শোষণ-লুণ্ঠন-অনুন্নয়ন থেকে সৃষ্ট দারিদ্র্য আর বঞ্চনা বাড়ছে, সাধারণ মেহনতি মানুষ ভালো নেইঃ
দেশের ও দেশের মানুষের বিষন্ন ছবি দেখতে আর ভালো লাগে না। ভালো না লাগলেও অনেক সময় তাই দেখতে হয়। এ যেন অনিবার্য পরিণতি। পত্রিকায়ই লেখা হচ্ছে দেশে দিন দিনই দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। গত সোয়া বছরে দারিদ্র্যসীমার নীচে নেমেছে আড়াই লাখ মানুষ।
এর অন্যতম কারণ কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হওয়া ও বিনিয়োগে মন্দা পরিস্থিতি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে আরো বাড়িয়ে তুলছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে কর্মহীন বেকার মানুষের সংখ্যা। পৃথিবী যখন রমরমা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প বিকশিত, অলিম্পিক, উৎসব-আনন্দে যখন পৃথিবীর মানুষ আত্মহারা, তখনো আমরা সেই দুঃখ-দেশি বিদেশি শোষণ-লুণ্ঠন, অনুন্নয়ন আর দারিদ্র্যের নিত্য-পীড়নের মধ্যেই বেঁচে আছি। ঘুরে-ফিরে সেই একই চিত্র, একই প্যাঁচালি।
মেহনতি মানুষের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। এটা তো ঠিকই বিদ্যমান সমাজে সকল শ্রেণীর মানুষের একইরকমভাবে দিন ভালো যায় না। যদিও শোষক-লুটেরা দুর্নীতিবাজ যারা সংখ্যায় দু'চারজন, তাদের দিন ভালো যায়। কিন্তু যারা দেশ চালান তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মেহনতি সাধারণ মানুষের কথা মনে রাখেন না। অতো সময় তাদের কোথায়? গণতান্ত্রিক সমাজে সাধারণ মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধানই কিন্তু বড়ো কথা।
দেশে সুদিন-দুর্দিন নির্ভর করে মানুষের অবস্থার ওপর। অর্থনৈতিক শোষণ-লুণ্ঠন-অনুন্নয়ন আর বঞ্চনার চাপে মানুষ বিপর্যস্ত। তার শ্বাস ফেলার উপায় নেই। দাম বাড়ছে, ভাড়া বাড়ছে, কর বাড়ছে। বাড়ছে না শুধু মানুষের সুযোগ-সুবিধা, তার মাথার ওপর শুধু বাড়ার বোঝা, চাল, ডাল, আটা, তেল, মরিচ, পেঁয়াজ, গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি।
এই মানুষ কি ভালো থাকে, না ভালো থাকতে পারে? সরকার কর নেয়, ঘরবাড়ির কর, জমি-জমার কর, সঞ্চয় বা আমানতের ওপর কর, কিন্তু মানুষের সুযোগ-সুবিধা বাড়ে না। মানুষ বঞ্চিত হয় নাগরিক সুবিধা থেকে, সার্ভিস বা সেবা থেকে। এই অবস্থায় মানুষ ভালো থাকতে পারে না, ভালো থাকে না। উন্নত দেশে উন্নত সমাজে সবার আগে কিন্তু নিশ্চিত করতে হয় মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। আমাদের দেশে যারাই সরকার চালান তারাই এই প্রধান ও প্রাথমিক দায়িত্ব ভুলে যান।
আর সবই হয়তো হয়, শুধু হয় না সাধারণ মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা। এখানে তাই দুঃখ-কষ্ট, দুর্ভোগ-দুর্দশা, অভাব-অনটন-দারিদ্র্য বৃদ্ধি অস্বাভাবিক হলেও, এটাই যেন স্বাভাবিক! যেন কিছুই হয় নি।
বাজারে সবকিছুই অগ্নিমূল্য। মনে হয় দাম বাড়া-কমা নিয়েও এখন আর সরকার মাথা ঘামায় না। চালের কেজি চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ টাকা তো সরকারের একরকম গা-সওয়া হয়ে গেলেও, সাধারণ মানুষের কিন্তু একেবারে অসহ্য।
গাড়ি চলছে, বাস চলছে, সভা হচ্ছে, সেমিনার হচ্ছে, বক্তৃতা-বিবৃতি হচ্ছে, কোনো কিছুই থেমে নেই, তাতে কিছুই থেমে থাকার নয়। শুধু থেমে থাকছে গরিবের চুলো, এক বেলার বেশি দুই বেলা জ্বলছে না। শোষণ-লুণ্ঠন-অনুন্নয়ন থেকে সৃষ্ট দারিদ্র্য আর অভাব ঘিরে ধরছে তাকে, সহায়-সম্বল হারিয়ে পথে বসছে, উন্মুল-উদ্বাস্তু হচ্ছে। এই চিত্র কোনো সুখ বা আনন্দের চিত্র নয়। দুর্ভাগ্যবশত যখন যারাই দেশ চালান এই সত্যটি উপলব্ধি করতে চান না।
নিজেদের মতো করেই দেশি বিদেশি লুটেরা শোষকদের স্বার্থ রক্ষা করেন ও ভাবেন।
মূল্যবৃদ্ধি বিশেষ করে খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধি এখন সারা পৃথিবীরই বাস্তবতা। কিন্তু আকাশপথে মাত্র আধঘণ্টা দূরত্বের কলকাতা শহরেও আমাদের চেয়ে অর্ধেক দামে মানুষ চাল কিনতে পারে। আমাদের এই দুরবস্থার কথা স্বীকার করা ভালো। এই অবস্থা মানুষের জন্য কোনো সুদিন নয়।
তবে অবস্থা যেমনই হোক, মানুষের যতো দুঃখ-কষ্টই হোক মানুষ সবসময়ই সুদিনের আশা করে। এভাবেই বেঁচে থাকে মানুষ। আজ যেন সে আশাটাও করতে পারছে না মানুষ। সে পদে-পদে মার খাচ্ছে, বিপন্ন ও বিধ্বস্ত হচ্ছে। এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতিই হচ্ছে দেশের বাস্তবতা।
দেশে সবকিছুর ওপরে গুরুত্ব দেওয়া দরকার মানুষের আর্থিক জীবন, তার আয়-ব্যয়, তার জীবিকা, তার কর্মসংস্থান। কোনো অবস্থাতেই এমন কিছু করা ঠিক নয় যাতে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক জীবন ভেঙে যায়, এই বেকার সমস্যার দেশে আরো বেকার হয়। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবে না কেন? বেকার সৃষ্টির ব্যবস্থা চাই না। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা সংকুচিত হলে বেকার সমস্যা সৃষ্টি হতে বাধ্য। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হলে, কল-কারখানা থেমে থাকলে মানুষের কাজের সংস্থান হবে কীভাবে? এ বড়ো জটিল প্রক্রিয়া।
শিল্পায়নের স্বাভাবিকতা রুদ্ধ হলে দেশে দারিদ্র্য বৃদ্ধির সম্ভাবনাই বাড়বে। হয়েছেও তাই। জাতীয় পুঁজি গড়ে না উঠলে শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য হবে কীভাবে, কর্মসংস্থানই বা কীভাবে হবে?
একটি জাতীয় দৈনিকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা, কর্মসংস্থান নেই, নতুন বিনিয়োগ বন্ধ। এটা দেশের কোনো ভালো চিত্র নয়। অর্থ-বিত্ত, পুঁজির বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হলে, পুঁজি বা অর্থের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ আরো সংকুচিত হবে।
অর্থ বা পুঁজি ছাড়া দারিদ্র্য দূর হবে কীভাবে? আমাদের উদ্দেশ্য কি অর্থ বাড়ানো না দারিদ্র্য বাড়ানো? নিশ্চয়ই আমরা মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি অর্থাৎ সমাজের অর্থসম্পদ বৃদ্ধি বন্ধ করে দরিদ্রের সংখ্যা বাড়াতে চাই না। অর্থ বা পুঁজির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া কিংবা কথা বলার অর্থ কি তাহলে এই দাঁড়ায় না যে, দেশের সব মানুষই গরিব হয়ে থাকবে? তাতে লাভটা কী হবে। দারিদ্র্য ভাগ করলে ফল হবে আরো দারিদ্র্য, দারিদ্র্যের বিস্তার। সরকারের অর্থনৈতিক নীতিমালার মধ্যে এ বিষয়গুলো স্পষ্ট হওয়া দরকার।
পুঁজি গঠন, পুঁজির ব্যবস্থা, দেশীয় পুঁজির বিনিয়োগ এখন দেশের বড়ো প্রয়োজন।
পুঁজি ছাড়া শিল্প-কারখানা দূরের কথা কৃষি বা কৃষি উৎপাদনও হবে না। আমাদের দেশে অর্থ বা পুঁজিই বড়ো সমস্যা। সুতরাং পুঁজি তথা পুঁজির বিকাশকে নিরুৎসাহিত করার অর্থ প্রকারান্তরে দারিদ্র্যাবস্থাকেই টিকিয়ে রাখা বা আরো সম্প্রসারিত করা। মানুষ এই হতাশার কথা আর শুনতে চায় না। ভালো দেখতে চায়, সুদিনের প্রত্যাশা করে।
এ যুগে সর্বত্র তাই হচ্ছে। উন্নতি, উন্নয়ন, সমৃদ্ধি। কেউ পেছনে পড়ে থাকতে চায় না। ভাগ্য ফেরাতে চায়। সরকার শোষন-লুণ্ঠনমূলক ব্যবস্থাকে আঁকড়ে পড়ে থাকলে তাতে হয়তো সরকারের কারো কিছু এসে যাবে না।
পৃথিবী এগিয়ে যাবে, এগিয়ে যাচ্ছে।
বলতে বাধ্য হচ্ছি দেশে দারিদ্র্য বৃদ্ধির সংবাদ তাই কারো জন্যই সুখের কথা নয়। দেশে দারিদ্র্য বৃদ্ধি দেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের প্রচারিত ঘোষণাকেই যে নগণ্য করে দেয় তাও বোধকরি অস্বীকার করার উপায় নেই। সরকারের দায়িত্ব সাধারণ মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করা। তার মধ্যেই তাদের কাজের সার্থকতা বা কৃতিত্ব।
না হলে বড়ো বড়ো কাজ, বড়ো বড়ো কথা বিশেষ কোনো মূল্য দেবে না। মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যই যদি নিশ্চিত না হলো, মানুষের জীবন-ধারণই যদি এমন দুঃসহ হয়ে উঠলো, তাহলে এতো কিছুর মূল্য কী, মূল্য কোথায়? বলতেই হয় দেশের বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের দিন ভালো যাচ্ছে না, সুখে নেই তারা কেউ। তাহলে সরকারেরইবা সাফল্য ও কৃতিত্ব কোথায়? সময় খুব কম গেলো না, অনেক কাজের দায়িত্ব যারা মাথায় নিয়েছেন, তাদের এখন শান্ত মাথায় এ কথাগুলোও ভাবতে হবে। জনগণের কাছে সবারই সবকিছুর হিসেব দিতে হয়, জবাব দিতে হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দেশি বিদেশি লুটেরা শোষক ও শাসকশ্রেণীকে ক্ষমা করবে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।