ভালোবাসার ঊর্বশী বুকে লেখা আছে এক নাম- সে আমার দেশ, আলগ্ন সুন্দর ভূমি- বিমূর্ত অঙ্গনে প্রতিদিন প্রতিরাত জেগে ওঠে তার উদ্ভাসিত মুখ
টোঙ দোকানের চা। আহ্ কী মধুর, অমৃতের সমান! ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে দক্ষিণমুখী দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছেন আনিস সাহেব। লেকের ফুরফুরে হাওয়া এসে লাগছে চোখেমুখে। চল্লিশোর্ধ বয়স আনিস সাহেবের। মাথায় কাঁচাপাকা চুল।
তাও আবার অনেকাংশই ফাঁকা। লম্বা মুখের গড়ন, শ্যামলা গায়ের রং। হালকা পাতলা শরীর। বয়সের ছাপ পড়েনি তেমন। আনিস সাহেব প্রতিদিন বিকেলবেলা বের হন।
নিয়ম করে হাঁটেন ধানমণ্ডি লেকের পাড় ধরে।
খুব মনোযোগ দিয়ে চা খাচ্ছেন আনিস সাহেব। এক হাতে চায়ের কাপ, অন্য হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। সারাদিন শেষে এই চা তার কাছে প্রাণের সমান। কারণ ঘরের চায়ে তার মন ভরে না।
প্রতিদিন নিয়ম করে দু'বেলা দু'কাপ চা করে দেন গিন্নী। এক টুকরো ক্যান্ডেরাল ফেলে দেন তাতে। কৃত্রিম মিষ্টি বানানোর চেষ্টা। কারণ আনিস সাহেবের এখন চিনি, চিনিজাত খাবার নিষেধ। রক্তে শর্করার আধিক্য তার স্ত্রীকেই ভাবাচ্ছে বেশি, তাকে বোধ হয় নয়।
আনিস সাহেব চা খাচ্ছেন আর ভাবছেন। ছাত্রাবস্থায় কলেজ কেন্টিন, হোস্টেল কেন্টিনের চা খেয়েও মন ভরতো না তার। বিকেলবেলা হাঁটতে হাঁটতে যেতেন রেলস্টেশন কিংবা আঠারোবাড়ি বিল্ডিং। তাকে টানতো টোঙ দোকানের চা। এখনও মনে পড়ে মুকুলের চায়ের কথা।
বন্ধুরা মিলে প্রায় প্রতিদিনই খাওয়া হতো সেই চা। অমৃতের মতো অনেকক্ষণ জিভে লেগে থাকতো চায়ের স্বাদ। সবাই মিলে ময়মসিংহ শহরের অলিগলি চষে বেড়াতেন সারা বিকেল। জীবনের সেই মধুরতম দিনগুলো এখনও স্মৃতিতে অ¤ান তার।
মুকুলের দোকানের চা খেতে খেতেই তার সাথে দেখা হয়েছিলো শাহনাজের।
আনিস সাহেব তখন নিয়মিত সঙ্গীত বিদ্যালয়ে যান। চা শেষে ঢুকবেন সঙ্গীতের কাসে। এমন সময় একটি রিক্সা এসে থামলো। অপরূপা সুন্দরী এক কিশোরী রিক্সায় বসে আড়চোখে আনিস সাহেবের চা খাওয়া দেখছে। সেদিকে চেয়ে আনিস সাহেবের তো চোখ ছানাবড়া।
এমন সুন্দর গায়ের রং, শারীরিক গঠন সে কমই দেখেছে জীবনে। অথবা এমনও হতে পারে কিশোর বয়সে যাকে দেখে তাকেই ভালো লাগে। পরে জানা গেলো শাহনাজ সঙ্গীত বিদ্যালয়ে এসেছে গান শিখতে। আনিস সাহেবের মন তখন আনন্দে মাতোয়ারা। এই বুঝি পেয়ে গেছে সে সোনার হরিণ!
এরপরের গল্প সরল।
কিন্তু কাছাকাছি আসার সহজ পথও ছিলো না। মফস্বল শহরের আবহাওয়া। অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে তাকে। আনিস সাহেব ও শাহনাজ দুজনেই সঙ্গীতের শিক্ষার্থী, অনুরাগী। সঙ্গীতকে ভালোবেসে দুজনার ভালোলাগা, ভালোবাসা।
তাদের এই সম্পর্ক টিকে ছিলো একটানা আট বছর। কিন্তু আনিস সাহেব ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করলে শাহনাজের বিয়ে হয়ে যায় অন্যখানে। শাহনাজের গার্জিয়ান ফেল করা ছাত্রের সাথে মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না। আর ফাইনাল পাসের পর আনিস সাহেবও সে সম্পর্ক ব্রহ্মপুত্রে ভাসিয়ে দিয়ে ঢাকায় চলে আসেন পাকাপোক্তভাবে ।
উচ্চশিক্ষা শেষ হলো।
চাকরী জুটলো আনিস সাহেবের। কিন্তু টোঙ দোকানের চা খাওয়ার অভ্যাস আর বদলানো না। প্রথম পোস্টিং মাদারীপুরের কালকিনি। উপজেলার এমন কোনো টোঙ দোকান বাকি ছিলো না- তিন বছরের চাকরিজীবনে যেখানকার চা আনিস সাহেব খাননি। আর সে ক'বছরে হোন্ডা সিডি ৮০ সারাক্ষণই সঙ্গী ছিলো তার।
সুযোগ পেলেই গ্রামের পাড়ামহলার মোড়ে মোটর সাইকেল থামিয়ে তাতে আরাম করে বসে টোঙ দোকানের চা খেতেন। এমনি কতো বৃষ্টিভেজা দিনে মোটর সাইকেলে সহকর্মী মিসেস নীরুকে নিয়ে কতো ঘুরছেন তিনি। বৃষ্টিতে ভিজেছেন, টোঙ দোকানের চা খেয়েছেন। সেই শ্যামাঙ্গিনীর বৃষ্টিভেজা শরীরের ভাঁজ মনে হলে এখনও গায়ে শিহরণ দিয়ে ওঠে তার।
যখন পোস্টিং হলো ঢাকায় তখনও তার সে অভ্যাস গেলো না।
১৪ তলা বিল্ডিং-এর পরিপাটি কেন্টিনের চায়ে তার মন ভরতো না। সুযোগ পেলেই নেমে যেতেন নিচে রাস্তার ধারে। টোঙ দোকানের এক কাপ চা এক হাতে, আর অন্য হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। আহা, কী আরাম! যখন বাইরে ট্যুর-এ যেতে হতো আনিস সাহেবের মন তখন আনন্দে আত্মহারা হতো। মফস্বলে গিয়ে গ্রামের রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সেই পুরনো স্মৃতি রোমন্থন।
অফিসের গাড়ি থামিয়ে অচেনা স্থানে, অজানা মানুষের সাথে বসে টোঙ টোকানের চা খাওয়ার মজাই আলাদা। নতুন মুখ, নতুন দোকান, নতুন করে টোঙ দোকানের চায়ের স্বাদ।
এ সবকিছুই স্মৃতি আজ আনিস সাহেবের কাছে। এখন ধানমণ্ডির এই লেক তার শেষ আশ্রয়। টোঙ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে লেকের পানির বুদবুদ, মাছের সাঁতার দেখা, দখিনা বাতাস বুকে টেনে চা খাওয়া আর ভাবনায় ডুব দেয়া নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে তার।
এইমাত্র শেষ হলো হাতের চায়ের শেষ নির্যাসটুকু। লম্বা করে চুমুক দিয়ে দেখলেন সিগারেটও প্রায় শেষ। এখন তার হাঁটার পালা। দোকানীকে টাকা দিয়ে পথ ধরেন লেকের পাড় ঘেঁষে। ইটকাঠের এই শহরে লেকের পাড়ের এই জায়গাটুকু না থাকলে বোধ হয় আনিস সাহেবের দম বন্ধ হয়েই যেতো।
আনিস সাহেব হাঁটছেন আর ভাবছেন। এই বয়সেও ছাড়তে পারেননি সিগারেট। তবে সংখ্যায় অনেক কমে গেছে এখন। যে কনডেন্সড মিল্কের চা তিনি খান তাতেও আছে কিছুটা চিনি। দুটোই তার জন্য ক্ষতির কারণ।
তবে এই তিকর দু'টো জিনিসের টানেই লেকের পাড় ধরে হাঁটা নিয়মিত হয় তার। নেশার টানে হলেও প্রতিদিন বিকেলবেলা চলে আসেন ধানমণ্ডি লেকে।
একটানা পয়তাল্লিশ মিনিট নিয়ম করে হাঁটেন। ছোট্টবেলার গ্রামের সেই সবুজের মাঝে যেন হারিয়ে যান তিনি। সমস্ত বুক ভরে যায় মুক্ত বায়ুতে।
আর অতিরিক্ত ঘাম পুড়িয়ে দেয় দেহের বাড়তি শর্করা। ধীরে ধীরে হেঁটে তিনি ঘরে ফেরেন এক কান্ত অথচ হালকা, সতেজ শরীরে। অনাবিল প্রশান্তিতে ভরে যায় মনটা। আনিস সাহেব ভাবেন- কিছু কিছু নেশা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, সুস্থ কিছু করতে উদ্বুদ্ধও করে। কিছু নেশার সাথে জড়িয়ে থাকে কিছু অমর স্মৃতি- যা মানুষকে বাঁচার প্রেরণা জোগায়।
তার একটাই নেশা, টোঙ দোকানের চা। সাথে এক শলা সিগারেটের শেষ সুখটান!
১৫.০৫.২০০৮
©Sheikh Jalil
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।