আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছো বসি আমার ব্লগখানি কৌতুহল ভরে
১.........
বেলা দ্বিপ্রহরের এই সময়টায় গুলশান অ্যাভিনিউ এর বিশাল অফিসটায় খানিক নিস্তব্ধতা নেমে আসে , আজও হয়তো তার ব্যতিক্রম হয়নি । ব্যস্তভাবে পা বাড়ানো আমার জুতার খসখস শব্দে তন্দ্রালু দুপুরের তাল কেটে যায়। নিষ্কম্পভাবে বাঁদিকের লিফটটাকে উদ্দেশ্য করে এগিয়ে যাই ।
লাল রঙা লেড বাতি যখন ডিসপ্লেতে ৬ প্রদর্শন করে , প্রথমবারের মত কেঁপে উঠি । ত্রস্ত পায়ে নিজের শরীরটা লিফটে টেনে তুলি ।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চারপাশটা দেখি । খোদাই করে লেখা ম্যানুফ্যাকচারার LG electronics, লিফটের সিলিংয়ে খাঁজের ফাঁকে ঠিকরে পড়া টিউব লাইটের আলো , কিংবা বাঁদিকে হাত টেনে অনুভব করা কুলিং ফ্যানের বাতাসের স্পর্শ কোন কিছুই আমাকে এড়ায় না ।
বাঁপাশের এই লিফটটা ৫ তলায় গ্রামীণ ফোন আর দোতালয়া টেলিটক কর্মকর্তারাও ব্যবহার করেন। আজ কেন যেন ৫ তলায় লিফট থামে না ,লেড বাতির ডিসপ্লে বদলে যেতে থাকে ................ ৫,৪,৩,২.............. । অন্য কোনদিন হলে স্বস্তি পেতাম , আজ কেন যেন অস্বস্তি লাগে ।
অনুভব করি দু'টো সেকেন্ড বেশি সময় লিফটে থাকার আকুতি আমার গ্রাস করে নিয়েছে ।
আকুতি শেষমেশ বিফলে যায় না । অন্যসময় যে ২ এ থেমে যাওয়া নিয়ে মেজাজটা খিচড়ে উঠে, আজ সেটিই ভালো লাগতে থাকে। সামনের লোকটির কাঁধ আর পাশের জনের হাতের ফাঁক দিয়ে কাঁচে ঘেরা আলো আঁধারির টেলিটক রিসিপশনের ছবিটা শেষবারের মত ফ্রেমে গেঁথে নিই ।
নীচতলায় এসে সবাই বাঁদিকে পা বাড়ায় ,সঙ্গীহীনভাবে আমি ডানদিকের আন্ডারগ্রাউন্ডের পোর্চের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাই ।
পোর্চের ভেন্টিলেটর গলে সরলরেখার সূত্র মেনে চলা দুপুরের রোদেলা রেখাগুলো ধুলোবালির ইতস্তত চলাফেরা দৃশ্যমান করে তোলে । অবিচলভাবে ধুলোর সে রেখা ভেদ করে গুলশান অফিস আর বনানী হেড অফিসের মাঝে যাতায়াত কারী শাটল সার্ভিসের অপেক্ষমান মাইক্রোবাসটায় উঠে পড়ি । তন্দ্রালু চালকের ঝিমুনিতে ছেদ পড়ে ।
যাত্রাকালটা হবে খুব স্বল্প সময়ের । কোন ভাবনা বা স্মৃতিচারণের কাঠামো দাঁড় করানোর আগেই আমি ৩৩, বনানীতে পৌছে যাবো ।
তারপরও মাকড়শার জালের মত ছোট একটা নকশা বুনে ফেলার চেষ্টা করি । বিপরীত রুটের শাটলে ১৯৯টি দিবস আগে যে যাত্রার সূচনা হয়েছিল , তার যবনিকপাতের আর মাত্র কয়েকটা মুহূর্তের অপেক্ষা । বনানী ব্রিজের কাছটায় অহেতুক জ্যামে শেষ প্রহরটা পৌনে তিন মিনিট বেশি জীবন পায় ।
৩৩, বনানীতে শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে বেশি সময় লাগে না । ল্যাপটপ , টুলস গুলশানেই জমা রেখে এসেছি , এখানে বাকি শুধু আইডি কার্ড , পাঞ্চ কার্ড , কর্পোরেট সিম , মোবাইল সেট আর সবশেষে একটা সিগনেচার ।
খানিক পর বেরিয়ে আসি শুন্য কাঁধে, শুন্য হাতে । ভারী ল্যাপটপ কাঁধে ঝুলাতে অভ্যস্ত এই কাঁধটায় ভীষণ নির্ভার লাগে । মুক্তির স্বাদ পাই ,১৯৯ টি দিবস শেষে সমাপ্তি ঘটে আরেকটি পর্বের । পেছন ফিরে তাকাতে নিয়েও সংযত হই ..........
অধিকার ছেড়ে দিয়ে , তা ফিরে পাবার ইচ্ছার মত বড় বিড়ম্বনা আর নেই ।
২..........
ওয়ারিদের কর্পোরেট সিমকার্ড জমা দেয়ার পর ক্ষণিকের জন্য সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি।
হঠাৎ মনে পড়ে ,ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য আমার এক ভাইয়ার কাছ থেকে যে বিজনেস সলিউশন সিমটা নিয়েছিলাম ,সেটা ব্যবহার শুরু করলে কেমন হয়?
ঝামেলা কিছুতেই পিছু ছাড়ে না । ভয়েস কল করা হয়না বলে আউটগোয়িং barred করে দিয়েছিলাম যে পাসওয়ার্ড দিয়ে সেটি মনে করতে পারছি না।
অগত্যা এক দোকানে ঢুকে গ্রামীণ কাস্টমার কেয়ারে ফোন দিই । মিস্টি গলায় সুকন্ঠি কাস্টমার ম্যানেজার ফোন রিসিভ করেন ......
"স্যার আপনাকে কি করে সাহায্য করতে পারি ?"
...."আমার বিজনেস সলিউশন সিমকার্ডের আউটগোয়িং barred হয়ে গেছে , শুধু ইন্টারনেট অ্যাক্সেস করতে পারছি । কাইন্ডলি কি আমার আউটগোয়িং আনলক করে দিতে পারবেন ?"
"শিওর স্যার , এটা তো কর্পোরেট সিম ।
আপনার কোম্পানীর নামটা কি বলবেন ?"
হঠাৎ করে স্মৃতি ভীষণ প্রতারণা করে । ভাইয়ার কোম্পানীর নামটা কিছুতেই মনে পড়ে না । একবার মুখ ফসকে বলে ফেলতে নিই , আমি ঐ অফিসের ডেলিভারী ম্যান(ডেলিভারি ম্যান চলে যাবার পর সিমটা আমি নিয়েছিলাম) । পরক্ষনেই ইয়ে ইয়ে করে সামলে নিই । সুকন্ঠীজন শাহেদের বউয়ের মত আমার ইয়ে ইয়ের কোন অর্থ উদ্ধার করতে পারেন না , হয়তো সচেতন ভাবে লজ্জাতেও ফেলতে চাইলেন না।
"স্যার , কোম্পানির নামটা জেনে আবার কল দেবেন , কেমন ?"
নিজের কোম্পানির নাম জানি না দেখে লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে উচ্চারণ করি ," জ্বি ", তারপর লাইনটা কেটে দিই ।
৩..........
আজ খুব বেশি হাঁটতে ইচ্ছা করছে । হেঁটে হেঁটে গুলশান-১ টু বাড্ডা সংযোগ সড়কে চলে এসেছি। হঠাৎই দেখা হয় ছোটবেলার বন্ধুটির সাথে । আমার চাকরি পাবার কথা শুনে ফোনে সেই যে খেতে চেয়েছিল , তারপর আর দেখা হয়নি ।
টেনে নিয়ে গিয়ে এক হোটেলে বসি , তারপর অর্ডার দিয়ে চাকরির গল্প করি । "দোস্ত , খানিক আগে রেজিগনেশন দিয়ে আসলাম , সব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি "
দোস্তর মুখ দেখে মনে হয় কেউ Pause বাটন চেপে দিয়েছে , খানিক পর ওর গলা থেকে স্বর বের হয় "ঐ মিয়া ফাইজলামি করো ? তোমাদের ব্যাচে এটাই না সবচাইতে আকর্ষণীয় চাকরি ছিল ?"
"হুমম , ৭ মাস আগে যখন ভার্সিটি শেষ করে ঢুকলাম তখনও ছিল , এখনও আছে । তবে নিশ্চিত থাকো , একদম সজ্ঞানে ছেড়েছি । কোন বিবাদ , চাপ , ক্ষোভ কিছুই না , অফিসের সবারও মুখ কয়েক সেকেন্ড Paused হয়ে ছিল "
বন্ধু আমার বেশিই বিনয়ী... "তোমার চাকরিই তো নাই , আমি খাচ্ছি না" । কেন যেন একটু অস্থির লাগে আবার , চাকরি, চাকরিস্থল , কলিগ, বন্ধুদের মায়াটা মনে হয় যেন সব শেষ হয়ে যাবার পর জেঁকে বসেছে ।
জোর করে ওকে খেতে বসিয়ে রিক্সা ঠিক করি ।
একশো গজ এসে মনে পড়ে বিল দিইনি , । রিক্সা থামিয়ে পেছন দিকে দৌড় দিই , ক্যাশ কাউন্টারে বিল পরিশোধরত বন্ধুর হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বিল শোধ করি , লজ্জায় মনে মনে বলি ......."ধরনী দ্বিধা হও"
আনমনা আমার মাঝে আমাকে খুঁজে পাই না , বারবার খামখেয়ালি হয়ে পড়ি । মেইন রোডের পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে বয়ে চলি , দুপুরের ক্লান্ত ভাব কাটিয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠা বিকেলে ব্যস্ত ঢাকা শহরকে দেখি । মানুষগুলোর চোখে চোখ রেখে স্বপ্ন খুঁজি, অবচেতন মনে শুনি ..............
ব্যস্ত শহরে ....
ঠাস বুনোটের ভীড়ে
আজও কিছু মানুষ
স্বপ্ন খুঁজে ফিরে....
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।