যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
১.
আমাদের বাসায় টি.ভি ছিলনা অনেকদিন; সেই নিয়ে আমাদের ভাইবোনদের অনেক রাগ-অভিমান ছিল বাবা-মা'র ওপর। সেবয়সে আমরা কেউই বুঝতামনা, পদবী যতই ভালো দেখাক, বাবার নির্দিষ্ট-টাকার বেতনে আটজনের সংসারের প্রাথমিক চাহিদা আর মেহমানদারীর বহর সামলাতেই হিমশিম খেতে হতো বাবা-মাকে, টিভি কেনার টাকা জমানো তো দূরের কথা, সঞ্চয় করাই সম্ভব ছিলোনা। আমরা ভাইবোনেরা তাই টিভি দেখতে ইচ্ছে হলে প্রতিবেশী যাদের বাসায় টিভি আছে তাদের বাসায় চলে যেতাম, লোকজনের সুবিধা-অসুবিধার বালাই না করে গাঁট হয়ে বসে ছায়াছন্দ, সিনেমা, খেলা -- এসব দেখতাম।
পঁচাশি-ছিয়াশি সালের দিকের কথা, আমি তখনও ছোট, ফোর-ফাইভে পড়ি, ইচ্ছেমতো আশপাশের বাসাগুলোতে টিভি দেখতে যাই। কিন্তু, আপারা তখন বড় হয়েছে, বড় আপা টেনে পড়ে, ওরা তো আর কোথাও টিভি দেখতে যেতে পারেনা।
এমনই একদিন হঠাৎ আপাদের একজন বাবাকে উদ্দেশ্য করে মুখ ফস্কে বলে ফেলল,"মনে হয় যেন নির্জন দ্বীপে নির্বাসনে আছি, একটু যে খবর দেখব সেই উপায়ও নেই!!" আপার এই কথাটা বাবার মধ্যে ভীষন প্রতিক্রিয়া তৈরী করে, উনি কষ্ট পাননি, তবে একটু ধাক্কা খান। হয়ত ভাবেন, "আসলেই তো, ছেলেমেয়েগুলোর প্রতি নজর দেয়া হয়নি!"
সেই শুরু হলো বাবা-মা'র নতুন প্রজেক্ট, অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে টিভি কিনবে। পারিবারিক খরচ থেকে এটা-সেটা কমানো হয়েছিলো, আমার মনে আছে, লাক্স সাবানের বদলে কসকো সাবান কেনা শুরু হয়েছিলো, আত্মীয়রা কেউ বেড়াতে এলে আর আগের মতো বড়বড় মোরগ আনা বাদ দিলেন বাবা, সম্ভবতঃ আত্মীয় স্বজনদের বাসায় বেড়াতে যাওয়াও কমিয়ে দিয়েছিলেন তারা। চার-চারটা বছর!! এরকম নানান কৃচ্ছতা করে চার বছর পর অবশেষে নব্বই সালের এক এপ্রিল মাসে ইত্তেফাকে টিভির বিজ্ঞাপন দেখে মা ঘোষনা দিলেন, "এই দাম হলে টিভি কেনা যাবে। "
আমার এখনও মনে আছে, সেদিন মা, ছোটমামা আর আমি গিয়েছিলাম টিভি কিনতে।
আমি কোনমতেই মুখের হাসিটা সরাতে পারছিনা, নিচে নেমে যখন রিক্সা ঠিক করছিলাম, বারাবার চেষ্টা করছিলাম মুখের হাসিটা লুকোতে। মনে হচ্ছিলো আশপাশের সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, সবাই বুঝে ফেলতে যাচ্ছে কি ঘটতে যাচ্ছে! রিক্সায় উঠতে উঠতে বাসার বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখি আপারা সবাই জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ওদের মুখে অদ্ভুত স্বর্গীয় এক হাসি। যেন টিভিটা আসলেই বাসাটা একটা স্বর্গে পরিণত হবে।
ষোলহাজার নয়শ আশি টাকা, আমার এখনও মনে আছে। টিভি কিনে যখন ফিরছিলাম, স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে ফকিরেরপুল হয়ে, তখন এক রিক্সায় মা আর আমি, সাথে টিভিস্ট্যান্ড; আরেকরিক্সায় মামা, কোলের ওপর বিশ ইঞ্চি ফিলিপসের বিশাল "রঙীন" টিভি।
আমার আনন্দ আর ধরেনা, বুঝতে পারছি ছেলেমানুষী হচ্ছে, তাও বারবার মামার রিক্সার দিকে তাকাই, মামার সাথে কথা বলার অজুহাতে টিভিটাকে দেখি। সে এক অদ্ভুত আনন্দ!
তখনই, হঠাৎ দেখি ফকিরেরপুল পানির ট্যাংকের মোড়ে এক মিছিল আসছে, এরশাদের গুষ্ঠী উদ্ধার করা হচ্ছে। মিছিল দেখেই আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেলো। বারবার মনে হতে লাগলো, এখন যদি এরা টিভিটা ভেঙে ফেলে! মামার রিক্সাটাকে যদি উপড়ে ফেলে দেয়। তখন আর কোন অজুহাত না, স্বাভাবিক নিয়মেই সামনের রিক্সা থেকে পারলে সারা শরীর বের করে আমি পিছনে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম মামার রিক্সার দিকে।
যেন ওভাবে তাকিয়ে থাকলেই টিভিটা বেঁচে যাবে। কতক্ষণ মনে নেই, তবে রিক্সা যখন মিছিল পেরিয়ে চলে এলো, ধড়ে যেনো প্রাণ ফিরে পেলাম। সেই উৎকন্ঠার কথা সেদিন আর কাউকে বলিনি।
তবে এখনও দূঃস্বপ্ন দেখি, আমদের টিভিটা নিয়ে রিক্সা এগিয়ে চলছে, হঠাৎ মাথায় কাপড় বাঁধা কারা এসে যেন রিক্সাটা উল্টে দিলো। কি সাংঘাতিক!! ঘুমের মধ্যে আমার তখন ইচ্ছে হয় সবকিছু ভেঙে ফেলি, একটা বোবা আক্রোশ অনুভব করি।
আমি ভেবে কূলকিনারা করতে পারিনা, সত্যিই এমনটা হলে কি হতো! একটা পরিবারের একটা বিরাট স্বপ্ন ভেঙে যেতো। একজোড়া বাবা-মা চিরজীবনের জন্য নিজেদের অসহায় মনে করতেন। তাঁরা কি আবার টাকাজমানোর প্রজেক্ট শুরু করার সাহস পেতেন? আমরা ভাইবোনেরা কি আর কোনদিন সেভাবে হাসতে পারতাম?
সামান্য, ছোট্ট একটা টিভি! এটাকে ঘিরেই কি পরিমাণ আবেগ সেদিন মতিঝিল কলোনীর ছোট্ট সেই বাসাটায় ছিলো-- এটা কি কেউ ভাবতে পারে?
আর সেখানে যখন একজন বাবা অনেকদিন ধরে তিলেতিলে গড়ে তোলা ব্যবসার সুফল হিসেবে ছেলেটাকে বলে, "শোন রূপম, কাল আমরা গাড়ী কিনতে যাবো", অথবা মাকে চমকে দেয়ার জন্য বারান্দায় টেনে এনে যখন বাসার সামনে পার্ক করা গাড়ীটা দেখাতে দেখাতে ছেলেটা শোনে মা কান্নাজড়িত কন্ঠে বলছেন, "এবার একটা বিয়ে কর বাবা" -- মুহূর্তগুলো সেই মানুষগুলোর কাছে কত দামী সেটা কি বলে বোঝানো যায় না যাবে?
২.
রাস্তায় একটা গাড়ী দেখলে, "শালার বড়লোকের গুষ্টি মারি" বলে সেটাকে পুড়িয়ে দেয়া, ভেঙে ফেলা -- এসব করাই যায়। "একটা গাড়ী ভাঙা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের অসহায় প্রতিবাদ" অথবা, "বুর্জোয়া শাসক আর শোষকগোষ্ঠীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ানো মজলুমের প্রতিশোধ" -- এমন অনেক গালভরা বাণী দিয়ে আমরা রাজনৈতিক মঞ্চ কাঁপাতেই পারি।
কিন্তু একটা টিভি মানেই ষোলহাজার নয়শ আশি টাকায় কেনা একটা প্লাস্টিকের বাক্স না, একটা গাড়ী মানেই কয়েক লাখ টাকায় কেনা একটা পুঁজিবাদী প্রতিক না; এসব একেকটা বস্তু অনেক আবেগ, অনেক ভালোবাসা, অনেক প্রতীক্ষা আর অনেক সংগ্রামের চিহ্ন বহন করে।
একটা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যখন এই সামান্য সত্যটাকে বুঝতে অপারগ হয়, তখন আমি হতাশ হই, সবচেয়ে হতাশ হই সেদেশের ভবিষ্যত নিয়ে। এই ছাত্রদের কাছে আমরা কি আশা করবো! এরাই তো আবার একদিন নেতাও হবে। তারা যখন তারেক রহমানের মতো একজন অপরাধীর মুক্তির দাবীতে এরকম তান্ডব চালায়, তখন তাদের কাছে কি আশা করা যায়? তাদের নেতার উপর পুলিশী টর্চার চলছে -- এটার জন্য তারা প্রতিবাদ করতে পারে, মিছিল করতে পারে। আমরাও তারেক রহমানের উপর পুলিশের এই বাড়াবাড়ির নিন্দা করি। কিন্তু তারা যা করেছে, এই পাশবিকতাকে কিভাবে সহ্য করা যায়?
৩.
একটা গাড়ী বা একটা টিভি পোড়ানো দেখলেই আমি অসহায় বোধ করি।
সহ্য করতে পারিনা। আমার কৈশোরের সেই দূঃসহ স্মৃতি মনে পড়ে যায়।
সেখানে অসভ্য বর্বর ছাত্রনেতাদের লাগানো আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া একজন জাহাঙ্গীর আলমকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আমি অসহায় বোধ করি। কি হবে লিখে?
তাও অভিশাপ দিলাম খুনীদের।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।