নিয়ন্ত্রনের স্বয়ংক্রিয় ধারণা থেকে মুক্ত না হতে পারা মানুষেরা যখন অন্তর্জালিক বাকস্বাধীনতা প্রসঙ্গে মতামত দিচ্ছেন তখন আশ্চর্য হচ্ছি এটা ভেবেই, আমাদের নিজস্ব উচ্চারণ অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে- ব্লগের মতো একান্ত ব্যক্তিগত মতপ্রকাশের জায়গাটাতেও রাষ্ট্র এবং কতৃপক্ষের নিয়ন্ত্রন দাবি করা মানুষগুলো কি প্রয়োজনে এই নিয়ন্ত্রনের ধারণাটা বজায় রাখেন এটা আমি বুঝতে পারি না।
মানুষ নিজের দিনলিপিতে কি লিখে রাখবে সেটা ঠিক করে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্র উদ্যোগ নিবে কিংবা রাষ্ট্র সার্বক্ষণিক তদারকি করবে এই বিষয়ে? আমাদের কোন ভাবনাটা সমাজসঙ্গত, কোন ভাবনাটা অনৈতিক, কোন ভাবনাটা আমরা ভাবতে পারবো এবং কোন ভাবনাটা আমরা ভাবতে পারবো না, এইসব ঠিক করে দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা কতৃপক্ষীয় তত্ত্বাবধান কিংবা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ আমাকে পীড়া দেয়।
আধুনিকতা একটা ধারণামাত্র, অনেকগুলো ধারণার সংমিশ্রণ বলা যায়। তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো আধুনিকতা আমাদের প্রশ্ন করবার এবং সেই উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজবার পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দেয়। আমরা যেকোনো বিষয়ে যেকোনো রকমের প্রশ্ন তুলতে পারি, ইশ্বরের কাছে তার অস্তিত্বের ব্যখ্যা চাইতে পারি, আমরা প্রকৃতির কাছে তার বিধি ভঙ্গের কারণ জানতে চাইতে পারি।
প্রকৃতি কিংবা ইশ্বর আমাদের উত্তর দিতে বাধ্য নন, তবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমাদের ভেতরে যেকোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হলে আমাদের সেই প্রশ্ন উত্থাপনের একটা সুযোগ দেয় আধুনিক সমাজ।
রাষ্ট্র সবসময়ই খবরদারিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান। এখানে অনেক রকম রীতি-নীতি- বিধিনিষেধ আছে, নিয়মতান্ত্রিকতার প্রয়োজনে অনেক অন্যায় বিধিও রাষ্ট্র চর্চা করে। তবে অধিকাংশ দেশই অন্তত রাষ্ট্রীয় খবরদারিত্ব এবং দখলদারিত্ব থেকে অন্তর্জালকে মুক্ত রেখেছে। দিনের শেষে অন্তত ঘরের কোণে রাখা কম্পিউটারে সে উন্মুক্ত, স্বাধীন হয়েই নিজের কথা এবং ভাবনা প্রকাশ করতে পারে।
ভাবনাগুলো অসঙ্গত হতে পারে, কখনও কখনও রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। মানুষ মনে মনে অনেক অন্যায় ভাবনাই বয়ে নিয়ে চলে, কল্পনায় অনেকের সাথে নির্মম সহবাস করে যায়। এইসব কল্পনাপ্রবনতার জন্য কাউকে অপরাধী গণ্য করা হয় না এখনও।
ব্লগও মানুষের তেমন একধরণের কল্পনার নির্মান, তার নিজের স্বাধীন আকাশ। সেখানে শকুনের দল হানা দিবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না।
সুশীল তর্কের ভেতরে একটা ছিলো নিজের ছদ্ম অস্তিত্ব তৈরির স্বাধীনতা অস্বীকার- সেই সার্বক্ষণিক তদারকি এবং নিয়ন্ত্রন করবার ধারণাটা বলবত রাখা।
মানুষের এই ক্ষমতার চর্চা, নিয়ন্ত্রন বজায় রাখবার ধারণাটা অসুস্থ একটা প্রবনতা। রাষ্ট্র যখন এই নিয়ন্ত্রন বজায় রাখতে গিয়ে মানুষের শোবার ঘরে উঁকি দেয় সেটা রীতিমতো অশালীন একটা চর্চা। তবে রাষ্ট্রকে প্রতিহত করতে হলে যে পরিমাণে যুথবদ্ধতা প্রয়োজন তা আমাদের নেই। আমরা সংঘবদ্ধ হলেই হয়তো রাষ্ট্র এই অনৈতিক চর্চা থেকে নিজেকে বিরত রাখতো।
রাষ্ট্র কিংবা আইন নতুন যোগাযোগের মাধ্যমটাকে একটু সংশয়মিশ্রিত ভীতির দৃষ্টিতে দেখে। রাষ্ট্র বিশেষ করে বাংলাদেশ যেকোনো প্রযুক্তি বিষয়ে সবসময়ই সন্দেহবাতিকে ভুগে। তার সীমিত সীমান্ত গলে কখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় তথ্য বাইরে পাচার হয়ে যায় এই নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ রাষ্ট্রাধিপতিদের আমার সার্বক্ষণিক ফোবিয়াক্রান্ত মনে হয়।
তবে গত কয়েক দিন ধরে সচলায়তন প্রসঙ্গে উদার হয়েই প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পাতায় বিভিন্ন মানুষ মত প্রকাশ করছে। প্রথম দিন করলো পল্লব মোহাইমেন, তার পর বক্তব্য আসলো সুমন রহমানের, আজ লিখেছে ইশতিয়াক রউফ।
সবাই বাক স্বাধীনতার আলোচনাটা বাদ দিয়ে নিয়ন্ত্রনের কার্যকরণ খুঁজতে ব্যস্ত।
সচলায়তনের বিশেষ একটা রাজনৈতিক অবস্থান আছে। অন্তত এখানে সংশ্লিষ্ট সবাই একটা রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহন করেছে। সেটা ক্ষতিকর এবং অনৈতিক একটা অবস্থান এমনটা কি প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিত বিবেচনা করলে এমন অনেক সংঘই পাওয়া যাবে যাদের সদস্যরা নির্দিষ্ট একটা মতধারায় বিশ্বাস করে।
এইরকম একটা মতাদর্শ ধারণকরা সংগঠন তৈরি করাতেও কোনো বাধা নেই।
এমন একদল মানুষের সম্মিলন ক্ষতিকর বিবেচিত হতে পারে রাষ্ট্রের কাছে যখন এরা যুথবদ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রে অরাজকতা এবং নৈরাজ্য সৃষ্টির পায়তারা করবে তখন। মূলত অন্তর্জালের নিয়ন্ত্রনের জন্য সাইবার আইন এখনও শৈশবে, এক একটা অঘটনের সাথে নতুন বিধির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। অপরাধের নতুন সংজ্ঞা তৈরি হয়।
আপাতত যা অপরাধ বিবেচিত নয় তা নিয়ে আমরা আলোচনা বাদ দিয়ে মূল আলোচনাতে ফিরে যাই।
মূলত বিতর্কটা সচলায়তানের ব্যান হওয়া নয়, বরং প্রতিক্রিয়াটা আরও ব্যপক। মানুষের নিজস্ব স্বাধীন আকাশটাকে নিয়ন্ত্রন করবার একটা চেষ্টা চলছে। এটা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের উপরে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের একটা নমুনা।
এখানে যখন সুমন রহমান এসে বলেন সচলায়তন কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিত একটা সাইট এবং সামহোয়্যার ইনে কোথাও কতৃপক্ষের নিয়ন্ত্রন নেই তখন তার ভেতরে অজান্তেই একটা স্কুলগত ধারণা চলে আসে। এখানে সদস্যরা সবাই ছাত্র, তাদের জন্য একটা নিয়ম বিধি প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
বাক স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে যখন আমরা সেই মতপ্রকাশের জায়গাটাতে একটা কতৃপক্ষের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি তখন আদতে আমরা একটা খবরদারিত্ব প্রত্যাশাই করছি।
ইশতিয়াক রউফ আজকে যা লিখেছেন তার মূল বক্তব্য আসলে বাক প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে নয়, বরং কতকটা এটা সুমন রহমানের বক্তব্য খন্ডানোর প্রচেষ্টা এবং কাতর অনুনয়।
আমার ঘরে কেউ সব সময় নজর রাখছে, আমার শোবার ঘরের অন্তরঙ্গ আলাপন তারা আড়ি পেতে শুনছে এমন বোধটা অসস্তিকর। অথচ সবাই এই নিয়ন্ত্রনটাকেই মেনে নিয়ে অনুনয়ের রাস্তা ধরেছে।
আমি বাকস্বাধীনতা চাই, অবিলম্বে চাই, এবং এর জন্য কোনো অনুনয় করতে আমি রাজী না।
অন্তত এখনও কোনো আইনে এমন কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই যে আমি কোনো মত ধারণ করতে পারবো না। জরুরী অবস্থা রাস্তায় প্রকাশ্যে আমার মতের প্রচার চালাতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আমার মনের ভেতরে, আমারা মাথার ভেতরে অবিরাম যে মিছিল চলছে সেটাকে নিয়ন্ত্রনের কোনো বিধি তারা তৈরি করে নি এখনও।
আমি যতক্ষণ না কোনো প্রচলিত বিধি ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছি কিংবা কোনো রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচারণায় লিপ্ত হচ্ছি ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আমার বাক স্বাধীনতা অক্ষুন্ন দেখতে চাই। আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে এবং সবাই মিলে যখন বিধি প্রণয়নের একটা তাগিদ বোধ করছে আদতে কতটুকু স্বাধীনতা আমাদের প্রাপ্য, কতটুকু হলে নিয়ন্ত্রনের ভেতরে থাকবে পরিস্থিতি, তখন আমি অসুস্থ বোধ করি।
ঘৃণা করি সেইসব মানুষদের যারা
প্রথমত বৃদ্ধ বয়েসেও নিজেদের স্কুলের ধ্যানধারণা ছেড়ে আসতে পারেন নি, যারা সার্বক্ষণিক খবরদারিত্বের প্রয়োজন অনুভব করছেন
দ্বীতিয়ত যারা নিজের পরিচিতি আড়াল করাটাকে অনৈতিক এবং অন্যায় প্রবনতা ভাবছেন এবং এই প্রবনতার আড়ালে তারা অন্য কোনো একটা নিয়ন্ত্রনের উপায় খুঁজছেন তাদের
ত্বতীয়ত বাংলাদেশের অস্বচ্ছ প্রশাসন এবং এর সংশ্লিষ্ট সবাইকে যারা এখনও জানাতে পারলো না আদতে কি ঘটেছে? সাইবার অপরাধ যদি ঘটেই থাকে তাহলে কি ধরনের অপরাধ ঘটেছে এখানে।
সব শেষে সেই অজানা অভিযুক্ত পক্ষ যাদের প্ররোচনায় এটা বন্ধ করা হয়েছে বলে জনশ্রুতি চলছে। আদতে এই মানুষগুলোর প্রতি পাব্লিক ন্যুইসেন্স কিংবা জন হয়রানির অভিযোগ আনা দরকার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।