আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছো বসি আমার ব্লগখানি কৌতুহল ভরে
প্রথমটির নাম ফেল্পস , দ্বিতীয়টির নাম বোল্ট ।
নক্ষত্রযুগলের প্রথমটির আলো বিশ্ব প্রথম দেখেছিল যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর, ১৯৮৫ সালে । দ্বিতীয় জনার জন্য পৃথিবী অপেক্ষা করতে হলো আরও একটি বছর। ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের জ্যামাইকা দ্বীপের ট্রেলনি শহরতলী উপহার দিল নক্ষত্রজোড়ার পরেরটির ।
তারপর নতুন শতাব্দী তার অষ্টম বর্ষে প্রাচ্যের বেইজিংয়ে বসালো সারা বিশ্বের অ্যাথলেটদের মহামিলন মেলা ।
তাদের একজনের শক্তি আসল চিকেন নাগেটস আর ইয়াম থেকে । অপরজনের পেশী গড়ে তুললো ফ্রায়েড চিকেন ,এক্সট্রা মায়োনেজ যুক্ত চিজ স্যান্ডউইচ ।
বেইজিংয়ে তারা এসেছিলেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে তারকা হয়ে । কিন্তু শতাব্দীর অষ্টম বর্ষের আগস্ট মাসের দু'টি সপ্তাহ তারকাযুগল যে আলো ছড়ালো তাতে ম্লান হয়ে গেল শত নক্ষত্র।
লোকে যখন বেইজিং ২০০৮ কে মনে রাখবে কেবল দু'তরুণের ভুবনজয়ী কীর্তির জন্য , তখন ২৮ টি ডিসিপ্লিনে ৩০২ টি পদকের জন্য প্রাণপণ লড়ে যাওয়া ১০,৭০৮ জন প্রতিযোগী নিজেদের বঞ্চিত ভাবলে খুব বেশি অপরাধ কি তাদের দিতে পারবেন ?
পাখির নীড়ে এমন কীর্তিগুলোর জন্যই যেন উসেইন বোল্টের জন্ম ।
বীরত্বের খেতাব অর্জনের জন্য শুধুমাত্র স্বর্ণপদকগুলোই যথেষ্ট ছিল । কিন্তু বীরদেরও যিনি বীর তিনি কেন একই পথে হাঁটবেন ?
উড়ন্ত দানব হয়ে যিনি চোখের নিমিষে ১০০ আর ২০০ মিটার দূরত্ব অতিক্রম , উদযাপনের অভিনবত্ব , তার চোখের দীপ্তি আর অজানার উদ্দ্যেশ্যে তীর ছুঁড়ে দেয়ার ভঙ্গি জানিয়ে দিল "এমন আলোর ঝলকানি অ্যাথলেটিকস কখনো দেখেনি"
চোখটা যদি একটু ওয়াটার কিউবে দিকে ফেরান , সেখানে দেখবেন ইতিহাস আর বিজ্ঞানের কলাকৌশলগুলো আরও একজন বীরের পদতলে লুটিয়ে পড়েছে .......তিনিই ফেল্পস , মাইকেল ফেল্পস ।
ওয়াটার কিউবে সাতটি বিশ্বরেকর্ড আর আটটি সোনাজয়ের যে উৎসব হলো , তার প্রতিটি যেন আগেরটিকে জৌলুসে ছাড়িয়ে গেলো । ৪*১০০ মিটার রিলেতে অবিশ্বাস্যভাবে ফিরে আসা , কিংবা ২০০ মিটার ব্যক্তিগত মেডলেতে জয়ের ব্যবধান অথবা ১০০ মিটার বাটারফ্লাইতে সার্বিয়ান তরুণ মিলো ক্যাভিচের হাতের মুঠোয় চলে আসা স্বর্ণপদক আঙ্গুলের জাদুতে কেড়ে নেয়া , সব মিলিয়ে বেইজিংকে কি স্বপ্নের ঘোরেই না রাখলেন ফেল্পস
কি সর্বগ্রাসী তার ছায়ায় , যার নিচে ঢাকা পড়লো বেইজিং । কোথেকে যেন দাবী উঠলো , ইনি একবচনে ফেলপস হতে পারেন না , ৮ জন এক বচনীয় মাইকেল ফেলপ(phelp) এর সমন্বয়ে লড়ছেন ১ জন বহুবচনীয় মাইকেল ফেল্পস(phelps) , যিনি পরিণত হয়েছেন শ্রান্তিহীন সাঁতার কলে
ব্রিটেনের তরুণ তুর্কীরা নতুন করে লিখলেন শতবর্ষের ব্রিটিশ অলিম্পিক ইতিহাস ।
অগ্রভাগে নেতৃত্ব দিলেন ক্রিস হয় । ইনিই সেই , যিনি অলিম্পিক শুরুর আগে বলেছিলেন , তার পেশীবহুল পায়ের গঠন , অলিম্পিক ভিলেজে সবার ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে । স্কটল্যান্ডের সর্বকালের সেরা এ সাইক্লিস্টের পায়ে লুটিয়ে পড়লো বেইজিংয়ের ভেলোড্রোম , ১০০ বছরের মাঝে প্রথম ব্রিটিশ হিসেবে তিনি জয় করলেন তিনটি সোনা ।
১৯৬২ সালের পর ব্রিটেনকে স্বর্ণপদক এনে দেয়া প্রথম মহিলা সাঁতারু রেবেকা আডলিংটনকে কি লন্ডন ২০১২ কি পারবে আবার বরণ করতে ? আডলিংটন , উইগিনস বা বেন আইনসলে দের কল্যাণে মঞ্চে বারবার বেজে উঠা "গড সেভ দ্যা কুইন" , লন্ডন ২০১২ তে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়ার ইংগিতই কি দিয়ে যায় না?
বার্ডসে নেস্ট এবার যে শুধু হেসেছে তা নয় , দু'চোখ ভাসিয়ে কান্নাও সে কাঁদলো । গোল্ডেন বয় হার্ডলার লিউ জিয়াং যখন পা টেনে টেনে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলেন ,চীনের ১৩০ কোটি মানুষের কার চোখ ভেজেনি ?
ভারোত্তলন , ডাইভিং , শ্যুটিং , টেবিল টেনিসে , জিমন্যাস্টিকস এবং ব্যাডমিন্টন এর মত ৬ টি ইভেন্ট চীনকে দু'হাত ভরে দিয়েছে ।
অ্যাথলেটিকসের নক্ষত্র লিউ জিয়াংয়ের অনুপস্থিতিতে শত কোটি মানুষের মুখে বারবার হাসিয়ে ফুটিয়েছেন এই বীরেরা ।
গো জোংঝিং কে বেইজিং দিলো সর্বকালের সেরা মহিলা ডাইভারের সম্মান । শেষ সুর বেজে উঠার আগেই অলিম্পিক বক্সিং রিংয়ে ইতিহাসের প্রথমবারের মত বাজলো চীনের জাতীয় সংগীত , খানিক পর যখন দ্বিতীয়বার একই সংগী্ত শোনা গেল , তখন বলতেই হলো , বেইজিং চীনকে দেয়া তার কথা রেখেছে ।
পূর্ববর্তী তিনবারের শীর্ষস্থান অধিকারী যুক্তরাষ্ট্রের ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড বিপর্যয় , শীর্ষস্থানচ্যুতির সান্ত্বনাগুলো আসলো দলগত ইভেন্ট থেকে । ফুটবল , ভলিবল , বাস্কেটবলের সোনাগুলো নিজের করে নিতে তারা ভুলেনি ।
জ্যামাইকানদের সময়ভেদী দৌড়ের সমীকরণের ফলাফলে যুক্তরাষ্ট্রকে হারাতে হলো স্প্রিন্টের ৬ টি সোনার সবক'টি । ১৯৮০ সালে অলিম্পিক বয়কটের পর ট্র্যাকে যুক্তরাষ্ট্রকে ভাগ্যাহত হতে হয়নি ।
বেইজিং আসর যদি একটি বৃত্ত হয় , তাহলে তার শেষ প্রান্তে আপনি পাবেন , আফগানিস্তানের হয়ে প্রথমবারের মত পদকজয়ী রুহুল্লাহ নিকপাই কে । ৫৮ কেজি ওজনশ্রেণীতে ব্রোঞ্জ জিতে সংবাদমাধ্যমে
কি আলোচিত চরিত্রেই না পরিণত হলেন তিনি । ভারতের অভিনব বিন্দ্রা জয় করলেন ১০ মিটার এয়ার রাইফেল ইভেন্ট স্বর্ণপদক ।
ভারতের পক্ষে প্রথমবারের মত ব্যক্তিগত এই স্বর্ণজয়ের কীর্তির ঢেউ কি আসিফের শোক হয়ে বাংলাদেশে এসেও লাগেনি ? অনেক ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে হলেও অলিম্পিক দেখলো ইরাকের মার্চ পাস্ট ।
অলিম্পিকে অবস্থান দর্শক এবং অ্যাথলেটদের বিশ্বজনীন পার্টি হাউজে উৎসবের আমেজ এনে দিয়েছিল , যার প্রতিটি কক্ষ যেন অন্যটি থেকে সেরা । বক্সিং রিংয়ে যখন উত্তেজনাকর বক্সিং বাউট চলছে , ঠিক তখনও হয়তো ওয়াটার কিউব স্বাক্ষী হচ্ছে নতুন কোন বিশ্ব রেকর্ডের । ভেলোড্রোমে আপনি মাত্র বসেছেন , হয়তো শুনছেন শুনোই লেকে ক্যানো-কায়াকের ধুন্ধুমার লড়াইয়ের খবর ।
অ্যাথলেটিক্সের উত্তেজনার ফাঁকে টিভিতে হয়তো চোখ বুলিয়ে নিয়েছেন হ্যান্ডবলে ফ্রান্স আইসল্যান্ডের জয়যাত্রার দিকে ।
অথবা মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখেছেন নতুন অন্তর্ভূক্ত ওপেন ওয়াটার সুইমিং ইভেন্ট । ডাইভিং , বা টেবিল টেনিসের মত পুরনো ইভেন্টগুলো যেন পেল নব জীবন ।
যেখানেই যাবেন সদা হাস্যোজ্জ্বল স্বেচ্ছাসেবক দল আপনাকে স্বাগত জানিয়েছে । ভ্যেনুগুলোর মাঝে ও ছিল বৈচিত্র , পাখির নীড়ের মত বার্ডস নেস্ট , বরফ কুচিতে বানানো ওয়াটার কিউব , কিংবা ডিম্বাকার ভেলোড্রোম অথবা পাথুরে প্রাসাদসম ওয়ার্কার্স জিমনেসিয়াম ।
ছন্দবদ্ধ নিয়ম মেনে চলা হাত তালি শুনতে হয়তো গিয়েছেন টেনিস সেন্টার , আর উন্মাতাল দর্শকদের হর্ষধ্বনি শুনতে গিয়েছেন পিকিং ইউনিভার্সিটি জিমনেসিয়ামে , চীনা টেবিল টেনিস খেলোয়াড়দের প্রতিটি সার্ভে যেটি হয়েছে প্রকম্পিত
পরিবেশ দূষন সংক্রান্ত উত্তেজনা মিইয়ে গেছে সবুজ বেইজিংয়ে , দু'দিনের ঝড়ো বৃষ্টিও এসেছিল আশীর্বাদ হয়ে ।
মাত্র ৫ জন অ্যাথলেট ডোপ পাপী প্রমাণিত হয়েছেন , বেইজিং পেয়েছে নিষ্কলুষ আয়োজনের কৃতিত্ব ।
বেইজিং অনেক ভাবে অনেকের অশ্রু ঝরিয়েছে । মাত্র একবছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় হারানো স্ত্রীর ছবি বুকে চেপে মঞ্চে উঠা জার্মানীর ভারোত্তলক ম্যাথিয়াস স্টেইনারের বাঁধ ভাঙা চোখের জল কি বেইজিং ভুলতে পারবে ?ছোট্ট বয়সে বাবাকে হারিয়ে ফেলা গোল্ডেন জিমন্যাস্ট লিউ মিং যখন ভারী গলায় বাবাকে ফিরে পেতে চায় , তখন কি আপনার গলা ধরে আসেনি ?
জর্জিয়ার নিনো সালুকভাদজে আর প্রতিদ্বন্দ্বী রুশ নাতালিয়া পাদেরিনা যখন হাতে হাত রেখে মঞ্চে উঠেন , তখন কি বেইজিং ককেশিয় অঞ্চলে একটুও শান্তির বার্তা শোনায় না ?
তার মাঝেও দু'একটি দুর্ভাগ্য থেকেই যায় , যখন কিউবার সাবেক তায়কোয়ান্দো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফলাফল না মানতে পেরে রেফারীর উপর চড়াও হন ।
আবার ডেনমার্কের ইয়ট ভেঙ্গে যাবার পর ক্রোয়েশিয়া যখন তাদের ইয়ট ধার দিয়ে এগিয়ে আসে , ডেনমার্ক পদক জয়ের খবরের আগে বেইজিংয়ের ভাতৃত্বের বাণী শুনিয়ে যায় ।
কোন সফল উৎসব শেষে থাকে ক্লান্তির ছোঁয়া , খানিক অবসাদ , নস্টালজিয়া , দু'এক ফোটা অশ্রু , কখনো বা আনন্দের , কখনো বা বিষাদের ।
যখনই মনে হয় , বার্ডসে নেস্টে পাখি শিকারী উসেইন বোল্টের ধনুকে তীর সঁপে দেখবার দৃশ্য দেখতে লন্ডন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে , আনমনে বলে উঠি..............
"অনেক দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর আগামী চারটি বছর"
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।