"পসার বিকিয়ে চলি জগৎ ফুটপাতে, সন্ধ্যাকালে ফিরে আসি প্রিয়ার মালা হাতে"
নীরবতা, ধ্যান ও মেডিটেশন (পুনঃ প্রকাশ)
নীরবতা এক অমূল্য সম্পদ। মানুষের সকল শান্তি ও প্রশান্তির মধ্যেই রয়েছে নীরবতার গভীর ও প্রত্যক্ষ প্রভাব। আদিকাল থেকে মানুষ নীরবতার সাথে সখ্যতা করে আসছে। নীরবতা চলমান জীবন প্রবাহের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। দেহ, মন ও মস্তিষ্কের বিশ্রামের জন্য নীরবতার কোন বিকল্প নেই।
নিজের মন ও ইন্দ্রিয়ের শান্তির জন্য কিছু সময়ের জন্য হলেও নীরবতা আবশ্যক। শব্দমুখর পরিবেশ মানুষকে বেশীক্ষণ স্বস্তি দিতে পারে না। নীরবতার উন্নত ও পরিশীলিত রূপ হচ্ছে ধ্যান । ধ্যানের আরেকটি আধুনিক সংস্করণ হচ্ছে মেডিটেশনে। ধ্যান, মেডিটেশন, নীরবতা বা মৌনতা সবই মানুষের মনোসংযোগ ও আত্মনিয়ন্ত্রনের বিভিন্ন কৌশল মাত্র।
এগুলো চর্চা, অনুশীলন ও প্রয়োগের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি, প্রক্রিয়া ও ব্যাখ্যা। নীরবতা, ধ্যান বা মেডিটেশন মানুষের মন ও মননের উৎকর্ষতা সাধন করে এ বিষয়ে অনেকের আছে বিশ্বাস, আস্থা ও নির্ভশীলতা। আবার অনেকের আছে, অবিশ্বাস, অনাস্থা ও কুসংস্কার। আছে মতবিরোধ, আছে অবজ্ঞা এবং ব্যপক আলোচনা ও সমালোচনা।
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ আত্মাসচেতনতা ও মনোসংযোগ বৃদ্ধির জন্য ধ্যান বা মেডিটেশনকে বিশেষ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।
ইদানিংকালে “সিলভা মেথড”, “কোয়ান্টাম মেথড”, “আর্ট অফ লিভিং”, “যোগাসন”, “প্রাণায়ন” ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষ তার মন ও মস্তিষ্কের বিক্ষিপ্ত চিন্তা ও চেতনাকে নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনকে আরও সুসংহত ও সুশৃঙ্খল করার অনুপ্রেরণা পাচ্ছে। যা মূলতঃ এক ধরণের মেডিটেশন। আজকাল আত্ম উন্নয়নের স্বীকৃত, পরীক্ষিত ও বিজ্ঞানসম্মত পথ হিসেবে মেডিটেশনকে বিবেচনা করা হচ্ছে।
অনেক মহাসাধক ও মহাপুরুষ ঐশ্বরিক জ্ঞানলাভ ও ঈশ্বরের নৈকট্য লাভের জন্য ধ্যান করতেন। মুনি-ঋষি, সাধু-ফকির, আউলিয়া-দরবেশ, পীর-পয়গম্বর অনেকেই নিজের গোত্রের ও আপামর মানুষের মঙ্গলের জন্য বনে-জঙ্গলে, পাহাড়-পর্বতের গুহায় কিংবা নির্জন স্থানে ধ্যানমগ্ন হতেন।
আত্মার মুক্তি, ঈশ্বর চিন্তা ও মানব কল্যাণই ছিল তাঁদের ধ্যানের মূল লক্ষ্য। কেউ কেউ আপন উদ্দেশ্য ও ইচ্ছা চরিতার্থ করার জন্যেও এই পথ বেছে নিয়েছিলেন।
ধ্যানে মগ্ন থাকা উচ্চ পর্যায়ের নীরবতাই হলো মেডিটেশন। ধ্যনের মূল উদ্দেশ্য মন ও মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ, বাস্তবতার খোলস ছেড়ে অপরবাস্তবকে উপলব্ধি করা। কেউ কেউ ধ্যনের মাধ্যমে সিদ্ধিলাভেরও চেষ্টা করেন।
কেউ আবার সৃষ্টি বা জীবনের রহস্য খুঁজতে থাকেন। যদিও ধ্যান, নীরবতা, মৌনতা ও মেডিটেশন সম্পূর্ণ এক জিনিষ নয় তাই এগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে গেলে আরও বেশী গবেষনা ও বিস্তারিত আলোচনা দাবী করে। আমি আমার লেখা ধ্যান ও নীরবতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। তাছাড়া এ বিষয়ে নিজের সম্যক জ্ঞানের দৈন্যতাও স্বীকার করে নিচ্ছি।
ধ্যান এক প্রকার মানসিক শক্তি যা মনের অন্তর্নিহীত ইচ্ছা ও ইন্দ্রিয়কে জয় করার ক্ষমতা রাখে।
ধ্যানের মাধ্যমে মানুষ মন ও মস্তিষ্কের সকল চিন্তা ও চেতনাকে দেহগত অবস্থান থেকে মনোজাগতিক বা কাল্পনিক অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে যার উদ্দ্যেশ্য প্রশান্তি লাভ। ধ্যান একপর্যায়ে দেহের যাবতীয় স্বাভাবিক অনুভূতিকে সাময়িকভাবে নিষ্ক্রিয় বা অচল করে দেয়। প্রকৃত ধ্যানমগ্ন মানুষ তার আহার, নিদ্রা, কাম, রিপু সবকিছু ভুলে অন্য এক জগতে চলে যায়। পক্ষান্তরে নীরবতা মানুষের ইন্দ্রিয়গত স্থিতিশীলতা ও মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। মস্তিষ্কের এলোমেলো চিন্তা, মনের বিক্ষিপ্ত ভাবনা ও কাল্পনিক জগতে বিচরণের প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রিত করে।
দীর্ঘ নীরবতা দেহ, মন ও আত্মার উপলদ্ধিগত শুদ্ধতা আনে, ক্লান্তি দূর করে।
নীরবতা নিঃসন্দেহে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যকীয় উপাদান যেমন বাতাস, পানি ও সূর্যের আলো। নীরবতা অদৃশ্যমান এক নিরেট বাস্তব যা সত্যিকার অর্থে পাশ কাটিয়ে যাওয়া অসম্ভব। নীরবতা আমাদের জীবনের সাথে এমনভাবে মিশে আছে যে সেটাকে আলাদা করে দেখার বা ভাববার বিষয় মাথাতেই আসেনা। নীরবতা এমন এক সক্ষ্ণ আর স্পর্শকাতর বিষয় যাকে বাদ দিয়ে আমাদের জীবন কখনও পূর্ণতা পায় না।
প্রতিনিয়ত আমরা শব্দদূষণের শিকার। নীরবতা আমাদের চারিপাশের শব্দদূষণ কমাতে সাহায্য করে। কথা বলার সময় যে এর মূল্য কত তা আমরা খুব ভাল করে বুঝতে পারি। আমরা সবাই যখন কথা বলি তখন কেউ কারও কথা শুনতে পারলেও বুঝতে পারি না। তাই কারও কথা বুঝতে হলে অন্য সবার নীরব থাকা প্রয়োজন।
নীরবতা আমাদের শিক্ষা দেয় কিভাবে কথা বলতে হয়, কখন থামতে হয়। কিভাবে কথা শুরু করতে হয়, শুরুর আগে কথা কিভাবে গোছাতে হয়। নীরবতা কথার ব্যাংক, প্রয়োজনে কথার যোগান দেয়। নীরবতা মানুষকে কথার গভীরে যেতে সাহায্য করে। সাহায্য করে অন্যের কথা বুঝতে এবং সেই কথার সঠিক জবাব দিতে।
একজন গানের ওস্তাদ রসিকতা করে তাঁর শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, "গলা সাধার আগে জানতে হবে কোথায় গলা ছাড়তে হবে। শুধু গান গাইলেই হবে না, জানতে হবে গানের কোথায় থামতে হবে- সেটা না জানলে গান হবেনা"। শান্ত ও নিরিবিলি পরিবেশ মানুষের চিরন্তন কাম্য। এমন নয় যে চারিদিকে পিন পতন শব্দের নীরবতা থাকতে হবে। তবে শান্ত শীতল দিঘীর জলের মতো নীরব নিথর পরিবেশ বিরাজ করুক এটা সকলেই চাইবে।
শুধু শব্দের বিচারে নীরবতাকে মূল্যায়ন করলে এর প্রকৃত ভাব বা ব্যঞ্জনাকে তাচ্ছিল্য করা হবে। নীরবতার নিজস্ব একটা আবেদন বা স্বত্ত্বা আছে আর তা হলো কথা বা বচনের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে বক্তৃতা বা বর্ণনাকে শ্রুতিমধুর করা। কথার মাঝে দম নেয়া এক ধরনের নীরবতা। হঠাৎ আচমকা কিছু একটা ঘটে গেলে নীরবতা আসে। কোন আপনজনের দুঃসংবাদ মানুষকে হঠাৎ নির্বাক বা নীরব করে দিতে পারে।
গল্পে, গানে, চলচিত্রে, প্রামান্যচিত্রে, নাটকে, আবৃত্তিতে, ছড়া, কবিতায় সর্বত্রই নীরবতার সরব উপস্থিতি। মূকাভিনয় বা 'মাইম' নীরবতার নান্দনিক উপস্থাপন। আলোকচিত্রে আলো-ছায়ার নীরব খেলা, চিত্রকলায় রং-তুলির নীরব ছোঁয়া, সবই নীরবতার বিমূর্ত উপস্থিতি। প্রকৃতি আর মানুষের মাঝেও অদৃশ্য এক নীরবতার নিবিড় বন্ধন ওয়েছে যাকে আমরা বলি 'ন্যাচারাল ইকো সিস্টেম'। বিশ্বব্রহ্মান্ড আর মহাকাশ জুড়েও রয়েছে অসীম নীরবতা।
চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্রের মাঝেও রয়েছে নীরব পালাবদলের খেলা। মেঘের গর্জনেও আছে নীরবতা। জোনাকির আলোতেও নীরব বিরতি। কোকিলের ডাকেও রয়েছে দুপুরের নির্জন নীরবতা।
নীরবতাকে একটা দীঘির প্রাত্যহিক পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রভাবতে পারি।
খুব ভোরে ঐ দীঘির জল দেখতে স্ফটিকের ন্যয় স্বচ্ছ, তলদেশ পর্যন্ত দেখা সম্ভব। রাতভর দীঘি তার জলে এই সাম্য শক্তিটুকু জমা করে। সময় বাড়ার সাথে সাথে মানুষ আসে- গোছল করে, কাপড় কাচে, মাছ ধরে। পশু পাখী আসে- জল খায়, জলকেলি করে। দল বেঁধে ছেলেরা আসে- জলে দাপাদাপি করে, পাথড় ছুঁড়ে মারে।
আস্তে আস্তে দিনের কোলাহল বাড়তে থাকে, দীঘির শান্ত রূপ পাল্টে যায়। পুরো এলাকার পরিবেশ এলোমেলো হয়ে যায়। দীঘির জল কাদা মাটিতে ঘোলা হয়। দীঘির নীরবতা ভঙ্গ হয়। দীঘির কিছুই করার থাকে না।
ঠিক একই ভাবে সকালে যখন আমাদের ঘুম ভাঙ্গে মস্তিষ্ক ও মন তখন শান্ত থাকে। সময়ের নিমিত্তে ও প্রয়োজনের তাগিদে মস্তিষ্ক যখন মনকে নির্দেশ দিতে থাকে এটা কর, ওটা কর- এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে তখন মনের রূপ বদলাতে থাকে। তার উপর সংসারের নানা ঝামেলা, অফিসের কাজ, পরিবারিক চাহিদা অন্যান্য সবকিছু মিলিয়ে মনটা স্বাভাবিক কারণেই অশান্ত হয়ে ওঠে। মনের মধ্যে এক ধরনের বিরক্তির উদ্রেক হয়। তখন অবশ্যই মস্তিষ্ক ও মনের নীরবতা ভঙ্গ হয়।
তাহলে কি বলা যায় ঐ দীঘিতে গোছল করা অন্যায়, মাছ ধরা অপরাধ। কিংবা আমরা প্রতিদিন যা যা করছি তা করা অনুচিত। মোটেও না। আসল কথা হলো সবকিছুর মধ্যেই একটা নীরবতা বা বিরতি থাকা দরকার। আর এই নীরবতাই অন্য সব কাজের প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক লয়ে নিয়ে আসে।
ঐক্যতান রচনা করে। মস্তিষ্ক ও মনের অতিরিক্ত পীড়া থেকে অব্যাহতি দেয়। আত্মা ও মনের প্রশান্তি এনে দেয়। মানুষ ইচ্ছা করে নীরবতা না ভাঙ্গলেও প্রয়োজন ও তাগিদ নিরন্তন তা ভেঙ্গে দেয়। ফলে পরিবেশ ও পারিপার্শি্বক অবস্থা অস্থির ও অশান্ত হয়ে ওঠে।
কানের যেমন শব্দদূষন থেকে রেহাই দরকার তেমনি মন ও মস্তিষ্কেরও অহেতুক উত্তেজনা ও বিরক্তিকর পরিস্থিতি থেকে বিশ্রাম দরকার। দুটোর জন্যই প্রয়োজন ক্ষণিক নীরবতা। নীরবতা সম্পূর্ন উপলব্ধির ব্যাপার। সকালের সেই দীঘির শান্ত জলের মতো প্রতিটি মানুষের মন ও মস্তিষ্ক নীরবতার আবেশে অটুট থাকতে চায়। চীৎকার চেচামেচি করে নয়, নীরবতা দিয়েই নিজের অবস্থান বোঝানোর চেষ্টা করা প্রয়োজন।
অন্যের ও নিজের কথা বলা বা শোনার জন্য নীরবতার চেয়ে ভাল মাধ্যম আর আছে কিনা জানা নেই। সবাই সবাইকে উপলব্ধি করার জন্য একটু নীরবতা ভীষণ প্রয়োজন। কেউ নীরব না থাকলে কারও কথা শুনবো কি করে। আমার আপনার নীরবতা মানেই অন্যকে বলতে সুযোগ দেয়া। অন্যকে বুঝতে পারা।
নীরবতা আমাদের পরম মিত্র।
আগের পোস্টের লিংকঃ
Click This Link
(বিবর্তনবাদী'র মেডিটেশন বিষয়ক পোস্টটা পড়ে পুরোনো লেখা পুনরায় পোস্ট করলাম। কিছুটা সংশোধিত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।