আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মা কে ছেড়ে থাকা



আমার কন্যা, বয়স চার বছর। এই চার বছরে আমি তাকে ছেড়ে একবার বাইরে গিয়েছিলাম চারদিনের জন্য। সেটি গত বছরের কথা তখন তার বয়স তিন। এছাড়া বাকী সবসময় সে আমার সাথে থাকে। দিনে যদিও আমি অফিসের কাজে বাইরে থাকি অন্তত রাতে আমরা একসাথে থাকি।

তো আমাদের পরিবারের সবার বদ্ধমূল ধারনা ও আমাকে ছাড় থাকতে পারবে না, কান্নাকাটি করবে। এদিকে গত আগষ্ট মাসে আমাদের একটি ট্যুর করতে হবে, আমরা একটি প্রজেক্ট চালাই তার প্রজেক্ট লীডার এবং আরো কয়েকজন মান্যগন্য ব্যক্তি বাংলাদেশে আসবেন তাদের নিয়ে প্রজেক্ট সাইট গুলো ভিজিট করা। এই ট্যুর এ আমার প্রতিষ্টানের ডিজি, ডিরেক্টর ও থাকবেন। কাজেই এমন একটি ট্যুর এ বাচ্চাদের নেয়া সম্ভব না। আমি বাসায় আগে ভাগেই জানিয়ে রাখলাম যে বাবুকে বোনের বাসায় রেখে আমি যাব।

এদিকে পিচ্চিকেও যাবার দু একদিন আগে থেকে সবক দেওয়া হচ্ছে তোমার আম্মু অফিসে যাবে, অফিস থেকে বাসায় কিন্তু আসবে না, অফিসেই ঘুমাবে। আমার কন্যা সীমাহীন আনন্দিত কন্ঠে এই তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে আমার কাছে জানতে চাইলো, আমি জানালাম ঘটনা সত্য। এতে তার কোন কষ্ট হবে কিনা শুনে ও বললো না কোন ক্ষ্ট হবে না। যেদিন টিমটি ঢাকা এল, মেয়ে আমার ব্যস্ততা দেখে বুঝতে পারছে যে আম্মুর সেই দিনটি এসেছে। প্রশ্ন করলো আজ থেকে অফিসে থাকবো কিনা।

আমি তাকে আস্বস্ত করার সুরে বললাম না মা আজ না কাল থেকে থাকবো, আজ বাসায় ফিরবো। মেয়ে দৌড়ে আমার বোনের কাছে যেয়ে বলছে, তুমি না বলেছো অফিসে থাকবে আম্মুতো বলছে বাসায় চলে আসবে। মনে হল সে কিছুটা অখুশি। পরদিন আমরা খুলনা রওনা হব, সকালে মেয়েকে বললাম আম্মু বাই, মহা আনন্দে আমার মেয়ে বলে বাই, ভাল ভাবে যেও, আমি সব খাব, কোন অসুবিধা নাই, হড়বড় করে বলা তার কথা শুনে বাসার সবাই এবং আমার কলিগ হাসলেন একচোট। আমি আমার কলিগ কে বললাম স্যার দেখেন ও কত খুশি আমি চলে যাচ্ছি।

উনি আরো এককাঠি উপরে। বলছেন, বলবে না, আজথেকে ওর স্বাধীন জীবন শুরু। মায়ের জ্বালাতন সহ্য করতে হবে না। আমাদের গ্রুপটি প্রথমদিন খুলনা,পরদিন সাতক্ষীরা, যশোর হয়ে রংপুর যাবে। যশোর থেকে ঈশ্বরদি হয়ে রংপুর।

অনেক লম্বা পথ। ভোর সাড়ে ছটায় রওনা হয়ে আমরা রংপুর পৌছলাম রাত সাড়ে নটায়। পথে মাঝে মাঝে খাবারের জন্য থামতে হয়েছিল। এত প্যাক্ট একটা প্রোগ্রাম, সরাদিন মাঠে মাঠে ঘোড়া, গাড়িতে বসেই আলোচনা, মাঠ থেকে ফিরেও মিটিং; মেয়ের সাথে ফোনে গল্প ও করতে পারছি না, যদি বা ফোন করি, মেয়ে খুব ব্যস্ত কথা বলার সময় নাই। বোনের কাছে খবর পাই, তার এখন ঈদ উৎসব চলছে, পুরো দুধের গ্লাস কখনোই শেষ হয় না, আর খাবারে এখন নিত্য নতুন ম্যেনু সে নিজেই ফরমায়েশ করছে, সারাদিন পোশাক পাল্টাচ্ছে, প্রতি বিকেলে নন্দনে (শপিং মল) ঘুরে আসছে একপাক।

পরদিন ভোরে রংপুর এবং কুড়িগ্রামে ভিজিট শেষে ফোন করলাম, মেয়ে খুব আহ্লাদিত কন্ঠে জিগগেস করলো আম্মু কখন আসবা? আমি ভাবলাম আহারে আমার জন্য মনে হয় খারাপ লাগছে, বললাম এই তো মা এখনই র্ওনা হব রাতে পৌছাব, বলল আচ্ছা রাখি বাই। আমরা দুপুরের খাবার শেষ করে যখন গাড়ীতে উঠে বসলাম তখন বিকেল চারটা। আমার বোন ফোন করলেন জানালেন আমার মেয়ে বলছে আম্মু এত তাড়তাড়ি কেন আসবে? আম্মুকে আসতে বারণ কর। আমি আমাদের গাড়ির সবাইকে বলে দিলাম এই কথা। সব তো হেসে খুন।

আমাদের ভিজিটরদের সবচেয়ে সিনিয়র ড. টুং বললেন তোমার মেয়েকে তুমি খাওয়া নিয়ে জোর করবে না, যা করতে চায় করতে দিবে। অন্যরা ও খাওয়া নিয়ে জোর করলে কি হয় অথবা কোন টেকনিকে বাচ্চাকে খাওয়াতে হয় এ নিয়ে যার যার মজার সব অভিজ্ঞতা বললেন। আমার একটু মনটা খারাপই হল আমার মেয়ে আমি ফিরবো এতে খুশি না! আমরা রাতে ফিরলাম সাড়ে বারোটায়। তখন মেয়ে আমার ঘুমে কাদা। আমি বেশী সাড়াশব্দ না করে পাশে শুয়ে ঘুম।

সকালে পাশে আমাকে আবিষ্কার, মিষ্টি হেসে বলছে আমি রাতে আম্মার সাথে ঘুমালাম আর সকালে দেখি তুমি! আমার মেয়ে আমার বড় বোন কে আম্মা বলে ডাকে। আমি ওকে মনে করিয়ে দিলাম, তুমি তো আমাকে আসতে নিষেধ করেছো। ও মুচকি মুচকি হাসে। এখন একটা পাড়াগাঁয়ে ওসব প্রোজেক্টের একটার তদারকির জন্য আছি কন্যাকে সাথে নিয়ে। আমার ষ্টাফদের একজনের বাসায় পুকুরে সাতার শেখার নাম করে সেদিন ও বাড়ীতে গেছে আর আসে না।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল, রাত, তারপর বাড়ী ফিরলো। আজও গেছে, আমি রান্না করে দিলাম ওর জন্য আলাদা মাছ। একটু আগে খবর পেলাম সে আম্মুর রান্না করা মাছ খাবে না। আমি ভাবছি এ যে দেখছি আসলেই মার চেয়ে মাসির জন্য দরদ বেশী! রাতেও ও বাড়ীতে থাকবে বলেছে। এও বলেছে আম্মু যখন ঢাকা যাবে তখন সে ওদের বাড়ীতে অনেকদিন থাকবে।

বাড়ীতে ফিরে যখন গলা জড়িয়ে ধরে কত্ত আদরের কথা বলবে তখন কেউ ভাবতেও পারবে না এই মেয়ে মা কে ছেড়ে সারাদিন কত সুখে ছিল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।