(সুমন প্রবাহন মারা যান ১৯শে এপ্রিল,২০০৮। ঠিক এক সপ্তাহ পর ২৫শে এপ্রিল তাঁর বন্ধুরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছবির হাটে সুমনের স্মরণে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এবং একইসাথে তারা 'একখন্ড একাকীত্ব' নামে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করে যা অনুষ্ঠান শেষে বিনামূল্যে বিলিয়ে দেয়া হয়। তা-ই ধারাবাহিকভাবে এখানে প্রকাশিত হলো)
মুয়ীয মাহফুজ
নেই, আর কোন শোক নেই বিস্ময় নেই জানাবার মতো
তবুও তোমার স্তব্ধ ও স্পষ্ট খোলা চোখ দেখে মনে হলো আজ
তুমি, খুব সাহসী...এই মুক্তির প্রণতি জানাই একবার
তবুও তোমার চেহারার মাঝে আমি দেখেছি শেষ বেলার
এক অস্তমিত অসহায়ত্ব।
আর আমিও দেখি সিলিংফ্যান থেকে মেঝের দূরত্ব মাঝে মাঝে কতই না সুবিশাল হতে পারে।
মৃত্যুর দিন চারেক আগে আমার সাথে ফোনে কথা হয় ওর।
সে জানায় তার এই মূহুর্তে সুইসাইড করতে ইচ্ছে করছে। আমি জানতাম সে সত্য কথা বলছে। আমি তার অবরুদ্ধ বাসনার বিরুদ্ধে কিছুই বলতে পারিনি।
জীবনানন্দের আট বছর আগের এক দিন কবিতার সেইসব বিপন্ন বিস্ময় দেখি আজো রয়ে গেছে কবিরক্তের প্রবাহে, খরস্রোতে।
নাকি সুমনের বিস্ময় বিপন্ন হয়েছে পারিপার্শ্বিক চাপে, আমরা তা আর জানতে সক্ষম নই।
একটা মৃত্যুসংবাদ আসলে মৃত্যুতেই থেমে গিয়েছে? আর কি সুমন বিস্তার লাভ করতে পারবে না তার মৃত্যুর পর?
তবে এ কথাও ঠিক, পারিপার্শ্বিকতা তার মৃত্যুতে অবদান রেখেছে। সমাজে আজো একজন কবিকে অবহেলা করা হয়, পাগল বলা হয় তার কল্পনাশক্তির জন্য। একজন সুস্থ মানুষ হঠাৎ করেই কেন ভারসাম্যহীন হয়? কার কাছে সে ভারসাম্যহীন, সেটা কি সমাজ নয়? এই সমাজ আমাদেরও পাগল করে দেবে একদিন। আন্দ্রেই তারকোভস্কির একটা কথা মনে পড়লো, একজন ব্যক্তিমানুষের কাছে সমাজের কোন প্রয়োজন না-ও থাকতে পারে, কিন্তু সমাজের অত্যন্ত প্রয়োজন সেই ব্যক্তি মানুষকেই।
এই সমাজের প্রয়োজনের কাছে সৃজনশীলেরা অবহেলিত রয়ে যায়।
কারণ সৃজনশীলদের ভাষা, সংগ্রাম মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠের চিন্তাধারার সাথে না-ও যেতে পারে । সেক্ষেত্রে মুর্খ সমাজ সবাইকে শেখায় অবহেলা করতে, এবং চুড়ান্ত একাকিত্ব দ্বারা মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে।
আমরা যারা বিচ্ছিন্নতার এ সমাজে বসবাস করি তাদের কাছে আত্মহত্যার সংবাদ একটা ভ্রকুটি বৃদ্ধি করে মাত্র। আমিও আমরাও এর ব্যতিক্রম নই। কিন্তু একজন কবি বা শিল্পীর মৃত্যুও কি নিছক মৃত্যুসংবাদ? কবির মৃত্যুর পর কি কবির কবিতাগুলোও মৃত্যুবরণ করে? আমার মনে হয় শিল্পীর মৃত্যুর পরও আজীবন বেঁচে থাকে, পাঠকের মনে, পাঠকের ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায়।
সুমনের গলায় যে নির্মম নীল দড়ি ক্রমশ এটে বসেছে, তা কি হঠাৎ করেই? না, এ দড়ি আমাদের সকলকে পিছমোড়া করে বেধে রেখে নির্যাতন করে চলেছে আজো। কখনো কখনো সেই দড়িই আমাদের গলায় চেপে বসে... আর তাই দেখে জীবিতরা অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, মরিবার হলো তার সাধ!
সুমনের একটা কবিতায় পড়েছিলাম "ঈশ্বরের অসীম একাকিত্বও আমার একাকিত্বের কাছে একা"। সুমনের কেন এই একাকিত্ববোধ? আমাদের বুঝি তা আর কোনদিনও জানা হয়ে উঠবেনা। আমরা শোকাহত। সুমনের মতো একজন উচ্ছল ও চমৎকার কবিত্বের অধিকারীকে হারিয়ে বিস্মিত, সত্যিই বিস্মিত।
সুমন তার মায়ের মৃত্যুর রূপ একদম ভেঙে পড়ে। সত্য কথা বলতে এরপর আর দাঁড়াতেই পারেনি। মায়ের মৃত্যুর পরের সাত আট দিন সে তার সকল বন্ধুদেরকে
নুরুন্নাহার শিরিনের একটি কবিতার অনেক ফটোকপি করে সবাইকে দেয়, আমাকেও দিয়েছিল। কবিতাটির শেষ দুটি লাইন ছিলো...
ও আকাশ ও মাটি আগলে রাখো মা-কে
মা যেমন রাখতেন প্রত্নবেদনাকে
সুমনকে মীরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে কবর দেয়ার সময় কোন জায়গা খালি পাওয়া যায় নি, তাই সুমনকে তার মায়ের পুরনো কবরেই কবর দেয়া হয়েছে।
অন্ধকার রাতে নিজস্ব নক্ষত্রের পাহারায়
অনেক চেনা কবরের অচেনা অন্ধকারে
কংকালের গলা জড়িয়ে ধরি
মা, আমার গায়ে খুব জ্বর।
”
(পতন-১, কালনেত্র, ৪র্থ সংখ্যায়-মার্চ ২০০৩, প্রকাশিত হয়েছিল)
২০০৩ সালে সুমনের এই লেখায় কি সুমন তখনই জানতো যে আসলেই মায়ের কংকাল জড়িয়ে ধরে বলবে, আমার গায়ের এই মাংসের ভেতরে বয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার ডিগ্রী জ্বর। সুমন কিভাবে জানলো তার ভবিষ্যৎ? অদ্ভূত বিষয়।
সুমন তুই কি এখন খুশি? সুমন তোর দুঃখ কি একটু কমেছে রে এবার? তুই কি আসলেই তোর মায়ের কাছে যেতে পেরেছিস?
সুমন, যদি কখনো পারিস আমাকে স্বপ্নে এসে এইসব কথা একটু জানিয়ে যাস রে পাগল। ভালো থাকিস।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।