যথেষ্ট নয়।
এই ধরনের ঘটনার পেছনে যে কারণগুলো আছে তা দূর না করলে, যেসব ভবন এখনো বিপদের সম্ভাবনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা না নিলে এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতেও ঘটতেই থাকবে। সে কারণে যথাযথ মান নিশ্চিত না করতে পারলে সেখানে ভবন বা গার্মেন্ট কারখানা চালু করা অনুমতি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। ভবনের নকশা অনুমোদন ও যথার্থ নির্মাণ মান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সকল দুর্নীতির উচ্ছেদ করতে হবে। যথার্থ অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ছাড়া কোনো কারখানার অনুমোদন দেয়া যাবে না, কারখানায় কেচি গেট বাতিল করে প্রশস্ত সিঁড়ির ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে, কোনো অবস্থায়ই কারখানা থেকে নির্গমণ পথ বন্ধ না করা বিষয়ে রাষ্ট্রীয় মনিটরিং করতে হবে। এবং এ ধরনের কোনো অবহেলা বা দুর্নীতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে।
এসব ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে গার্মেন্ট কারখানায় দুর্ঘটনা বন্ধ করা যাবে না। ফলে শ্রমিকদের সার্বিক নিরাপত্তা, বাঁচার মতো মজুরি, বৈষম্য লাঘবের দাবিতে আমাদের এই হরতাল কর্মসূচি। কেবল রানা প্লাজা নয়, কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া তাজরীনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এবং বিএনপি-জামায়াত আমলে স্পেকট্রাম গার্মেন্টসের ভয়াবহ ধসেরও বিচার চাই আমরা। শ্রমিকদের ওপর চালানো ধারাবাহিক কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের অবসানের লক্ষ্যেই আমাদের এই কর্মসূচি। ফলে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার গ্রেপ্তারকে আমরা সাধুবাদ জানাই এবং তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করি।
কিন্তু যে সমস্ত পদক্ষেপের কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি সেগুলো ছাড়া এই সমস্যার কোনো দীর্ঘমেয়াদী সমাধান সম্ভব নয়। আমরা আমাদের উত্থাপিত দাবিদাওয়া অবিলম্বে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।
বন্ধুগণ,
আমরা গত ২৭ তারিখ সকাল ১১টায় সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে হরতাল ঘোষণা করি। সেই হরতালের খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসার পর ১৮ দলীয় জোটও একই দিনে হরতালের ঘোষণা দেয়। কিন্তু তাদের হরতালের ঘোষণায় এই কাঠামোগত এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কিছু নেই।
বরং বাস্তব সত্য হলো তাদের ক্ষমতাসীন থাকার সময় একের পর এক এই ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটলেও তারা-এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ২০০৫ সালে স্পেকট্রাম গার্মেন্টস ধসের ঘটনায় গার্মেন্ট মালিক বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতার ঘনিষ্ঠজন হওয়ার সুবাদে পার পেয়ে যায়। আজ পর্যন্ত তার কোনো বিচার হয়নি। শুধু তাই নয় যে উদ্ধার তৰপরতার ব্যর্থতার কথা তারা বলছে, রাষ্ট্রীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার যে তুমুল সীমাবদ্ধতা আজকে পরিলক্ষিত হয়েছে বিগত সরকার হিসেবে বিএনপি-জামায়াতও তার জন্য সমানভাবে দায়ী। ফলে তাদের এই হরতাল আহ্বান শ্রমিকদের ওপর এই হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য নয় বরং তার রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য।
সে কারণে ১৮ দলীয় জোটের এই হরতাল প্রতারণামূলক এবং নিজেরা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েও তার বিচার না করে এই ইস্যুতে হরতাল আহ্বানের নৈতিক অধিকার তারা হারিয়েছে। এটা তাদের রাজনৈতিক অসতারই দৃষ্টান্ত, অতীতের হত্যাকাণ্ডগুলোর বেলায় তারা গণশত্রুদের সহযোগী ও রক্ষকের ভূমিকাই পালন করেছে।
বন্ধুগণ,
আমরা পরিষ্কার করে ঘোষণা করছি সাভারে উদ্ধারকাজ, লাশ পরিবহন বা চিকিৎসা সেবার কাজে নিয়োজিত সকল যানবাহন, জরুরি সেবা প্রদানকারী সকল সংস্থা, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ওষুধের দোকান ইত্যাদি এই হরতালের আওতামুক্ত থাকবে। সাভারে উদ্ধারকাজে নিয়োজিত পণ্য বা স্বেচ্ছাসেবকরা শুধু হরতালের আওতামুক্ত থাকবে, শুধু তাই নয়, হরতালকারীরা নিরাপদ স্থানান্তরে সহায়তা করবেন। আমাদের স্বেচ্ছাসেবীরা একেবারে প্রথম দিন থেকেই সেখানে উদ্ধার, ত্রাণতৰপরতা পরিচালনা এবং পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছেন, তাদের সে ভূমিকার পাশপাশি এই ধরনের দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলাই এই হরতালের লক্ষ্য।
একই সাথে এটাও স্পষ্ট করে বলতে চাই আমাদের এই হরতাল কোনো জ্বালাও-পোড়াও-এর হরতাল নয়। আমরা জনগণকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই হরতালে মাঠে আসতে আহ্বান জানাই এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে, তার দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের দাবিতে। কাজেই একই দিনের হরতাল ডাকা বিএনপি-জামায়াত জোটের কোনো সহিংসতার দায়-দায়িত্ব আমরা গ্রহণ করবো না। আমরা জনগণের কাছে এই সহিংস রাজনীতি প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানাই।
বন্ধুগণ,
আমরা আশাকরি আমাদের নিম্নোক্ত দাবিদাওয়া আপনারা গণমাধ্যমের মাধ্যমে জাতির কাছে তুলে ধরবেন এবং এই ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড বন্ধে জনমত গঠনে সহযোগিতা করবেন।
নিচে দাবি দাওয়া উল্লেখ করা হলো:
১. শুধু গ্রেফতারের নামে চোখে ধুলো দেয়া নয়, রানা প্লাজা, তাজরীন, স্পেকট্রামসহ এ পর্যন্ত ভবন ধস ও অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী সকল মালিক, ব্যবস্থাপক, ভবন পরিকল্পনাকারী ও অনুমোদনকারীর বিচার করে যথার্থ শাস্তি বিধান করতে হবে।
২. শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবিলম্বে ঝুঁকিপূর্ণ সকল কারখানা চিহ্নিত করতে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করতে হবে এবং আগামী এক মাসের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা চিহ্নিত করে তা বন্ধ করে দিতে হবে।
৩. অবিলম্বে রানা প্লাজা ভবন ধসের ফলে নিহত, নিখোঁজ, আহত শ্রমিকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে হবে।
৪. রানা প্লাজার দখলীকৃত জমি উদ্ধার করে নিহত শ্রমিকদের সম্মানে স্মৃতিসৌধ ও শ্রমিকদের আবাসস্থল নির্মাণ কর। ঘাতক সোহেল রানাসহ দায়ী গার্মেন্ট মালিকদের সকল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করে সেই অর্থ দিয়ে এই নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে হবে।
৫. প্রত্যেক নিহত শ্রমিক পরিবারকে তার সারা জীবনের আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এক্ষেত্রে নিখোঁজ শ্রমিকদের অবশ্যই নিহত হিসাবে বিবেচনা করতে হবে।
৬. আহত শ্রমিকদের সুচিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ মালিকপক্ষের কাছ থেকে আদায় করতে হবে। আহত শ্রমিকদের সুস্থ হয়ে কাজে যোগদান পর্যন্ত তার আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পঙ্গু শ্রমিকদের পুনর্বাসন করতে হবে।
৭. গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৮০০০ টাকা নির্ধারণ করতে হবে এবং সকল কারখানায় তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
৮. সকল কারখানায় ও ইপিজেডে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া আদায়ের বৈধ সংগঠন ট্রেড ইউনিয়নের অনুমতি দিতে হবে।
৯. শ্রম আইনের অগণতান্ত্রিক, শ্রমিক স্বার্থবিরোধী ধারা বাতিল করে গণতান্ত্রিক ও শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণকারী শ্রম আইন প্রণয়ন করতে হবে।
১০. নারী শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্য বাতিল করতে হবে, ৬ মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি প্রত্যেক কারখানায় বাধ্যতামূলক করতে হবে।
এইসব দাবিদাওয়াতে আমরা জনগণকে বৃহত্তর সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানাই।
বিপুল জনমতের চাপ না থাকলে সোহেল রানাও অন্য ঘটনার মতো সহজেই পার পেতে যেত। জনগণের প্রতি তাই আমাদের আহ্বান: আপনাদের ক্ষোভ, আপনাদের বেদনাকে স্থায়ী সমাধানের জন্য শক্তিতে পরিণত করুন, সংগঠিত প্রতিবাদ গড়ে তুলুন। ২ মে সর্বাত্মক হরতালে অংশ নিন, একে জনস্রোতে পরিণত করে শ্রমিকদের গণহত্যার বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হোন।
মোশরেফা মিশু
সমন্বয়ক
গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।