বাস্তবতা ফেরী করে বেড়াচ্ছে আমার সহজ শর্তের সময়গুলোকে
১.
অনেক না পাওয়ার বিষয়গুলো উপলব্ধি করি। অনেক স্বপ্ন ভাঙ্গার পর নতুন করে স্বপ্ন দেখি।
রোজনামচার অনেকটা অংশ জুড়েই নানরকমের রং লাগানো ভাবনা। ভাবনার তোড়জোড়ে উড়ে যায় অনেক বাস্তবতা। আদতেই কি বাস্তবতা পিছু ছাড়ে!!
কতো না পাওয়ার ভিতর দিয়ে যাওয়া আমাদের পিছু বাস্তবতা কি আদৌও ছেড়েছে? স্বাধীনতার পর এতোবছর গেল, এখনো আমাদের সেই গানের লাইনটার মতোই বলতে হচ্ছে- কি দেখার কথা কি দেখছি..........
মুক্তিযুদ্ধের এতোটা বছর পরেও বিচার হয় নি যুদ্ধাপরাধীদের.......রাজা আসে রাজা যায়.....নেতার পর নেতা নির্বাচিত হয়ে আসে.....সাধারণ এই আমরা জীবনমাত্রার মূল্য বৃদ্ধির যাঁতাকলে পড়ে স্বপ্ন দেখি কেবল......কতোসব কথার তুবড়ি আমাদের সামনে ঘুরে ফিরে........................
কোন সরকার কি বিষয়টাকে অতোটা আন্তরিকতা নিয়ে দেখেছে? তাহলে এতোটা বছরেও কেন বিচার হয় নি! কেন তবে এই দেশে একজন মুক্তিযুদ্ধাকে অপমানিত হয় স্বাধীনতাবিরোধী চিহ্নিত শক্তির একজনের কাছে?
এর বিরোদ্ধে কি প্রদক্ষেপ নিয়েছে সরকার আমার জানা নেই? কিন্তু এমনটা হলো কেন এই স্বাধীন দেশে!! মন ভাবে তা......
২.
একটা লেখা পড়ে বোধটা নড়ে গেল.....বারবার পড়ছি সেই লেখার অংশবিশেষ.....একটা রাত পোহালো এভাবে.......একটা ক্লান্ত ছেলের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে চোখের সামনে .....বার বার......
১৩ বছরের সেই ছেলেটি মুক্তিযুদ্ধের সময় এসএলআর হাতে বাংকারে বাংকারে ছুটে বেড়তো।
একদিন ক্লান্ত ছেলেটি ঘুমিয়ে পড়ে গোলাবারুদের স্তুপের উপর। ঘুমন্ত সেই ছেলেটির ছবি ছাপে লন্ডনের একটি কাগজ। শিরোনাম- আ লিটল ফাইটার স্লিপিং উইথ আর্মস।
এতো বছর পর সেই ছেলেটির উপলব্ধিকে আমি হৃদয় দিয়ে ধরতে যাই..............
আমার প্রয়াত বাবা স্বীকৃতিহীন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁর ১৩ বছরের ছেলেটি এসএলআর হাতে বাংকারে বাংকারে ছুটে বেড়াত।
একদিন বাংকারে খাবার পৌছানোর সময় এ্যাম্বুশে পড়ে গেল। সেকেন্দার নামের এক ইপিআর সদস্য ছেলেটিকে এর পর দায়িত্ব দিল আর্মস-এ্যামুনিশন টেন্টের । ক্লান্ত ছেলেটি একদিন গোলাবারুদের স্তুপের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিল.....ঘুম ভাঙার পর শুনল লন্ডনের কোন সাংবাদিকরা তার ছবি তুলে নিয়েছে। ক্যাপটেন মাজহার বলেছিল 'লন্ডনের কাগজে ছবিটা ছাপা হয়েছিল....." আ লিটল ফাইটার স্লিপিং উইথ আর্মস "শিরোনামে। আরো পরে ছেলেটি মেজর জলিল,মেজর আবু ওসমানদের সংস্পর্শে এসেছিল।
সেই একাত্তরের দেখা আর তার পরের ৩৫ বছরের দেখা ভীষণ ভাবে কন্ট্রাডিক্ট করেছে। ঘৃনায় কষ্টে বাবা তো মরেছে.....ছেলেটা আজো বেঁচে আছে ...তার বুকের ভেতরে উদগিরণ হওয়া গলিত লাভা গলে গলে পড়ছে কাগজের পাতায় পাতায়......স্লিপিং উইথ আর্মস এর সেই মনজুরুল হকের আর কি-ই বা করার ক্ষমতা আছে...?
৩.
পরের অংশও পড়ি আমি........যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে ছোট সেই ছেলেটি কি করেছিল ....জানতে ইচ্ছা হয় খুব।
৭২ এর জানুয়ারির প্রথম দিকে আমরা মেহেরপুর দিয়ে দেশে ফিরি । কয়েক মাস পরেই 'ফটিক" হিসেবে আমার ট্রান্সফার হয় মামার কাছে,দর্শনায় । বাবা-মা চুয়াডাঙ্গায় ।
তারপর ৭২ এ বাবা-মা চলে যান দিনাজপুর । আমার সঙ্গে ৫ বছরের ছাড়াছাড়ি। সেই কাগজ শুধু নয়, ওই সাংবাদিকরা আমার কান্না রেকর্ড করা একটা ছোট ওয়াকম্যান ও দিয়েছিল । সব হারিয়েছে । মা বলেন তাদেরকে ৭৬ এ আ্যালোটমেন্ট বা অনুদান পাওয়া বাড়ি থেকে যেদিন উচ্ছেদ করা হয় সে সময় নাকি বাবা কষ্টে রাগে তার-আমার সব স্মৃতিই নষ্ট করে ফেলেছিলেন ! বাবা বলতেন ...থাক কষ্ট বাড়ে ।
জীবন বাঁচাতে ওই সময় এত বেশী কষ্ট করতে হয়েছে যে প্রাণ ধারণের বাইরে সবকিছুই গৌণ হয়ে গেছিল ।
মুক্তিযুদ্ধ কাকে কী দিয়েছে জানি না, তবে আমাকে দিয়েছিল ম্যাচ্যুরিটি । ১২/১৩ বছর বয়সেই তিন বোন আর মা'কে বাঁচাতে অন্য এ যুদ্ধ করতে হয়েছিল । ২০টাকা ভাতা পেতাম । একাধারে পিতামাতাহীন কিশোরদের ক্যাম্প চালানো,থানা শহর তেহট্ট থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের রেশন আনা,বাংকারে রসদ পৌঁছানো ...........।
৪.
সেই ছেলেটির বুকের ভেতরে উদগিরণ হওয়া গলিত লাভা গলে গলে পড়ছে কাগজের পাতায় পাতায়......... ভাবছে- স্লিপিং উইথ আর্মস এর সেই মনজুরুল হকের আর কি-ই বা করার ক্ষমতা আছে...?
গলে গলে পড়া লাভার উত্তাপ আমাকেও স্পর্শ করে যায়। 'করার ক্ষমতা' বিষয়টা নিয়ে আবার ভাবতে বসি আমি। হায় কতো সীমাবদ্ধ আমি এবং আমরা। ভেবে যেতে আর স্বপ্ন দেখেতে হচ্ছে কেবল!!!
আ লিটল ফাইটার স্লিপিং উইথ আর্মস এর উপলব্ধিগুলো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ঘুমন্ত সেই বীরের ঘুম দেখে ঘুমানো হয়ে উঠে না আমার.....পাহারা দিতে ইচ্ছা হয় খুব।
রাতটা বুঝি আমার নির্ঘুমই কাটলো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।