সাগর সরওয়ার
এই ভূতটা কিনতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হলো।
এর আগে যতগুলো ভূত কিনেছি তার কোনটা কিনতে আমাকে এত ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। সেবার ভুরুঙ্গামারির ভূগোল ভূত কিনেছি মাত্র সাতশ টাকায়। পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম-
"কেউ যদি ভূত বিক্রি করতে চান আমার তা হলে আমার সাথে যোগাযোগ করুন, ৮৭ ভূতেরগলি ঢাকা। "
এটা বেরুনোর পর মাত্র এক দিনের মধ্যে এলো সেই লোক বললো তার বাড়ি ভুরুঙ্গামারি।
ক'দিন হলো ঢাকায় এসেছে। সেখানকার যে নদী আছে যেটা দিয়ে ভরা বর্ষাকালেও সামান্য পা ডুবিয়ে পার হওয়া যায়, ঐ নদীর পাশ থেকেই সে একটা ভূত ধরেছে। এই ভূতটা রয়েছে মাটির পাতিলে বন্দি। পাতিলের কাছে গিয়ে পৃথিবীর যে কোন স্থানের নাম বলে দিলেই সে বলে দেবে কোন মহাদেশে এর অবস্থান বাংলাদেশ থেকে কত দূর আর সেখানকার স্থানীয় সময় কত। চাইলে ঐ শহরের পাশে কি নদী আছে তাও জানিয়ে দেবে সে।
পাতিল তৈকে বের করলেও কোন সমস্যা নেই। দেখা যাবে না, কথা শোনা যাবে।
লোকটির টাকা দরকার। সে বাড়ি যাবে। আর আমার দরকার ভূগোল ভুতটি।
ঐ লোক ভূতের দাম হাকালো এক হাজার টাকা, আমি বললাম দেবো ছয়'শ ।
লোকটি মানলো না। বললো, এক দাম সাতশ টাকা দিলে দেন না দিলে চলে যাই।
আমি নিয়ে নিলাম। তার আগে পরীক্ষা করলাম সত্যিই এই ভূতটি ভূগোলের সব কিছু জানে কিনা।
প্রশ্ন করলাম ইয়েমেনের রাজধানির নাম কি?
সে বললো: সানা।
বললাম: যখন ঢাকায় বাজে সন্ধ্যা ৬ টা ৪২ তখন মিড আটলান্টিকের সময় কত?
সে বললো : সকাল ১০ টা ৪২।
উত্তর শুনে আমি তো অবাক।
আরও দুই তিনটা প্রশ্নের উত্তর সঠিক ভাবে শোনার পর আমার ভূত মিউজিয়ামে রেখে দিলাম ওটাকে। মিউজিয়ামে যোগ হলো নতুন আরেকটি ভূত।
***************************
মধ্যরাতে ভূতের গলি দিয়ে আমি হেটে যাচ্ছি। চারিদিকে সোডিয়াম লাইটের আলো। শুনশান। বাড়ি থেকে বের হয়েছি নতুন একটা চকলেটের সন্ধানে। আমার চকু ভূতটা এই গভীর রাতে আমাকে ডেকে বললো তাকে ঐ নতুন ট্যাটবেরি চকলেট খাওয়াতে হবে।
এই চকলেট না পেলে সে সারা রাত ঘুমুবেনা। চিল্লা চিল্লি করবে। ঘুমুতে দেবেনা। আমি সত্যি সত্যি রেগে গিয়েছিলাম। কিন্তু এটাও জানি ঐ দাবি না মানলে আমার অবস্থা কাল সকালেই কাহিল হয়ে যাবে।
তাই মাঝরাতে আমি পথে। একটা দোকান খুঁজে পেলাম। খোলা। এত রাতে এ দোকান খোলা কেন?
দোকানি নতুন এ দোকানের বিভিন্ন জিনিসে ঝারটার দিচ্ছে। পাড়ায় এ নতুন দোকানে আমি আগে আসিনি।
জিজ্ঞাস করলাম
:কি নাম ভাই আপনার? লোকটি একটু অবাক হয়ে উত্তর দিলো
:কালু, মানে কালু মিয়া সমাজদার।
:খুব খুশি হলাম আপনার সাথে পরিচয় হয়ে। আচ্ছা ভাই আপনি
কি আমাকে একটা ট্যাটব্যারি চকলেট দিতে পারেন।
: পারি। তিনি একটা চকলেট দিলেন।
আমি সেটা নিয়ে এলাম। চকুকে সেটা দিতেই সে খুব খুশি । আমি ঘুমুতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ঠিক তখনি কান্ড আমার ফ্রিজ ভুতটির! তার নড়াচড়ার শব্দ শুনে গিয়ে ফ্রিজের ডালা খুলতেই বয়ামের ভেতর রাখা পিচ্চি ফ্রিজ ভূত বললো, তার খুব মিষ্টি খেতে ইচ্ছা করছে। এক্ষুণি দিতে হবে।
ঐ দিন আমার ফ্রিজে কোন মিষ্টি ছিলো না। বায়না শুনে আমি মরি আর কি! এভাবে আজ রাতে যে আব্দার শুরু হয়েছে, তাতে আজ হয়তো আর শোয়া হবে না। ভুতের গলিতে কোন মিষ্টির দোকান নেই। আর দোকান যদি থাকতোই তা হলেও খোলা পাওয়া যেত না। আমি বললাম
:এখন মিষ্টি পাওয়া যাবে না।
তুমি ঘুমাও। কাল খাওয়াবো।
মানবেই না সে। কি আর করা। বিকল্প কিছু একটা করা দরকার।
ঘরে চিনি ছিল। বললাম
:চিনি খাও, সেটাও মিষ্টি। সে বললো
: ভূতেরা চিনি খায় না। ভূতোর দাত বড়। আর তাই চিনি চাবানো যায়না, সব ফাক দিয়ে বেড়িয়ে যায়।
তাই গোল গোল রস গোল্ল্লা-ই খাওয়াতে হবে।
এবার আমার শক্ত হওয়ার পালা। খুব গম্ভির হয়ে বললাম
: না এখন সম্ভব নয়। বেশী কথা বললে ফ্রিজের তাপমাত্রা কমিয়ে দেব।
আমার হুমকিতে কাজ হলো।
সে চুপসে গেল আর আমি শুতে গেলাম।
একটু তন্দ্রা এসেছে। ঠিক তখনি শুনি কাঠের বাক্স থেকে গান ভূত টুকটাক শুরু করেছে। আমি আমলে নিলাম না। আজ আর উঠবোই না।
কিন্তু আমার এই শপথ কি আর ঠিক থাকে। আমি তো ভূতের জাদুঘরের কিউরেটর। আমাকে উঠতেই হলো। গান ভূতকে জিজ্ঞাস করলাম
: কি বিরক্ত করছো কেন? উত্তরে সে বললো
:এখনই তাকে গান শুনতে হবে। এলভিস প্রেসলির গান।
এম পি থ্রি শুনাতে হবে। সে অনেক ন ধরে শুনবে। কাজ সেরেছে। এবার কি হবে। সে আবার হাই ভলিউম ছাড়া শুনতে পারে না।
সিডি প্লেয়ার ছেড়ে দিলে, পাড়া শুদ্ধ লোক জেগে উঠবে। একটা কিলও মাটিতে পড়বেনা। তাকে বললাম,
:এয়ার ফোন লাগিয়ে দেই ওটা দিয়ে শোন।
গান ভুত ভদ্র। সে রাজি হলো।
এখন রাত তিনটা। গান চলছে...। ভূত শুনছে। আমার ঘুমের তেরোটা বাজছে। এখন ঘুমুতে না পারলে কাল কাজ করতে কি পরিমান বেগ পেতে হবে, তা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না।
আমি ঘুমিয়ে গেলাম। কোন সমস্যা নেই। নেই কোন ঝামেলা।
*******************************************
সাগরের পানি নীল হয়। এই পানি সবুজ।
আমি সাতার কাটছি। সবুজ পানিতে সাতার কাটা খুব কষ্টের। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। নিশ্বাস নিতে পারছি না।
ছটফট করছি। আমার জীবন বুঝি যায়। এগিয়ে আসছে একটি হাঙ্গর। আমার প্রাণ এবার যাবেই মনে হয়। তবুও আপ্রাণ বাঁচার চেষ্টা।
কিন্তু আমি তো সাঁতার কাটতে পারছিনা। কে যেন আমাকে ঠেসে ধরছে। হাঙ্গর এগিয়ে আসছে। আমাকে তার ধারালো দাঁত দিয়ে খোঁচা মারছে। আমি শক্তি খাটানোর চেষ্ঠা করতেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল।
দেখলাম আমার স্বপ্ন ভূত আমার সামনে দাড়িয়ে। সে হাসছে। ওর হাসিটা পচা। ওকে আমি কিনেছিলাম গুলিসত্দান থেকে। এক টাক মাথা লোক দাড়িয়ে আছে গোলাপ শাহ্ মাজারের সামনে।
আমি কি কারণে যেন সেখানে গিয়েছিলাম। লোকটি আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো, আপনি কি আমাকে একটা উপকার করতে পারেন। আমাকে দশটি টাকা দিতে পারেন। গুলিসত্দান হচ্ছে বার রকম মানুষের জায়গা। এখানে ভালো লোকের চেয়ে খারাপ মানুষের কাজ-কারবার বেশী।
তবুও আমি একটুও না ভেবে বুক পকেট থেকে দশটি টাকার একটি নরম নোট বের করে তার হাতে দিয়েই শুরু করলাম হন্টন। লোকটির দিকে আমি আর তাকালাম না (আমার একটু ভয় করছিল)। একটু এগিয়ে আসতেই দেখি আমার সামনে সেই লোক। এক গাল হেসে বললো
: ধর।
আমি ধরলাম।
কি ধরলাম জানি না। কাপড়ের ছোট্ট একটি ব্যাগ। একটা রিকসায় দুম করে উঠে বসলাম। দরদাম ঠিক না করেই । জানি এই ব্যাটা পরে বেশী ভাড়া নেবে।
উপায় নেই। লোকটির দিকে একবার ঘুরে দেখলাম। না সে নেই। বাসায় এসে দেখি ঐ ব্যাগের মধ্যে আর একটা ব্যাগ আর বাংলায় লেখা একটি চিঠি।
' তোমার জন্য এটার মধ্যে রাখা আছে একটি স্বপ্ন ভূত।
প্যাকেট খুলে রেখে দাও। ডাকলেই কাছে আসবে। স্বপ্ন দেখাবে। ও কিন্তু বেশ দুষ্টু। আর একটা বিষয় ওর হাসিটা বিশ্রী।
ভয় পেয়ো না। ওর মনটা ভালো। '
এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন ভূত। এ রকম আজকাল প্রায়ই করে নিজ থেকেই স্বপ্ন দেখায়। আজকাল স্বপ্ন দেখতে ভাল লাগেনা।
সকাল হয়ে গেছে। গোসল সেরে নাসত্দা খেয়ে রোজকার মতো বেরিয়ে পড়তে হবে কাজে। সব ঘরের জানালা বন্ধ করে দিলাম। বাতি বন্ধ করলাম। ফ্যানটা যখন বন্ধ করতে গেছি তখন আমার দাড়োয়ান ভূতটি বলে উঠলো
: ওটা বন্ধ করার দরকার নেই।
আমিই বন্ধ করে দেব। যা গরম পড়েছে!
আমি নিশ্চিন্ত। দারোয়ান ভূতটি আমাকে কিনতে হয়নি। এটা ছিল উপহার। নবাবপুরের আমাদের পুরানো বাড়িতে যে দাড়োয়ান ছিল সেই এটা আমাকে দিয়েছিল।
উনি তখন চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
যাহোক আমি দরজা বন্ধ করে চলে গেলাম। আমি নিশ্চিন্ত। এই দাড়োয়ান ভূতটি থাকলে ভূত মিউজিয়ামের কোন ভূতেই কোন সমস্যা থাকবেনা।
মিউজিয়ামে ভূত পালন চাট্টিখানি কথা নয়।
আমি পারছি। আর এভাবেই আমার দিন শুরু হচ্ছে, রাত ফুরাচ্ছে......
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।