ফ্রম দ্যা হার্ট অফ ডার্কনেস
বারটা ঠিক মনে নেই। কিন্ত তারিখটা স্মৃতিতে এখণো দাউদাউ করে জ্বলছে।
৮ইজুন,২০০২। আগের রাতে হলে হলে ছেলেদের কি রকম একটা জটলা দেখেছি;
ছোটখাটো মিছিলও বা হয়েছিলো কি?সামনেই ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০০২;”ছুটি চাই,খেলা দেখতে দিতে হবে”,”খেলা আর ক্লাস একসাথে চলবে না”-ইত্যাকার স্লোগান কিংবা দাবী যতটা হাস্যকরই শোনাক না কেন,হ্ল কম্পাউন্ডে,স্পোর্টস্ রুমে,ডাইনিংয়ে কি ক্যান্টিনে গুণগুণ,ফিসফিস কখনোবা জোরালে স্বরে ভাসছিলো। শুনেছি কোন হলে জানি খুব ছোটখাটো মিটিং হয়ে গেছে;”কালকে গেট আটকানো হবে” সেই মিটিংয়ে বরাবরই সাহসী হিসেবে খ্যাত কিছু ছেলের সিদ্ধান্ত।
ঘুম থেকে কি একটু দেরিতে উঠেছিলাম নাকি ক্লাস ধরার জন্য ঠিক সময়টাতেই!তবে ক্লাসে যে যায়নি,সেটা নিশ্চিতভাবেই জানি। আগের রাতের সিদ্বান্তমতোই মেইন ফটকে সামনে ক্রীড়াপ্রেমী ছাত্ররা অবস্থান নিয়েছে। আর যথারীতি ছাত্রকল্যান পরিচালক সহ ছাত্রপ্রেমী শিক্ষকদের সেই ছাত্রদের বোধ-বুদ্ধি জাগ্রত করার ব্যার্থ চেষ্টা। অতঃপর ছাত্র-শিক্ষক মনোমালিণ্য,এবং কলহ। উপাচার্য মহাশয় নাকি ছাতা হাতে বেয়াড়া ছাত্রদের তাড়া করছিলেন এমনটাও শুনেছিলাম।
সকাল হালকা মতো বৃষ্টি হয়েছিলো কি!না হলে উপাচার্য মহাশয়ের হাতে ছাতা আসে কোথা থেকে। নিত্যাদিনের মতোই মফিজ ভাইয়ের ক্যান্টিনে সেই একঘেঁয়ে ,বিরক্তিকর প্রায় অখাদ্য নাস্তাটা সেরে ফেললাম। ক্যাম্পাসের মেইনগেটে হালকা ঝামেলা হয়েছে;সুতরাং ওইদিকে পা বাড়ানোর কোন মানেই হয়না। এমনিতে ক্লাসে যায় চরম অনাগ্রহে ;শুধুমাত্র ক্লাস এটেন্ডেন্সের কোটা পূরণ করতে,সেইখানে কোন ছুঁতা পেলে তো কথাই নাই। ক্লাস নাই,ক্লাসটেস্ট নাই;সো নো পড়াশোনা।
হাতে এখন অখন্ড অবসর। চাইলে কমনরুমে আনন্দবাজার পত্রিকায় ভারতীয় যৌবনবতী ফিল্মি কন্যাদের দূর্দান্ত ছবি দেখা যায়,টেবিল টেনিস কিংবা ক্যারাম বোর্ডে দুইএকদান খেলাও যেতে পারে।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বন্ধু’র বাড়ী ৩০৪, রশিদ হলের দিকে রওনা দিলাম। উদ্দেশ্য সত্যজিত,ঘটক মৃণাল কিংবা সাব-টাইটেল সহকারে কোন বিদেশী ভাষার ছবি দেখবো। বন্ধু মহলে তখন প্রবল বিক্রমে হলিউড কিংবা বলিউড’কে প্রতিহত করার চেষ্টা ।
আর আমি সেই চেষ্টার আপাতত চোখ-কান-নাক বন্ধ করে সমর্থক।
হলগেটে ছাত্রদের বেশ আনাগোনা,বেশ একটা চাঞ্চল্য সবার মাঝে,কেউ কেউ হয়তোবা উত্তেজিত ছিলো,ততোটা খেয়াল করিনাই। ভীড়-ভাট্টা’য় বরাবরই নিরুৎসাহী আমি। সবাইকে পাশ কাটিয়ে উঠে গেলাম তিনতলায়। রুমে আড্ডা চলছিলো,হঠাৎ কে জানি হন্তদন্ত হয়ে খবর দিলো ক্যাম্পাসে গুলি চলেছে।
সিড়ি দ্রুত বেগে নামতে নামতে জানা গেলো আরো কিছু তথ্য;আজকে কিসের জানি টেন্ডার ছিলো আর সেই টেন্ডার পেতেই বুয়েট ছাত্রদল-ঢাবি ছাত্রদলের মধ্যে রেষারেষি। তারই জের ধরে এই গোলাগুলি। বুয়েট ছাত্ররা গোলাগুলি’তেও ঢাবি ছাত্রদের সাথে টেক্কা দেয়; এইটা ভেবেও হয়তোবা অনেকের মতো আমিও খানিকটা পুলকিত হয়েছিলাম।
নীচতলার করিডর ধরে আমরা সবাই ছুটছি,উদ্দেশ্য হলগেট ;সেই ছোটখাটো জটলা বেশ বড়সড় একটা ভীড়ে পরিবর্তিত হয়েছে। নিত্যনতুন খবর আসছে।
বুয়েট ছাত্রদল নাকি তীতুমীর হলে অবস্থান নিয়ে সেখান থেকে গুলি চালাচ্ছে। আর হলের সামনের রাস্তায়,শহীদ মিনারের আশেপাশে অন্যগ্রুপের অবস্থান। দুই-এক রাউন্ড গুলির শব্দও কি শুনেছিলাম?হঠাৎ খবর এলো,এই গোলাগুলিতে কে জানি মারা গেছে। আমরা একটু ভীত হলাম সেই সংগে একটু বেশী উত্তেজিত,উচ্চকন্ঠ। তবে যেহেতু হতভাগ্যের নাম-পরিচয় জানিনা,তাই আরো অনেক বিচ্ছিন্ন ঘটনার মতোই তা আমাদের মনে তেমন কোন রেখাপাত করলো না;নিহতের নিয়তি ভাগ্যে ইহা লেখা ছিলো,আমরা এমনি করে সান্তনা পেতে চেয়েছিলাম।
অত;পর সেই শব্দজটের মাঝে,হরেক কথার ভীড়ে, বিভিন্ন জনের বিভিন্ন স্কেলের আওয়াজ,চিৎকার ছাপিয়ে নিহতের নাম পরিচয় জানা গেলো। নিহতজন একটি মেয়ে,এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই মেয়ে; কেমিকৌশল বিভাগের লেভেল-টু/টার্ম-২ -এর ছাত্রী সাবেকুন নাহার সনি। সে ক্লাস করতে গিয়েছিলো অন্য যে কোন স্বাভাবিক দিনের মতোই,ফিরেছে লাশ হয়ে।
দুদল খুনীর মাঝখানের শেষ্ঠতের লড়াইয়ে,হঠাৎ একটি বুলেট স্তব্ধ করে দিয়েছে তার হৃদপিন্ডের স্পন্দন,ফুটো করে দিয়েছে ফুসফুস,থেমে গেছে পৃথিবী নামক আজব গ্রহে তার স্বপ্ন যাত্রা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।