আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার ছবি আঁকা (সংশোধিত পোস্ট)

"পসার বিকিয়ে চলি জগৎ ফুটপাতে, সন্ধ্যাকালে ফিরে আসি প্রিয়ার মালা হাতে"

আমার ছবি আঁকা (সংশোধিত) ছোটবেলা থেকেই স্কেচ, জলরং, চিত্রকলা, পেইন্টিং, আলোকচিত্র ও হস্তশিল্পের প্রতি এক ধরণের আকর্ষণ অনুভব করতাম। আমার বাবা নিজেই একসময় তাঁর নিপূণ ও শৈল্পিক হাতে সৌখিনতার বশে বালিশ, চাদর, টেবিল ক্লথ ও রুমালে ফুল তুলতেন। দেখে অবাক হতাম! আমি ভিউ কার্ড, স্ট্যাম্প ও নানা ধরণের ছবি সংগ্রহ করতাম। স্কুল জীবনে নিজেই রঙ বেরঙের প্রচুর ঘুড়ি বানিয়ে উড়িয়েছি। নাহ্, কখনো চিত্রশিল্পী হবো এমন খেয়াল মাথায় একবারের জন্যেও আসেনি।

শিল্পকলার প্রতি আমার প্রচ্ছন্ন অনুরাগটা ছিল বরাবরের। রাজশাহীর বরেন্দ্র যাদুঘর ছিল বাসার কাছেই। অবসর সময়ে সুযোগ পেলেই সেখানে ঢুঁ মারতাম। প্রাচীন আমলে গড়া বিভিন্ন মূর্তি, পুরাকীর্তি, আর পাথর খোদাইয়ের নানা রকম শিল্পকর্ম দেখে অবাক হয়ে ভাবতাম- মানুষ কি না পারে! মনে হতো ইশ্ আমিও যদি অমন করে মূর্তি বানাতে পারতাম। এরপর শুরু হলো ধারালো সব যন্ত্রপাতি দিয়ে মোম আর সাবানের উপর খোদাই চর্চার কাজ।

তৈরী করতাম গ্রীক দেব-দেবীর আদলে ছোট ছোট মূর্তি, পশু আর পাখী বানানোর কাজ। মা আমার এই কাজে খুব উৎসাহ দিতেন আর বাবা দেখলেই বকতেন। বাবার ধারণা ছিলো মূর্তি বানানো গুনাহ্'র কাজ। তিনি মনে করতেন শিল্পীরা অভাবে দিন কাটায়। এসব করলে ভবিষ্যতে না খেয়ে মরতে হবে।

তার চেয়েও বেশী ভাবতেন এই শখ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে পড়ালেখা লাটে উঠবে। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী মানুষ, হিসেব কষতেন সব কিছুতেই। অর্থনৈতিক ভাবনাটা ছিল অনেক স্বচ্ছ। তাইতো অধিক সন্তানের পরিবার সত্ত্বেও কখনো তাঁকে অভাবের মুখ দেখতে হয়নি। বরং অনেক স্বচ্ছলতার মধ্যে দিয়েই দিন কেটেছে।

বাবার একদম পছন্দ নয় বলেই শিল্পী হবার ইচ্ছা বা বাসনা মনের মধ্যে কখনো বাসা বাঁধেনি। আমার বাবার ছিল প্রেস ব্যবসা। সেই সাথে লাইব্রেরী আর ছিমছাম সুন্দর একটা স্টেশনারী শপ। রাজশাহী শহরের অন্যতম পুরোনো প্রেস (দি নিউ প্রেস) ও স্টেশনারী শপ ছিল আমাদেরটা। সেই কারণে ছোট বেলাতেই শ্যাবল্ হেয়ারের তুলি, জলরঙ, তেলরঙ, রঙ পেন্সিল, ক্রেয়ন স্টিক, চারকোল, ড্রইং ইংক এসব কোনকিছুর অভাব ছিলনা।

চাইলেই পেয়ে যেতাম। স্কুলে ছবি আঁকায় পুরস্কার পেয়েছি কয়েকবার। বাবা মনে মনে বেশ খুশী হয়েছিলেন। আমার স্কুল জীবনের এক শিক্ষক ("কালাচাঁন" স্যার) বাবাকে একদিন ডেকে বলেছিলেন- "আপনার ছেলে যা করতে চায় করুক, ওকে কোন কিছুতে বাঁধা দেবেননা। ও ভবিষ্যতে ভালই করবে, আপনি কখনো ওকে নিয়ে চিন্তা করবেননা"।

স্যারের কথা বাবা রেখেছিলেন। আঁকার অভ্যাসটা অনেকদিন পর্যন্ত চলেছিল। ভার্সিটিতে ঢোকার পর আঁকার ঝোঁকটা দমে গিয়েছিল। তারপর একসময় আঁকাটা ছেড়েই দিলাম। আজ বহুকাল সেই অভ্যাসটা আর খুঁজে পাইনি।

এখন আর আঁকতে মন চায়না। পারিওনা আগের মতো। ছবি আঁকার যাবতীয় কৌশল রপ্ত করেছিলাম ছোটবেলায়, স্কুলে পড়াকালীন সময়ে। আমার শৈশব কেটেছে নানীর বাড়ি, পুরোন ঢাকায়। ঢাকা যদিও তখন রিক্সার শহর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেনি তথাপি অলিতে গলিতে তখন রিক্সার কারখানা গড়ে উঠেছিল।

বিশেষত পুরান ঢাকায়। রিক্সার পেছনে টিনের সীটে নানা ধরণের ছবি আঁকা হতো। এছাড়াও টিপু সুলতান রোডে ছিল বেশকিছু সাইনবোর্ডের দোকান। পাশাপাশি ক্যানভাসে সিনেমার নানা দৃশ্য ও নায়ক নায়িকাদের ছবি আঁকানোর বেশ কিছু খুপরি ঘর। ঐ সব ঘরের সামনে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতাম।

মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে ঐসব ছবি আঁকা দেখতাম। ছোট বড় বিভিন্ন বয়েসের শিল্পীরা (?) কেমন মনযোগ সহকারে ক্যানভাসে একের পর এক ছবি এঁকে যাচ্ছে। রং আর তুলির কী নিখুঁত টান, টানের পর টান। ক্যানভাসের গায়ে সিনেমার পরিচিত ও জনপ্রিয় এক একজন নায়ক-নায়িকার বিভিন্ন পোজের ছবি। রঙের ছোঁয়ায় যেন এক একটা জীবন্ত মানুষের প্রতিচ্ছবি।

অবাক হয়ে দেখতাম আর ভাবতাম, আহ্ এমন যদি আঁকতে পারতাম। ক্যানভাসের গায়ে গ্রাফ টেনে হুবহু এক একটা মানুষের প্রতিকৃতি এঁকে যাচ্ছে অনায়াসে। কোথাও এতটুকু অমিল বা গড়মিল নেই। আমার কাছে ওরা তখন নামকরা চিত্রশিল্পী। সুযোগ পেলে এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পেলে হয়তো এরাই একদিন এক একজন ভ্যান গগ, লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জেলো, এস এম সুলতান কিংবা জয়নুল আবেদীন হয়ে যেতে পারতো।

আমার কাছে ওরাই তখন বিখ্যাত শিল্পী আর ওদের আঁকা ছবিগুলোই সব শিল্পকর্মের নমুনা। ছবি আঁকার ব্যপারে ওদের সেই সহজ ও সনাতন পদ্ধতি রপ্ত করা ছাড়া আমি নতুন করে তেমন কিছুই শিখিনি। কোন প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা কোন শিল্পীর কাছে চিত্রকলার নিয়ম কানুন বা কলা-কৌশল কখনো রপ্ত করিনি। মোট কথা ছবি আঁকার কোন নিয়মতান্ত্রক শিক্ষাই আমার ছিলনা। অথচ কি করে যেন ছবি আঁকার আগ্রহটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলো।

প্রথমদিকে কোন ছবি দেখে ভাল লাগলেই সেটাকে নকল করার চেষ্টা করতাম এবং আঁকার পর সবাইকে দেখাতাম, সেটা কেমন হলো! আসল ছবির মতো হয়েছে কিনা! ফলে একসময় ছবি আঁকাটা ভালই রপ্ত করে ফেললাম। আর এই ছবি আঁকার অভ্যাস থাকার কারণেই প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশে এবং বিভিন্ন এ্যাসাইনমেন্টে ছবি আঁকার বিষয় থাকলে আমি সেটাতে খুব ভাল করতাম। প্র্যাকটিক্যালে বরাবরই আমি সর্ব্বোচ্চ নম্বর পেতাম। পোট্রেট আঁকার সখ আমার ছোটবেলা থেকই। আর সেগুলো আঁকতাম ছবি বা ফটোগ্রাফ দেখে।

দিনের পর দিন আমি অনুরোধে, উপরোধে বিভিন্ন মানুষ ও আত্মীয়স্বজনের অনেক প্রতিকৃতি এঁকেছি। কোন পয়সার বিনিময়ে নয়। নিজের শখের বশে। পুরোন ঢাকার খুপরি ঘরের সেই সাইনবোর্ড আঁকার পদ্ধতি অনুসরণ করে। সেই পদ্ধতির প্রয়োগ ও কলাকৌশল ভালই রপ্ত করেছিলাম বলেই একদিন ভাল ছবি আঁকা শিখে গেলাম।

রঙ ও তুলির ব্যাপারে আমার আগ্রহ তেমন ছিলনা। সাদা-কালোতে মন আটকে গেল। আর এটা সম্ভব ছিল শুধুমাত্র গ্রাফাইট পেন্সিল ব্যবহারের মাধ্যেমই। গ্রে-স্কেল সম্পর্কে বিশদ ধারণা পেয়েছি আরও পরে। মূলতঃ H থেকে 2H, 3H; B থেকে 6B পর্যন্ত এইসব গ্রেডের পেন্সিল ছিল আমার ছবি আঁকার প্রধান মাধ্যম।

জল ও তৈল রং-এ খুব কম ছবি এঁকেছি। চারকোল (কয়লা) ব্যবহার করেছি অনেক বড় ক্যানভাসে ছবি আঁকতে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত জাতীয় ভুগোল সম্মেলনে "কালচারাল জিওগ্রাফী" বিষয়ের উপর আদিম মানুষদের (নিয়ান্ডাথ্যাল) বেশ কিছু প্রতিকৃতি দর্শক সমাদৃত হয়েছিল। সেইসব ছবিতে পোষ্টার কালার ব্যবহার করেছি। পোষ্টার, ঈদকার্ড ও জন্মদিনের কার্ড বানানোর সময়ও পোস্টার কালার ব্যবহার করেছি।

প্রতিকৃতি আঁকতে আমি মূলতঃ ফটোগ্রাফ ব্যবহার করতাম। পাসপোর্ট কিংবা B2 আকারের যে কোন ছবি। ফুল ফিগার ছবিও এঁকেছি। ছবির উপর পেন্সিলের হালকা দাগ টেনে বর্গ বা গ্রাফ এঁকে নিতাম। তারপর ড্রইং পেপার বা সাদা সীটের উপর একইভাবে পেন্সিলের হাল্কা দাগ টেনে হুবহু ঐ ছবির গ্রাফের আনুপাতিক হারে বড় মাপের গ্রাফ এঁকে নিতাম।

তারপর ছবির বিভিন্ন উপকরণের প্রতিফলণ ঘটাতাম ড্রইং সিটের উপর পেনসিলের হালকা-গাঢ় শেড-এর মাধ্যমে। ছবি হতো সম্পূর্ণ সাদা-কালো। এভাবেই শুরু। শুরুটা বেশীদূর পর্যন্ত এগোয়নি। কারণ ছবি আকাঁর চাইতে অন্যকিছু করার তাগিদটা জীবনে বেশী প্রয়োজন ছিল।

যে কোন কারণেই হোক আমি কখনো শিল্পী হতে চাইনি। হবার কোন চেষ্টাও করিনি। শিল্পী হবার বাসনা আমার মনে কখনও জাগেনি। শিল্পী হতে গেলে যে আবেগ লাগে, একাগ্রতা লাগে, শিল্পীসুলভ মন লাগে, কল্পনাশক্তি লাগে, অনুভূতি লাগে, দূরদৃষ্টি লাগে এবং সর্বোপরি যেমন দেখার চোখ ও হাতের ছোঁয়া লাগে তা আমার ছিল না। ছবি আঁকতে পারা আর শিল্পী হওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক।

মজার ব্যপার হলো আমার আঁকা প্রতিকৃতি দেখে সবাই প্রশংসা করতো- বলতো আরে এতো দেখছি হুবহু ফটোগ্রাফ। তার কারণ ছবি নকল করার দক্ষতা ও ক্ষমতা দুটোই ভালভাবে রপ্ত করেছিলাম। সেই অর্জন ধরে রাখতে পারিনি। কলেজ জীবনেই তার ক্রমাবনতি। এক সময় পরিসমাপ্তি।

নকল করে যুৎসই ছবি আকাঁ সম্ভব হলেও শিল্পী হওয়া সম্ভব নয়। সবাই শিল্পী হতে পারেনা। আমিও পারিনি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।