আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আজো মনে পড়ে, শিহরণ জাগায়

সিনেমাতেই দেখা যায় এরকম দৃশ্য। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সমাবেশ গুড়িয়ে দেয় তাদের পাণ্ডারা। আর দৃশ্য দাড়িয়ে দেখতে বাধ্য হন উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা। কিন্তু সেদিন পুলিশ সদস্যরা ঘোরের মধ্যে ছিলেন বোধহয়! বুঝতে পারেন নি বাস্তবে ঘটছে...না, দেখছেন কোন সিনেমার দৃশ্য। তারাও দাড়িয়েই ছিলেন।

২৯শে মে, ২০০৬; কুষ্টিয়ায় আয়োজন করা হয় সাংবাদিক নির্যাতন বিরোধী সমাবেশ। পালিয়ে ঢাকায় অবস্থান নেয়া চার সাংবাদিককে সঙ্গে নিয়ে যান সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী। সঙ্গে সিনিয়র সাংবাদিক ওমর ফারুক, ফরাজী আজমল হোসেনসহ ছোট্ট একটি দল। কুষ্টিয়া পাবলিক লাইব্রেরী মাঠে জড়ো হন আশপাশের বিভিন্ন জেলার সাংবাদিক নেতারা। ক্ষমতাসীন বিএনপি দলীয় সাংসদ ও নেতাকর্মীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আসেন আশপাশের ৭টি জেলার সর্বস্তরের সাংবাদিকরা।

দু’জন বক্তব্য দেবার পর শুরু করলেন ফরিদপুরের সাংবাদিক নেতা লায়েকুজ্জামান (বর্তমানে দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার অপরাধ বিষয়ক প্রধান প্রতিবেদক)। বিএনপি নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, একটি রাজনৈতিক দল কতটা দেউলিয়া হলে সাংবাদিকদের নামে মিথ্যা মামলা করতে পারে। এই বক্তব্যের পরই পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া ছাত্রদল ও যুবদলের ক্যাডাররা আর অপেক্ষা করেনি। হামলে পড়ে সমাবেশের উপর। পাশে অবস্থিত জেলা বিএনপি অফিসের ভেতর থেকে বের হয়ে তারা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে সমাবেশ স্থলে এসে মারপিট-ভাঙচুর শুরু করে।

কপাল ফেটে রক্ত ঝরে ইকবাল সোবহান চৌধুরীর। আহত হন ২৩ জন সাংবাদিক। অনেকের মোবাইল, ক্যামেরা ও মোটর সাইকেল ভেঙ্গে ফেলা হয়। হামলার আশঙ্কায় সমাবেশস্থলের চারপাশে আগেই অনেক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। কিন্তু সরকারি দলেল এই হামলা দাড়িয়ে দেখতে হয়েছিল তাদের।

মাঝে মধ্যে দু-একবার বাঁশি দিয়েছিল। পরে অবশ্য ঢাকা থেকে নির্দেশ পেয়ে পুলিশের আরেকটি দল গিয়ে আক্রান্তদের উদ্ধার করে। ততক্ষণে পন্ড হয়ে যায় সমাবেশ। সাংবাদিক নেতারা আশ্রয় নেন পাবালিক লাইব্রেরীর পাঠ কক্ষে। পরেও সমাবেশ করতে সাপোর্ট দেয়নি পুলিশ।

পুলিশ পাহারায় মিছিল করে স্থান ত্যাগ করেন নেতারা। কুষ্টিয়া হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে নির্যাতিত ওই চার সাংবাদিককে সঙ্গে নিয়েই ঢাকায় ফিরে আসেন তারা। সে সময় প্রশাসনে দলীয়করণ এতোটা প্রভাব বিস্তার করেছিল যে দেশে বিদেশে আলোচিত ওই ঘটনায় ইকবাল সোবহান চৌধুরী বাদী হয়ে মামলা দিলেও তা নেয়নি পুলিশ। বিএনপি দলীয় সরকার ক্ষমতা ছাড়লে দায়ের করা যায় মামলা। চার্জশীটও হয়েছে।

কিন্তু বর্তমান মাহজোট সরকারের আমলেও একের পর এক তারিখ নির্ধারণ হচ্ছে,শুরু হচ্ছে না ওই মামলার বিচারকাজ। সংবাদ প্রকাশের কারণে পালিয়ে ঢাকায় অবস্থান নেয়া ওই চার সাংবাদিকের একজন আমি। আমার দূর্ভাগ্য যে, ঘটনার শুরুও আমাকে নিয়ে। তখন কাজ করতাম দৈনিক মানবজমিনে। কুষ্টিয়া স্টাফ রিপোর্টার।

লিখতাম হাসান জাহিদ নামে। ২০০৬ সালের ৭ই মে ওই পত্রিকায় আমার বাই লাইনে ছাপা হয় ‘তিন এমপি টেনশনে’ শিরোনামে একটি সংবাদ। সংবাদটিতে ছিল ক্ষমতাসীন বিএনপি দলীয় কুষ্টিয়ার তিন এমপি জনবিচ্ছিন্নতার কারণে সামনের (সম্ভাব্য ২০০৭ সালের) নির্বাচন নিয়ে রয়েছেন টেনশনে। সংবাদে বর্ণিত ওই তিন এমপির একজন তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সভাপতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শহীদুল ইসলাম। সংবাদ প্রকাশের পরদিন ৮ই মে, ২৫শে বৈশাখ এ নিয়ে তিনি করলেন তুলকালাম কাণ্ড।

শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে তখন চলছিল রবীন্দ্র জন্মদিনের উৎসব। কেন এরকম নিউজ করেছি, তা জানতে চেয়ে ওই সভ্য সভায় প্রকাশ্যে তুমুল গালিগালাজ করেন তিনি। পাশে বসা দু’জন মন্ত্রী, অন্যান্য এমপি, শহীদুলের স্ত্রী। উপস্থিত হাজার হাজার রবীন্দ্র ভক্ত হতভম্ব। হতভম্ব আমিও।

তিনি এমন আচরণ করতে পারেন, এটা অস্বাভাবিক নয়। স্বভাব ও ক্ষমতার মিশেলে এমন হতেই পারে। কিন্তু তিনিই যে এ অনুষ্ঠানের আয়োজক। তিনি অধ্যাপক! সংস্কৃতি বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিও তিনি। স্মৃতিধন্য কুঠিবাড়িতে কবির জন্মদিনের উৎসবে তার এ আচরণ খুবই বেমানান দেখালো।

সঙ্গে সঙ্গেই ছি ছি পড়ে গেল। সহকর্মী সাংবাদিকরা প্রতিবাদ জানালো। ক্ষুব্ধ সংবাদকর্মিরা কুষ্টিয়া ফিরে প্রতিবাদ সভা করে। পরদিন ৯ই মে সমকাল, যুগান্তরসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক শহীদুলের এই অসভ্যতা নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সেখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো ঘটনাটি।

কিন্তু ওই দিনই এমপি শহীদুল বাদী হয়ে মিথ্যা মামলা করেন তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। আমি বাদে বাকী দু’আসামী মুন্সী তরিকুল ইসলাম(সমকাল) ও আল-মামুন সাগর(যুগান্তর)। তাদের অপরাধ হলো-আমার পাশে থেকে শহীদুলের অসভ্যতার প্রতিবাদ করেন,পত্রিকায় নিউজ করে খুলে দেন অসভ্যের মুখোশ। মজার ব্যাপার হলো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার খবর পরদিনের খবরের পাতায় ছাপা হলে আরেকটি মামলা করা হয় আমাদের তিনজনের বিরুদ্ধে। পুলিশ পাঠানো হয় বাসায়।

এরপর ঢাকায় পালানোর পথে আমাদের ধরতে পুলিশ ও ছাত্রদলের কর্মিদের দিয়ে প্রহরা বসানো হয়। মিঠু ভাই (মনজুর এহসান চৌধুরী, সম্পাদক, দৈনিক আন্দোলনের বাজার) এর প্রাইভেট গাড়ীতে করে গ্রাম্য পথে ঢাকায় পৌছাই আমরা। হামলা ও মামলার হুমকিতে ক’দিনের মাথায়ই মিঠু ভাইও আমাদের সঙ্গী হন। বন্ধ করে দেয়া হয় তার পত্রিকা আন্দোলনের বাজার। বন্ধ ছিল ৪৪ দিন।

বিভিন্ন পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় এই ঘটনার উপর সংবাদ প্রকাশিত হয়। জাতীয় প্রেসক্লাব ও ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন নানা প্রতিবাদ কর্মসূচী গ্রহন করে। সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, শওকত মাহমুদসহ অন্যরা উদ্যোগ নিলেন কুষ্টিয়া গিয়ে সমাবেশ করে আমাদের রেখে আসবেন। আমরা আশার আলো দেখতে পেলাম। কিন্তু খবর পেলাম কুষ্টিয়ায় গেলে হাত পা ভেঙ্গে দেয়া হবে।

সমাবেশেই হামলা করা হবে। খবরটি জানালাম ইকবাল ভাইকে। তিনি আমাদের উপর ক্ষেপে গেলেন। বললেন, আমি ভয় পাচ্ছি না। তোমাদের এতো ভয় কিসের।

হামলা হলে আমার উপর হবে। আমরা সাহস পেলাম। নির্ধারিত দিন ২৯ মে কুষ্টিয়া পৌছালাম। এর পরের ঘটনা আগেই বর্ণনা করেছি। কুষ্টিয়ায় সাংবাদিক সমাবেশে ইকবাল ভাই,র উপর এই হামলার ঘটনায় দেশে বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠলো।

আওয়ামী লীগের তৎকালীন এমপি প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক এই হামলার বিষয়টি সংসদে উত্থাপন করেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাদের নিরাপত্তা দিয়ে কুষ্টিয়া পাঠানোর উদ্যোগ নেয়। তুলে নেয়া হয় আমাদের বিরুদ্ধে দেয়া মিথ্যা দুটি মামলা। ২ মাস ৪দিন পর আমরা কুষ্টিয়া ফিরতে পেরেছিলাম। বিএনপি সরকার বিদায় নেবার পর এক এগারো সরকারের আমলে আবার আমাদের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা করার উদ্যোগ নেয়া হয়।

দৈনিক খবরের প্রতিনিধি ওই হামলায় আহত সাংবাদিক শামীম বিন সাত্তার বাদী হয়ে কুষ্টিয়া থানায় মামলাটি দায়ের করেন ২০০৭ সালের ২৫শে মার্চ। সাবেক সাংসদ শহীদুল ইসলাম, মেহেদী আহমেদ রুমীসহ আসামী করা হয় ১২ জনকে। এসময়ে তৎপর পুলিশ মামলার চার্জশীট দেয় ওই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর। এসময় হামলার ভিডিও ফুটেজ দেখে পুলিশ দুই ছাত্রদলকর্মীকে গ্রেফতার করে মামলায় যুক্ত করে দেয়। পরে জামিনে মুক্তি পায় তারা।

এদিকে আসামি পক্ষ চার্জ শুনানীর বিরুদ্ধে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন করে। বাদী অভিযোগ করেছেন এখন শুধু একের পর এক দিন ফেলা হয়। শুরু হয়না সাক্ষ্য গ্রহণ বা বিচার কাজ। এ নিয়ে কিছু দিন আগে সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরীর সাথে কথা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন,বর্তমান সরকারের আমলে এসে যদি এই মামলার বিচার না হয় তাহলে এর ভবিষ্যৎ কি? আবার যদি বিএনপি সরকার গঠন করে তাহলে কি অবস্থা হবে মামলা বাদীর? সাংবাদিকদের আবার মুখোমুখি হতে হবে একই পরিস্থিতির।

তথ্যমন্ত্রীর সাথে তিনি কথা বলবেন বলেও জানান। উল্লেখ্য বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু কুষ্টিয়া-৩ আসন থেকে সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারী শহীদুল ইসলামকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। জাহিদুজ্জামান ইনচার্জ, ন্যাশনাল ডেস্ক, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।