একদিন-প্রতিদিন
বাংলা গদ্যে প্রভুত্ব করার ক্ষমতা এঁর আছে যার সম্পর্কে প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ করেছিল সাহিত্য সাময়িকী দেশ সেই শক্তিমান কথাশিল্পী মাহমুদুল হক আর নেই। গত রোববার দিবাগত রাতে তিনি ৬৮ বছর বয়সে চতুর্থবারের হার্টএ্যা টাকে মারা যান। তাকে মিরপুর জাতীয় বুদ্ধিজীবী গোরস্তানে সমাহিত করা হয়েছে। জনপ্রিয় কবি সমুদ্র গুপ্তের মৃতু্য শোক কাটতে না কাটতেই ষাট দশকের আরেক কীর্তিমান সাহিত্যিকের মুতু্যতে দেশের সাহিত্যাঙ্গনে শোকের আবহ বিরাজ করছে।
জীবনঘনিষ্ট কথাশিল্পী মাহমুদুল হক অনেকটা নিসঙ্গ বসবাস করতেন।
গত ডিসেম্বর মাসে তার পত্নীবিয়োগ ঘটে। স্ত্রী হুসনে আরা কাজলও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার একমাত্র কন্য স্বামীর সাথে কানাডায় বসবাস করেন। তিনি মাস দুয়েক আগে দেশে এসে পিতা মাহমুদুল হককে তার খালাদের সাথে রেখে যায়। লালবাগের ২৭৪ নম্বরের সে বাসায় তিনি গতরাত ২টা ২২ মিনিটে মারা যান।
তার একমাত্র পুত্র অভিবাসী হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘ ষোল বছর থেকে বসবাস করছেন। পুত্র কন্যা কেউই পিতার অন্তিম যাত্রায় উপস্থিত হতে পারেননি।
গতকাল দুপুরে মাহমুদুল হকের মরদেহ বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা হলে একাডেমীর পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। বাদ জোহর অনুষ্ঠিত হয় নামাজে জানাজা। নামাজে জানাজায় বংলা একাডেমীর মহাপরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, কবি রফিক আজাদ, অধ্যাপক মনসুর মুসা, শিশু সাহিত্যিক এখলাস উদ্দিন আহমদ, সাংবাদিক আবুল হাসনাত, প্রকাশক মফিদুল হক, চলচ্চিত্র পরিচালক মুরশেদুল ইসলাম, উপন্যাসিক আনিসুল হক প্রমুখ অংশ নেন।
নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, কথাশিল্পী নসরীন জাহানও বাংলা একাডেমীতে উপস্থিত হয়ে মাহমুদ হকের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
মাহমুদুল হকের জন্ম ২ অগ্রহায়ন পশ্চিমবঙ্গের বারাসাতে। খ্রিষ্টিয় হিসেবে ১৯৪০ সালে। তার ডাক নাম ছিল বটু। তার অনুজদের কাছে তিনি বটু ভাই হিসেবেই আদরণীয় ছিলেন।
সাতচল্লিশের দেশভাগের পর তাদের পরিবার ঢাকায় এসে পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় বসবাস শুরু করেন। পিতা উচ্চপদস্ত সরকারি চাকুরিজীবী ছিলেন। ছয় ভাই চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। ১৯৫৯ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ করেন। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে হাইস্কুলে অধ্যয়কালেই তার লেখালেখি শুরু।
শিশুদের কাগজ আলাপনী, শাহীন সেতারা প্রভৃতি পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। ১৯৬৮ সালে তার প্রথম উপন্যাস যেখানে খঞ্জনা পাখি' শিরোনামে প্রকাশিত হয়। পরিবর্তীতে যার নামকরণ হয়েছে অনুর পাঠশালা। মুক্তযিুদ্ধকে উপজীব্য করে লেখা উপন্যাস জীবন আমার বোন তাকে ব্যাপক সাহিত্য খ্যাতি প্রদান করে। দেশভাগকে কেন্দ্র করে লেখা তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস কালো বরফ।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস খেলাঘর-নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্রকার মুরশেদুল ইসলাম। তার ছোটগল্পের একমাত্র গ্রন্থ হচ্ছে প্রতিদিন একটি রুমাল। চিক্কোর কাবুল গ্রন্থটি একমাত্র শিশুতোষ গ্রন্থ। অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে নিরাপদ তন্ত্রা ও মাটির জাহাজ। সাহিত্যক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি ১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কারলাভ করেন।
লেখালেখিতে তার খ্যাতি যখন তুঙ্গে তখনই আশির দশকের শুরুতে লেখালেখি থেকে তিনি আকস্মিকভাবে স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যান। এ বিষয়ে কোন স্পস্ট উত্তর দিতেন না তিনি কখনো। এক ধরণের উন্নাসিকতাই যেন ভর করেছিল তাকে। নিভৃতচারি ও অসম্ভব সদালাপী ছিলেন তিনি। তার একজন তরুণ ভক্ত বিষয়টিকে বলেন এভাবে-দশ ঘন্টা আলাপ হলেও মনে হতো এখনো শুরুই হয়নি।
কীর্তিমান কথাশিল্পী মাহমুদুল হক সম্পর্কে অধ্যাপক মনসুর মুসার মূল্যায়ণ-তিনি অসম্ভব প্রতিভাবান কথাশিল্পী ছিলেন। বিশেষ দৃষ্টিভাঙ্গি নিয়ে তিনি লিখতেন।
তার প্রায় সবগুলো বইয়ের প্রকাশক মফিদুল হক বলেন, এমন স্তরের লেখক তার উপস্থাপনা শৈলী তুলনাহীন। পরিপূর্ণ সাহিত্যিক বলতে যা বুঝায় তা-ই ছিলেন। তিনি সম্ভব জীবনবাদী কথাশিল্পী ছিলেন।
নাসরীন জাহান বলেন, এই জীবনে এই প্রথম প্রিয় শিল্পজনের দেহ দেখতে আসলাম।
সংস্কৃতি উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরীও মাহমুদুল হকের মৃুত্যতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।