বাসায় কলিং বেল দিতেই ও এসে দরজা খুলল। ওর খোঁজ পাই আমাদের থানার টেলিফোন এক্সেঞ্জের অপারেটরের মাধ্যমে। সেই থেকে ও আমাদের বাসায় থাকত। বছর তিনেক ছিলও আমাদের সাথে। লেখা পড়া একটু আধটু জানত।
বাসায় সকালে পেপার আসলে প্রথম ওই পড়ত। তবে বড় বড় অক্ষরে লেখা শুধু হেডলাইন টুকু। খালেদা জিয়া অথবা শেখ হাসিনার ছবি দেখে বুঝত তারা কিছু বলেছেন। ওর নাম রূপালী। দেখতে ঠিক যেন মা কালী।
গায়ের রং কালো হওয়াতে ওকে আমি সব সময় হালকা রংয়ের ড্রেস কিনে দিতাম। এ নিয়ে ওর অভিযোগের শেষ ছিল না। ও আমার মায়ের বেশ যত্ন করত। এজন্য আমি ওর প্রতি বিশেষ নজর রাখতাম। এক রাতে আমি ওকে অন্য এক মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করি।
ওই রাতেই আমি সিদ্ধান্ত নেই রূপালী যত দিন আমাদের বাসায় থাকবে ততদিন আমি যে ড্রেস পরি সমমুল্যের ড্রেস আমি ওকেও কিনে দিব। কিন্তু ভাবাই যা। হঠাৎ হঠাৎ করে ওর প্রতি আমাদের সবার খবরদারীটা বেড়ে যেত। বুঝতে পারি, আসলে রূপালীকে আমরা কাজের বিনিময়ে ভালবাসি। যদিও অধিকাংশ সময় ভাবতাম ওতো আমার মতই একটা মানুষ, ওকে আলাদা করে দেখা ঠিক নয়।
তবূও কোথায় যেন একটা গোঁজামিল দিয়ে যাচ্ছিলাম। মনে একটা ভাবা আর বাস্তবে অন্যটা করা এটিই মনে হয় আমাদের মত মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেনীর একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
সেই রূপালী ই এসেছে আমাদের বাসায় স্বামীকে নিয়ে। রূপালী পরেছে লাল চওড়া পাড়ের টাঙ্গাইলের শাড়ি- যা বিয়ের আগে আমরা দিয়েছিলাম। স্বামীর পাশে ওকে ভালই লাগছে।
জানতে চাইলাম তোর স্বামীর নাম কি? রূপালি মুখ টিপে হাসে, দৌড় দিয়ে গিয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে পেন্সিল আর একটুকরা কাগজ এনে লিখল সে, মুজাম্মেল। বললাম মুজাম্মেল কে? ও লজ্জায় মাথা নিচু করে হাত দিয়ে ইসারা করে দেখায়ে বলল, তার নাম।
বুঝলাম স্বামীর নাম মুখে নিতে মানা এরকম একটা নিয়ম চালু ছিল প্রায় গত দশক পর্যন্ত। আজকাল অবশ্য ওই নিময়টি কেউ আর মানে না। কিন্তু এটি বাস্তব যে কিছু দিন আগে এটিই ছিল নিয়ম।
স্বামীর নাম এমন কি ভাশুরের নামের সামে মিল আছে এমন কোন শব্দই সরাসরি কেউ উচ্চারণ করত না। আমার বড় দাদার নাম চাঁন মিয়া হওয়ায় আমার দাদী কখনও চাঁদ বলত না, বলত শলক (আলো)। একবার দাদী ভোট কেন্দ্রে গিয়েছিলেন ভোট দিতে। পিজাইডিং অফিসার তার স্বামীর নাম জানতে চাইলে বলেছিলেন শহীদ জানে। শহীদ আমার বড় ভাই।
এ নিয়ে একটা গল্প শুনেছিলাম, আমার এক কলেজ ম্যাডামের কাছে। 'সন্ধ্যায় বাড়ির বউ ধর্মীয় উপাসনা শেষে কীর্তন করছে। কীর্তনে কৃষ্ঞ এবং রামের নাম নিতে হয়। বলতে হয়, হরে কৃষ্ঞ হরে কৃষ্ঞ কৃষ্ঞ কৃষ্ঞ হরে হরে, হরে হরে রাম, রাম রাম হরে হরে। ওই বউটির স্বামীর নাম ছিল রামকৃষ্ঞ দাশ।
ফলে কীর্তন করতে গেলে স্বামীর নাম নিতে হয় বলে বউটি কথাগুলো পাল্টে সুর করে গাইছিল, হরে উনি, হরে উনি, উনি উনি হরে হরে তিনি তিনি তিনি হরে হরে। ' এটা নিছক একটা গল্প। কিন্তু গল্প হলেও এটা ঠিক যে কুসংস্কার আমাদের এতো চেপে বসত যে ধর্মী উপাসনার কথাগুলোও পাল্টে ফেলতে বাধ্য হত। কিন্তু আজ এ যুগে রুপালীকে কে বুঝাবে এটা একটা কুসংস্কার। স্বামীর নাম মুখে নেওয়া পাপ নয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।