"পসার বিকিয়ে চলি জগৎ ফুটপাতে, সন্ধ্যাকালে ফিরে আসি প্রিয়ার মালা হাতে"
এক বৃক্ষের আহাজারি
(সুপ্রিয় ব্লগার "ছন্নছাড়ার পেন্সিল" এর পোস্টে করা মন্তব্যের ভিত্তিতে)
Click This Link
একদিনের এক ছোট্ট লিকলিকে চারাগাছ থেকে দেখতে দেখতে কেমন বড়সড় এক বৃক্ষ হয়ে গেলাম। রোদ-বৃষ্টি-ঝড়-জলোচ্ছাস সবকিছু উপেক্ষা করে সুখেই ছিলাম সবুজ অরণ্যে। শক্ত সমর্থ হয়ে বেড়ে ওঠা বিশাল কান্ড; দুর্বার, সুবিন্যস্ত শাখা-প্রশাখা; সবুজ পত্র-পল্লব; নিতান্তই নির্লোভ, নির্লিপ্ত, শান্ত সবুজ এক বৃক্ষ ছিলাম। পাখীদের কোলাহল, শাখামৃগদের উচ্ছাস, কাঠবিড়ালীর মাতামাতি, মৌমাছিদের বিচরণ আমাকে আনন্দ দিত। সময়ে পাতা ঝরে যাওয়া আবার নতুন পাতা গজানো- এসব নিয়েই আমার দিন কেটে যাচ্ছিল।
বনের যত গাছ-পালা, পশু-পাখী, কীট-পতঙ্গ সবাই আমার বিশ্বস্ত বন্ধু। আমার দেহে দেহে বেড়া ওঠা শত পরগাছা নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ ছিলনা। আমার পায়ের নীচেই মাটি, জন্ম থেকেই এই মাটির প্রতি আমার গভীর ভালবাসা। আমার পা বলতে কান্ড আর এই কান্ডের উপর ভর করেই আমি মাটি আঁকড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম দীর্ঘকাল।
একদিন সকালে বনে এলো এক করাতির দল।
মহা উল্লাসে ঘুরে ফিরে দেখলো তারা এই সবুজ বনাঞ্চল। তারপর একসময় আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার গলায় দড়ির ফাঁস লাগিয়ে দিল। টান টান করে আমায় ওরা বেঁধে ফেললো। আমার কান্ড বরারর ধারালো করাত চালাতে লাগলো সজোড়ে।
বুঝলাম ওরা আমাকে কেটে ফেলবে। তাদের চোখে মুখে নির্মম উল্লাস। ক্রমশঃ মাটির বুকে বিছিয়ে দেয়া শেকড় থেকে আমার দেহটা বিচ্ছিন্ন হতে লাগলো। মাটির সাথে আমার নিবিড় সম্পর্কের বাঁধন চিরতরে ঘুচিয়ে দিল। আমি আর নিজের ভর সইতে পারলাম না।
মুখ থুবড়ে পড়ে গেলাম আমার প্রিয় মাটির বুকে। দুমরে মুচরে গেল সকল শাখা-প্রশাখা।
করাত অবিরাম চলতেই থাকলো। আমার দেহ থেকে সমস্ত শাখা-প্রশাখা বিচ্ছিন্ন করা হলো। প্রকান্ড কান্ডটা শুধু পড়ে রইলো অনাদরে।
একদিন আমার সেই কান্ডটা হাতির পায়ের সাথে শেকল বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো বনের বাইরে। পাশের একটা ছোট্ট নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হলো। ভেসে রইলাম সেখানে অনেকদিন। এরপর একদিন আমাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো কিছু দূরেই গড়ে ওঠা এক অত্যাধুনিক করাত কলের অভ্যন্তরে। যন্ত্রের বিকট শব্দ চারিদিকে।
দেখলাম আমার মতো অসংখ্য কান্ড চোখের নিমিষে ফালি হয়ে যাচ্ছে যন্ত্রের সুনিপূণ কৌশলে। আমার কান্ডটাকেও চিঁড়ে ফেলা হলো। অসংখ্য কাঠের ছোট ছোট টুকরো হয়ে গেলাম অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানে।
তারপরেও আমার নিস্তার নেই। কাঠের সেই ছোট ছোট টুকরোগুলো অনবরত চিঁড়তেই থাকলো।
একসময় আমি টুকরো কাঠের দন্ড থেকে গোল, গোল থেকে গোলাকার কাঠের চিকন লম্বাটে টুকরো হয়ে গেলাম। আর সেই টুকরোগুলোর ভেতর নানা রঙের ক্ষয়িষ্ণু সব মেরুদন্ড জুড়ে দেয়া হলো। ওদের বেশীর ভাগই ছিল গ্রাফাইটের সরু শলাকা। এর পর আমাকে নানা বর্ণে সাজানো হলো- লাল, নীল, কালো, বেগুনী। তোমরা যাকে বলো পেন্সিল বা রঙ পেন্সিল।
আমাকে নানা গ্রেড-এ চিহ্নিত করা হলো। নামকরণ করা হলো। এভাবেই এক বিশাল বৃক্ষ থেকে আমি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পেন্সিলে রূপান্তরিত হয়ে গেলাম। আর তোমরা- ছন্নছাড়া মানুষের দল, আমাকে হাতে নিয়ে আঁকি-বুকি করে যাচ্ছো ইচ্ছেমতো, মনের সুখে।
আমার কষ্টের কথা তোমরা হয়তো অনেকেই জানোনা।
তাইতো আমাকে নিয়ে কিছুই লিখছোনা। এক বৃক্ষের কষ্টের ইতিহাস জানা থাকলে তোমরা কখনই আমার মতো বৃক্ষ হতে চাইতে না। বরং তোমাদের সুখ দেখে আমি মনে মনে লোভাতুর হয়ে পড়ি। একটিবারের জন্য হলেও আমার মানুষ হতে ইচ্ছে করে। সভ্যতা সৃষ্টিতে আমার অংশদারিত্ব নয়, তোমাদের মতো সভ্যতার নিয়ন্ত্রক হতে ইচ্ছে করে।
মানুষ হলেই যেন পৃথিবীকে ইচ্ছেমতো বদলে দেয়া যায়। ঈশ্বর নন, যেন মানুষের ইচ্ছাতেই সব বদলে যায়। মানুষের প্রয়োজনেই হয়তো ঈশ্বর আমাকে সৃষ্টি করেছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।